‘জাহালমের ঘটনায় দায়ী নয় সোনালী ব্যাংক’
বিনা দোষে দুদকের ভুলে সোনালী ব্যাংকের সাড়ে ১৮ কোটি টাকা আত্মসাতে জড়িত আবু সালেকের পরিবর্তে নিরীহ পাটকলশ্রমিক জাহালমকে শনাক্ত করায় সোনালী ব্যাংকের কোনো দোষ নেই উল্লেখ করে হাইকোর্টে প্রতিবেদন দাখিল করেছেন ব্যাংকটির আইনজীবী।
সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ গত বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) এক প্রতিবেদন দিয়ে হাইকোর্টকে এই তথ্য জানিয়েছে। হাইকোর্টের বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে এই প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে।
সোনালী ব্যাংকের আইনজীবী শেখ মো. জাকির হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘সোনালী ব্যাংকের টাকা আত্মসাতের ঘটনায় সরাসরি জড়িত ছিলেন আবু সালেক। কিন্তু আবু সালেকের পরিবর্তে নিরীহ জাহালমকে শনাক্তকরণে সোনালী ব্যাংকের কোনো দায় ছিল না। এ ঘটনায় সোনালী ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন না।
সোনালী ব্যাংকের এই আইনজীবী আরও জানান, সোনালী ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় সোনালী ব্যাংকের আটজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়। এসব কর্মকর্তার কারও কারও বেতন বাড়ানো বন্ধ রাখা হয়।
সোনালী ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির ঘটনার সব মামলাতেই আবু সালেক নামের এক ব্যক্তির নাম ছিল। তবে, তদন্তে অন্যতম প্রধান আসামি আবু সালেকের পরিবর্তে টাঙ্গাইলের পাটকলশ্রমিক জাহালামের নামে অভিযোগপত্র দেয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পরে জাহালমকে গ্রেফতার করা হয় এবং বিনা দোষে তিন বছর কারাভোগও করেন তিনি।
গত ৩০ জানুয়ারি ‘স্যার, আমি জাহালম, সালেক না’ শীর্ষক শিরোনামে জাতীয় দৈনিকে প্রতিবেদন প্রকাশ পায়। এরপর প্রকাশিত প্রতিবেদনটি ওই দিনই আদালতের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অমিত দাশ গুপ্ত।
ওই প্রতিবেদন আমলে নিয়ে হাইকোর্টের বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত স্বঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারির আদেশ দেন।
জাহালমের আটকাদেশ কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চান হাইকোর্ট। এরপর হাইকোর্টের আদেশে গত ৩ ফেব্রুয়ারি পাটকলশ্রমিক জাহালম কারাগার থেকে ছাড়া পান।
সোনালী ব্যাংকের ৮ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা
আদালতে দেয়া সোনালী ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ২০১০ সালে ব্যাংকের ক্যান্টনমেন্ট শাখায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতির ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ঘটনাটি তদন্ত করে। এরপর সোনালী ব্যাংকের তৎকালীন উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) এ কে এম সাজেদুর রহমান খান বাদী হয়ে মতিঝিল থানায় মামলা করেন। মামলাটি প্রথমে তদন্তের দায়িত্ব পায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। পরে মামলার তদন্তভার পায় দুর্নীতি দমন কমিশন।
সোনালী ব্যাংকের টাকা জালিয়াতির ঘটনায় সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কী কী ব্যবস্থা নিয়েছে, তা সবিস্তার ৪১৯ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন হাইকোর্টকে জানানো হয়েছে। কীভাবে চক্রটি সোনালী ব্যাংকের সাড়ে ১৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে, তা-ও জানানো হয়েছে হাইকোর্টকে।
হাইকোর্টে জমা দেয়া সোনালী ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, সোনালী ব্যাংকের ক্যান্টনমেন্ট শাখার তৎকালীন সাপোর্টিং সাব স্টাফ মাইনুল হক টাকা আত্মসাৎ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাকে বরখাস্ত করেছে। পাশাপাশি ওই ব্যাংকের আরও সাতজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়। মামলার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের দেয়া হয় বিভিন্ন লঘুদণ্ড।
