মুসলিম ফারায়েজ নীতি প্রতিপালনে হ্রাস পাবে মামলাজট

মোঃ তাজুল ইসলাম
মোঃ তাজুল ইসলাম মোঃ তাজুল ইসলাম
প্রকাশিত: ০৫:১৫ পিএম, ২০ জানুয়ারি ২০২০

মামলা জট কমাতে আইন বিশেষজ্ঞ, আইনজীবী, রাজনীতিবিদ ও সরকার নানামুখী কর্মসূচী ও পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে এবং করছে। যেমন বিকল্প বিরোধ নিস্পত্তি (এডিআর), গ্রাম আদালত শক্তিশালি প্রকল্প, আইনগত সহায়তা প্রকল্প ইত্যাদি। ওইসব প্রকল্প ও উদ্যোগ মোটাদাগে মামলা জট হ্রাসে খুব বেশি সফলতা পেয়েছে বলে মনে হয় না।

মামলাজট কমাতে সমাধানের পথ খুঁজে বের করার আগে কেন মামলাজট বাড়ছে তার মূল কারণ অনুসন্ধান জরুরি এবং অপরিহার্য বলে মনে করি। মামলা দায়েরের সংখ্যা বৃদ্ধি বা মামলাজটের অন্যতম প্রধান কারণ হলো, মুসলিম ফারায়েজ নীতিমালা যথাযথ অনুসরণ না করা।

বাংলাদেশ মুসলিম অধ্যুষিত দেশ হওয়াতে মুসলিম শরিয়া ভিত্তিক উত্তরাধিকার আইন প্রচলিত আছে। দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সকল বিষয়ে বাংলাদেশের দেওয়ানি আদালতসমূহ মুসলমানদের মধ্যে সম্পত্তি ভাগ-বন্টনে মুসলিম ফারায়েজ নীতিমালা গ্রহণ করা হয়ে থাকে।

মুসলমানদের জন্য সম্পত্তি ভাগ-বন্টনের জন্য বিধিবিধান মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআন শরীফে সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছেন; কিন্তু ওই ফারায়েজ নীতি (Muslim Law of Inheritance) বর্তমান মুসলিম সমাজে না মানার প্রবণতা বহুগুণে বেড়ে গেছে। যার ফলে মামলা-মোকদ্দমার সংখ্যা আদালতে ও ট্রাইব্যুনালে লাগামহীনভাবে বেড়ে যাওয়ায় মামলাজট বেড়ে যাচ্ছে।

উদাহরণ স্বরূপ বলতে হয়, বোনদের সম্পত্তি ভাইয়েরা অহরহ ফাঁকি দিচ্ছে। পিতা তার জীবদ্দশায় কন্যা সন্তানকে বাদ রেখে বংশ রক্ষার্থে ছেলেদের নামে জমিজমা লিখে দেয় বা নতুন করে সম্পত্তি কিনে দিচ্ছে। শুধু কন্যা সন্তানের পিতা-মাতা, ভাই, ভাতিজাদের বঞ্চিত করতে নিজের কন্যাকে সমস্ত জমি দান করে দেয়। স্ত্রীকে স্বামী এবং স্বামীকে স্ত্রী মাহরুম করে ছেলে মেয়েদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে জমি লিখে দিচ্ছে।

সাধারণ নিয়ম হচ্ছে মৃতব্যাক্তির ওয়ারিশগণ তার মৃত্যুবরণের সাথে সাথে সম্পত্তির অধিকার অর্জন করবে। তা স্বত্তেও ইসলামী উত্তরাধিকার আইন উপেক্ষা করে অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করে সম্পত্তি হস্তান্তর করার ফলে পরবর্তীতে মৃত ব্যাক্তির শরিকদের মধ্যে নানা ধরনের জটিলতা ও মোকদ্দমা বেঁধে যায়।

একজন মৃত ব্যাক্তির এক বা একাধিক ওয়ারিশ থাকায় তাদের মধ্যে প্রচলিত মুসলিম উত্তরাধিকার আইন মোতাবেক সম্পত্তির সুষ্ঠু ভাগ-বন্টন না হওয়ায় একই জমিজমা নিয়ে এক বা একাধিক বা ততোধিক দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা মোকদ্দমা দেখা দেয়।

