সংবর্ধনা ছাড়াই বিদায় নিলেন বিচারপতি মানিক
কোনো সংবর্ধনা ছাড়াই বিচারপতির বিচারিক জীবনের ইতি টেনে ঘরে ফিরলেন এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক।
২০ সেপ্টেম্বর থেকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত সুপ্রিমকোর্টের অবকাশকালীন ছুটি শুরু হওয়ায় বৃহস্পতিবার ছিল তার বিচারিক জীবনের শেষ কর্মদিবস।
শেষ কর্মদিবসে বিচারপতি হিসেবে এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক কোনো বিদায় সংবর্ধনা পাননি। এদিন সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি, অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসসহ কাউকেই বিদায় সংবর্ধনা দিতে দেখা যায়নি।
তবে এইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে তার খাসকামরায় শুভেচ্ছা জানিয়েছেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের কয়েকজন বিচারপতি। খাস কামরায় শুভেচ্ছা দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ।
সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার এম আমীর উল ইসলাম বলেন, একজন বিচারপতি বিদায় নিচ্ছেন। তাই তার সঙ্গে দেখা করে ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়েছি।
সংবর্ধনা ছাড়াই বিচারপতির বিদায় নজিরবিহীন উল্লেখ করে সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘অনেক সময় রাজনৈতিক বা অন্য কোনো কারণে আইনজীবী সমিতি কোনো বিচারপতিকে সংবর্ধনা না দিলেও অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের পক্ষ থেকে বা সরকার সমর্থক আইনজীবীদের পক্ষ থেকে সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। কিন্তু কোনো পক্ষ থেকেই সংবর্ধনা না দেয়ার নজির আমাদের বিচার ব্যবস্থায় ছিল না। এটাই প্রথম নজির।’
অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের পক্ষ থেকে কোনো সংবর্ধনা কেন দেয়া হলো না তা জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘উনি (এইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক) তো বেঞ্চেই বসতে পারলেন না। আমরা কীভাবে বিদায় জানাবো। নিয়ম হল বেঞ্চে থাকবেন, আমরা তাকে বিদায় জানাবো।’
শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকসহ ১১জন বিচারপতি আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারিতে হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্তি বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। পরবর্তী ২০০৯ সালের ২৫ মার্চ হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। এরপর হাইকোর্ট বিভাগে অনেক আলোচিত-সমালোচিত রায়, সুয়োমটো রুল ইস্যু, আদালত অবমাননার মামলায় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের দাঁড় করিয়ে রাখা, তৎকালীন স্পিকার আব্দুল হামিদকে ‘মূর্খ-অজ্ঞ’ বলে তিরস্কার করা, স্পিকারের বক্তব্যকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল উল্লেখসহ নানা কারণে তিনি আলোচিত হয়ে ওঠেন। পরে শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের বিরুদ্ধে রুলিং জারি করেন তৎকালীন স্পিকার। পরবর্তীতে ওই রুলিং অকার্যকর ও ভিত্তিহীন উল্লেখ করে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে সরকার আপিল দায়ের করলে আপিল বিভাগ তা নিষ্পত্তি করে রায় দেন। আপিল বিভাগের ওই রায় আজও প্রকাশিত হয়নি।
সুপ্রিমকোর্টের চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী কোনো বিচারপতি অবসরে গেলে তাকে বেঞ্চেই (এজলাস) সংবর্ধনা দেন বিচারপতি ও আইনজীবীরা। তবে গত ৯ সেপ্টেম্বর থেকে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীকে কোনো বিচারিক দায়িত্ব না দেয়ায় তিনি এজলাসে বসতে পারেননি।
এই বিষয়টি উল্লেখ করে গত রোববার রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠিও দিয়েছেন বিচারপতি মানিক। প্রধান বিচারপতি ব্যক্তিগত বিরাগের বশবর্তী হয়ে তাকে বিচারিক কার্যক্রম থেকে সরিয়ে রেখেছেন বলেও ওই চিঠিতে দাবি করেন বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। চিঠিতে তিনি প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্রকুমার সিনহার অভিসংশনও চান।
এদিকে, বৃহস্পতিবার দুপুর থেকেই বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে তার খাসকামরায় গিয়ে বিদায় সংবর্ধনা জানিয়েছেন সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি ও আইনজীবীরা। জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার এম আমীর-উল-ইসলাম, অ্যাডভোকেট আব্দুল বাসেত মজুমদার, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর, অ্যাডভোকেট সালাউদ্দিন দোলন, অ্যাডভোকেট লায়েকুজ্জামান মোল্লা, অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদসহ অসংখ্য আইনজীবী তাকে বিদায় সংবর্ধনা জানান।
এছাড়া অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজাসহ অনেক সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীকে খাসকামরায় বিদায় জানান।
এর আগে বিএনপি-জামায়াতপন্থী আইনজীবীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি বিচারপতি মানিককে সংবর্ধনা দেবে না বলে গত রোববার এক সাধারণ সভায় সিদ্ধান্ত নেয়। তবে ওই সভায় বিচারপতি মানিককে সংবর্ধনা দেয়াকে কেন্দ্র করে বিএনপি ও আওয়ামীপন্থী আইনজীবীদের মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থতিও সৃষ্টি হয়।
উল্লেখ্য, বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ১৯৭৮ সালে হাইকোর্টের আইনজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন। তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ২০০৯ সালের ২৫ মার্চ হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। পরে ২০১৩ সালের ৩১ মার্চ সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। এরপর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল শুনানির বেঞ্চের সদস্যও ছিলেন। বর্তমান প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা দায়িত্ব নেয়ার পর ট্রাইব্যুনালের মামলার আপিল শুনানির বেঞ্চ থেকে বিচারপতি মানিককে সরিয়ে দেয়া হয়। সর্বশেষ গত ৯ সেপ্টেম্বর থেকে তাকে আপিল বিভাগের দুটি বেঞ্চের একটিতেও রাখা হয়নি।
আগামী ১ অক্টোবর তার বয়স ৬৭ বছর পূর্ণ হওয়ায় ওই দিন অবসরে যাবেন বিচারপতি মানিক। তবে শুক্রবার থেকে সুপ্রিমকোর্টে দেড় মাসের ছুটি শুরু হওয়ায় বৃহস্পতিবার বিচারিক জীবনের সমাপ্তি হয় তার। অন্যদিকে কোনো বেঞ্চ না থাকায় অন্য কোনো পক্ষ থেকেও তাকে কোনো বিদায় সংবর্ধনা দেয়া হয়নি। ফলে আনুষ্ঠানিক কোনো বিদায় সংবর্ধনা ছাড়াই বিদায় নিতে হল বিচারপতি মানিককে।
এফএইচ/একে/পিআর