জালিয়াতির ঘটনার সময় সোনালী ব্যাংকের ক্যান্টনমেন্ট শাখায় ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তা আজিজুল হকের বেতন এক বছর বন্ধ রাখা হয়। তার বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ আনা হয়। এ ছাড়া সোনালী ব্যাংকের আরও ছয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিভিন্ন লঘুদণ্ড ও তিরস্কার করা হয়। ওই ছয় কর্মকর্তা হলেন ক্যান্টনমেন্ট শাখার তৎকালীন ব্যবস্থাপক বেগম আখলাকুন নাহার, জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিন, জ্যেষ্ঠ নির্বাহী কর্মকর্তা লুৎফর রহমান, নির্বাহী কর্মকর্তা মাহতাব উদ্দিন, সাপোর্টিং সাব স্টাফ মিজানুর রহমান ও আজিজুল হকের।
অর্থ আদায়ে সোনালী ব্যাংকের মামলা
সোনালী ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতে জড়িত আবু সালেকের বদলে জাহালমকে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে সোনালী ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা যে জড়িত ছিলেন না, তা প্রতিবেদনে বারবারই উল্লেখ করা হয়েছে। সোনালী ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, সোনালী ব্যাংকের টাকা আত্মসাতের সময় দায়িত্ব পালনকারী সোনালী ব্যাংকের সাত কর্মকর্তার জবানবন্দি রেকর্ড করে তদন্তকারী দল। তদন্ত দলের কাছে ওই সাত কর্মকর্তা দাবি করেছেন, জাহালমকে আবু সালেক বলে শনাক্ত করে দুদকের কাছে তারা কোনো বক্তব্য দেননি। সোনালী ব্যাংকের ওই সাত কর্মকর্তা হলেন-আজিজুল হক, আখলাকুন নাহার, নিজাম উদ্দিন, লুৎফুন্নেছা, নুরুদ্দিন শেখ, ফজলুল হক ও অলকা হালদার।
সোনালী ব্যাংকের আত্মসাৎ করা টাকা আদায় করার জন্য অর্থ আত্মসাতে জড়িত ১৬ জন, একাধিক বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ৭৪ জনের বিরুদ্ধে ২০১২ সালে ঢাকার আদালতে অর্থ মোকদ্দমা (মানি স্যুট) হয়। এ মামলার বাদী সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। ওই মামলাটি এখন ঢাকার পঞ্চম জেলা জজে বিচারাধীন।
এ ব্যাপারে সোনালী ব্যাংকের আইনজীবী শেখ মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘সোনালী ব্যাংক কিন্তু কোথাও জাহালমকে আসামি করেনি। সোনালী ব্যাংকের আত্মসাৎ করা সাড়ে ১৮ কোটি টাকা উদ্ধারের জন্য প্রধান আসামি আবু সালেকসহ ১৭টি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, শাখা ব্যবস্থাপকসহ ৭৬ জনকে বিবাদী করে মামলা করা হয়েছে।’
অন্যতম প্রধান আসামি আবু সালেকের পরিবর্তে জাহালমের কারাভোগের ঘটনায় হাইকোর্টে জমা দেয়া প্রতিবেদনে গভীর ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সোনালী ব্যাংক। জাহালমের কারাভোগের ঘটনা নিয়ে গত ২৮ জানুয়ারি প্রকাশিত প্রতিবেদনের সূত্র ধরে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ একটা তদন্ত কমিটি গঠন করে।
আইনজীবী জাকির হোসেন বলেন, ‘জাহালমের কারাভোগের ঘটনায় সোনালী ব্যাংকের কোনো দায় নেই। কারণ সোনালী ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা জাহালমকে শনাক্ত করেননি। প্রতিবেদন দিয়ে হাইকোর্টকে এই তথ্য আমরা দিয়েছি।’
দুদকের ১১ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা
সোনালী ব্যাংকের সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির ঘটনায় নিরীহ পাটকলশ্রমিক জাহালমকে আসামি করায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদকের) ১১ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে। ২১ আগস্ট দুর্নীতি দমন কমিশন হাইকোর্টকে এক প্রতিবেদন দিয়ে এই তথ্য জানিয়েছে।
তবে প্রতিবেদনে দুদকের ১১ কর্মকর্তার নাম উল্লেখ না থাকায় ওই প্রতিবেদন গ্রহণ করেননি হাইকোর্ট। আগামী বুধবার (২৮ আগস্ট) দুদকের ১১ কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে পূর্ণাঙ্গ তথ্য জমা দেয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
ব্র্যাকের দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা
২১ আগস্ট ব্র্যাক ব্যাংকের আইনজীবী আসাদুজ্জামান হাইকোর্টকে জানান, আবু সালেকের পরিবর্তে জাহালম কারাভোগের ঘটনায় ব্র্যাক ব্যাংকের দুজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, হাইকোর্টের আদেশের পর ব্র্যাকের দুজন কর্মকর্তাকে প্রথমে কারণ দর্শানোর নোটিশ (শোকজ) দেয়া হয়। এরপর অন্যান্য ব্যবস্থা নেয়া হয়।
এফএইচ/এসআর/এমএস