ফলে দেওয়ানি মামলা-মোকদ্দমার সাথে ফৌজদারি মামলা আশংকাজনকহারে বেড়ে যাচ্ছে। যেমন মুসলিম ভাই সকল তাদের বোনদেরকে ফাঁকি দিতে বোনদের নাম বাদ দিয়ে নিজেদের নামে সম্পত্তি খতিয়ানে রেকর্ড করে নেয়। যার ফলে যে বোনকে ফাঁকি দেয় সে ওই জমি উদ্ধার করতে বা বোন তার হক ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে অনেক সময় স্বত্তের (Title declaration suit) কেস করে, ভূমি জরিপ (ল্যান্ড সার্ভে) ট্রাইব্যুনালে রেকর্ড সংশোধনের (Record corrections) কেস করে, দেওয়ানি আদালতে বন্টনের কেস (Partition suit) করে এবং জমিজমা সংক্রান্ত মারামারি হলে ফৌজদারি আদালতে কেস (Criminal Case) করে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে মুসলিম ফারায়েজ আইন না মানার ফলে একই জমি নিয়ে একজন মৃতব্যক্তির শরিকদের মধ্যে কয়েক প্রকারের কেস-মামলা দায়ের হয়ে যায়। যদি মুসলিম আইন বিশেষ করে সম্পত্তি বন্টনে উত্তরাধিকার আইনটি যথাযথভাবে প্রতিপালন করানো যেত তাহলে মামলাজট দেখা দিত না।

আইনের ছাত্র হিসাবে দু-একটি সমস্যা নিয়ে আলোচনা করলে এই লেখাটি আরো বোধগম্য ও সুস্পষ্ট হবে।
সমস্যা ১ : একজন পিতার কেবল একজনই মেয়ে। এখন তিনি তার সকল স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি একমাত্র মেয়েকেই দিতে চান। সমস্যা ২: একজন পিতার ২ জন মেয়ে। এখন তিনি তার সকল স্থাবর/অস্থাবর সম্পত্তি তার ২ মেয়েকেই দিতে চান।
সমস্যা ৩: একজন পিতার ৩ জন মেয়ে। এখন তিনি তার সকল স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি ৩ জন মেয়েকেই দিতে চান।

প্রথমে আইনের ছাত্র যিনি তিনি বলবেন- পিতা তার জীবিত অবস্থায় সকল সম্পত্তি হেবা, দান বা বিক্রয় দলিলের মাধ্যমে কন্যাদের দিতে পারবে, কোন সমস্যা নাই। পিতার সম্পত্তি মেয়েকে বা মেয়েদের দিবে এতে আইনত কোনো বাধা-নিষেধ নেই, দিতে পারবে।

মুসলিম আইন লঙ্ঘন বা অন্য কাউকে তার প্রাপ্যতা না দিয়ে বঞ্চিত করলে পাপের দায়বদ্ধতা কেবলই দাতার, গ্রহীতার নয়। তাই আইনুযায়ী সুস্থ্য মস্তিষ্কের যে কোনো সাবালক ব্যক্তি তার ইচ্ছেমত দান, হেবা, সাফ-কবলা যাই-ই হোক না কেনো, করতে পারবেন।

মুসলিম আইনে বলতে গেলে প্রশ্নকারীকে বলতে হবে ভাই, আল্লাহকে ভয় করুন। যিনি এরূপ করতে চাচ্ছেন তাকে বুঝিয়ে বলুন যেন শেষ সময়ে এসে জাহান্নাম ক্রয় করে না নিয়ে যায়। সামান্য সম্পত্তির জন্য যেন নিজেকে জাহান্নামে নিজেই নিক্ষেপিত না করে। আল্লাহর দেয়া বিধান অনুযায়ী তাকে সম্পত্তির বন্টনে সহায়তা করুন। হকদার দের হক পরিশোধ করে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে সহায়তা করুন। ভাইপো-ভাতিজাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে বলুন যেটা ইসলাম নির্ধারণ করে দিয়েছে।

মুসলিম ফারায়েজ নীতি প্রতিপালন হতে পারে মামলাজট নিরসনে অন্যসব পন্থার মত আরেকটি সময়োপযোগী উপায় ও মাধ্যম। সকলের জ্ঞাতার্থে খুবই সংক্ষেপে মুসলিম ফারায়েজ নীতির মূল বিষয় নিচে তুলে ধরবো। মুসলিম ফারায়েজ নীতি...

১। স্ত্রীর দুই অবস্থা : (ক) মৃত ব্যক্তির সন্তান না থাকলে ১/৪, (খ) আর থাকলে ১/৮ অংশ পাবে, ২। স্বামীর দুই অবস্থা : (ক) স্ত্রীর মৃত্যুর পর সন্তান না থাকলে ১/২, (খ) আর থাকলে ১/৪ অংশ পাইবে, ৩। কন্যার তিন অবস্থা : (ক) একজন মাত্র কন্যা থাকলে ১/২, (খ) একাধিক থাকলে ২/৩ অংশ পাবে, (গ) পুত্র-কন্যা একসাথে থাকলে ২:১ অনুপাতে পাবে।

৪। পিতার তিন অবস্থা: (ক) মৃত ব্যক্তির পুত্র বা পৌত্র বা পুরুষ শ্রেনী বর্তমানে থাকলে ১/৬ অংশ পাইবে, (খ) পুরুষ শ্রেনি না থাকলে এবং কন্যা বা পৌত্রী বা মহিলা শ্রেনী বর্তমানে থাকলে (১/৬ + অবশিষ্ট) অংশ পাইবে, (গ)পুরুষ বা মহিলা শ্রেনী বর্তমানে না থাকলে অবশিষ্ট সকল অংশ পাবে।

৫। মায়ের তিন অবস্থা : (ক) মৃত ব্যক্তির সন্তান বা একাধিক ভাইবোন থাকলে ১/৬ অংশ পাবে, (খ) মৃত ব্যক্তির যদি কোন সন্তান না থাকে বা ভাইবোন ২ জনের কম থাকলে ১/৩ অংশ পাবে, (গ) স্বামী বা স্ত্রীর সাথে পিতা-মাতা উভয়ে থাকলে, মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি থেকে স্বামী বা স্ত্রীর অংশ দেয়ার পর বাকি সম্পত্তির ১/৩ অংশ পাবে।

৬। বৈপিত্রেয় ভাইবোনদের তিন অবস্থা : (ক) একজন মাত্র বৈপিত্রেয় ভাইবোন থাকলে ১/৬ অংশ, (খ) একাধিক থাকলে ১/৩ অংশ পাবে, (গ) মৃত ব্যাক্তির পুত্র বা পৌত্র, পিতা বা দাদা থাকলে বঞ্ছিত হবে।

৭। পৌত্রীগনের ছয় অবস্থা : (ক) একজন মাত্র পৌত্রী থাকলে ১/২, (খ) একাধিক থাকলে ২/৩ অংশ পাইবে, (গ) যদি মৃত ব্যক্তির একজন মাত্র কন্যা থাকে তাহলে পৌত্রীগন ১/৬ অংশ পাইবে, (ঘ) যদি মৃত ব্যক্তির একাধিক কন্যা থাকে তাহলে পৌত্রীগন বঞ্ছিত হবে, (ঙ) মৃত ব্যক্তির পৌত্রী ও পৌত্র একই সাথে থাকলে অংশীদার হইবে, (চ) যদি মৃত ব্যক্তির পুত্র থাকে তাহলে পৌত্রীগন বঞ্ছিত হইবে।

৮। সহোদরা বোনদের পাঁচ অবস্থা : (ক) একজন মাত্র সহোদরা বোন থাকলে ১/২, (খ) একাধিক থাকলে ২/৩ অংশ পাইবে, (গ) সহোদরা বোনের সাথে সহোদরা ভাই থাকলে আসাবা হইবে, (ঘ) যদি মৃত ব্যক্তির একজন মাত্র কন্যা বা পৌত্রী থাকে তাহলে সহোদরা বোনগন ১/৬ অংশ পাইবে। একাধিক কন্যা বা পৌত্রী থাকলে এবং অন্য কোন ওয়ারিশ না থাকলে অংশীদার হইবে, (ঙ) মৃত ব্যাক্তি পুরুষ শ্রেনীর ওয়ারিশ থাকলে সহোদরা বোনগন বঞ্ছিত হবে।

৯। বৈমাত্রেয় বোনদের সাত অবস্থা : (ক) যদি মৃত ব্যাক্তির সহোদরা বোন না থাকে ও একজন মাত্র বৈমাত্রেয় বোন থাকলে ১/২, (খ) একাধিক থাকলে ২/৩ অংশ পাবে, (গ) যদি মৃত ব্যক্তির একজন মাত্র সহোদরা বোন থাকে তাহলে বৈমাত্রেয় বোন ১/৬ অংশ পাইবে, (ঘ) যদি মৃত ব্যক্তির একাধিক সহোদরা বোন থাকে তাহলে বৈমাত্রেয় বোনগণ বঞ্ছিত হবে, (ঙ)যদি মৃত ব্যক্তির একাধিক সহোদরা বোন থাকে এবং বৈমাত্রেয় বোনের সাথে বৈমাত্রেয় ভাই থাকলে একত্রে অংশীদার হবে। (চ) মৃত ব্যক্তির কন্যা বা পৌত্রী থাকলে এবং অন্য কোন ওয়ারিশ না থাকলে বৈমাত্রেয় বোনগণ অবশিষ্ট অংশ পাইবে, (ছ) মৃত ব্যক্তির পুরুষ ওয়ারিশ থাকলে বৈমাত্রেয় বোনগন বঞ্ছিত হবে।

১০। দাদী-নানীর ২ অবস্থা : (ক) পিতৃ বা মাতৃ সম্পর্কের এক বা একাধিক যাই হোক ১/৬ অংশ পাইবে, (খ) মৃত ব্যক্তির মা জীবিত থাকলে বঞ্ছিত হবে। তবে পিতা জীবিত থাকলে দাদী বঞ্ছিত হবে।

পরিশেষে মুসলমানগন যদি মুসলিম ফারায়েজ নীতি যথাযথ অনুসরণ করে তাদের সম্পত্তি মৃত ব্যক্তির ওয়ারিশদের মধ্যে সুষ্ঠু ভাগ-বন্টনের ব্যবস্থা মেনে নেয়, তাহলে আদালত সমূহে শরীকদের মধ্যে সম্পদ বন্টন নিয়ে মামলা মোকদ্দমা বহুলাংশে কমে যাবে। মামলা দায়ের এর সংখ্যা কমে গেলে মামলাজট ও কেস ব্যাকলগ থাকবে না।

ইসলামকি ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে মসজিদের ইমামদের মুসলিম ফারায়েজ নীতি বিষয়ক আলোচনা ও সচেতনভাবে প্রচারের জন্য প্রত্যেকটি মসজিদে বয়ানে উল্লেখ করা যেতে পারে। স্কুল কলেজ ও মাদ্রাসা পাঠ্যপুস্তকে মুসলিম ফারায়েজ নীতি সহজভাবে উপস্থাপন করে অর্ন্তভূক্ত করা যেতে পারে।

অন্য ধর্মের অনুসারীরা যদি তাদের ধর্মের উত্তরাধিকার আইন অনুসরণ করে, তাহলে মামলাজট কমে যাবে। বাংলাদেশ সরকারের আইন মন্ত্রণালয় ও ধর্ম মন্ত্রণালয় এর মাধ্যমে মুসলিম ফারায়েজ নীতি মানাতে ও জানাতে প্রকল্প গ্রহণ করতে পারে।

মুসলিম ফারায়েজ নীতি মানলে ও অনুসরণ করলে মৃত ব্যাক্তির ওয়ারিশদের মধ্যে সম্পত্তি নিয়ে রেশারেশি ও ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটবে এবং জমিজমা সংক্রান্ত মামলা মোকদ্দমা দায়ের নিশ্চিতভাবে কমে আসবে।

আইএইচএস/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।