মালয়েশিয়ায় রিক্রুটিং সিন্ডিকেট : হাইকোর্টের তদন্তে অসন্তোষ
মালয়েশিয়ায় শ্রমিক প্রেরণ নিয়ন্ত্রণকারী ১০ রিক্রুটিং এজেন্সির সিন্ডিকেট এবং তাদের অনিয়ম তদন্তে গঠিত প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কমিটির ধীরগতিতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। আদালত তদন্ত কমিটিকে তাদের কার্যপরিধি ঠিক করে দিয়ে তিন মাস সময় দিয়েছেন।
আদালত বলেছেন, ১৪ নভেম্বরের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট আদালতে দাখিল না করলে কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার দায়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
মালয়েশিয়ায় শ্রমিক প্রেরণকারী ১০ রিক্রুটিং এজেন্সি সিন্ডিকেট এবং তাদের অনিয়ম তদন্তে গঠিত মন্ত্রণালয়ের কমিটির প্রতিবেদন নিয়ে শুনানির নির্ধারিত দিনে সময় চাওয়ার পর বুধবার হাইকোর্টের বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
আদালতে এদিন রিটের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম। দুদকের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট খুরশিদ আলম খান। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের পক্ষে ছিলেন শেখ জালাল উদ্দিন।
ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম বলেন, ছয় মাসের মধ্যে তাদের একটা তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার কথা ছিল। এখন প্রায় ১০ মাস শেষ হতে চলেছে। এতদিনেও প্রতিবেদন না দেয়ায় কোর্ট অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন তদন্তের গতি নিয়ে। হাইকোর্ট বলেছেন, ছয় মাসের মধ্যে দেয়ার কথা, এখন ১০ মাস পার হয়ে যাচ্ছে। ওনারা বারবার এসে সময় চাচ্ছেন।
এ অবস্থায় আমরা কমিটিকে কার্যপরিধি ঠিক করে দিতে আদালতে আবেদন করি। আদালত আমাদের আবেদন মঞ্জুর করে পাঁচটি কার্যপরিধি নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
পাচঁটি বিষয় হলো
১. সিন্ডিকেটটা যতদিন চালু ছিল (১০ মার্চ ২০১৭ থেকে ২৭ ডিসেম্বর ২০১৮), ওই সময়ে কোন কোন রিকুটিং এজেন্সি শ্রমিক পাঠাতে পেরেছে এ তথ্য দিতে হবে। এতে যদি দেখা যায় ওই ১০ জন ছাড়া কেউ শ্রমিক পাঠাতে পারেনি তাহলে তাতেই প্রমাণ হয়ে যায় তাদের একটা সিন্ডেকেট ছিল।
২. প্রতিটা শ্রমিক থেকে কত টাকা উত্তোলন করা হয়েছে মাইগ্রেশন খরচ বাবদ। সরকার নির্দিষ্ট করে দিয়েছে ৩৭ হাজার ৫০০ টাকা করে। তারপর এটাকে একটু বাড়িয়ে এক লাখ ৬০ হাজার টাকা করে নির্ধারণ করে সার্ভিস চার্জ নিতে পারে। কিন্তু দেখা গেছে প্রত্যেক শ্রমিক থেকে চার লাখ করে নেয়া হয়েছে। ওই দুই বছরে বিদেশে গেছে দুই লাখ ৮৫ হাজার শ্রমিক। তার মানে কয়েকশ কোটি টাকার ব্যাপার এখানে। এটা তদন্ত করে দেখতে হবে কতটাকা নেয়া হয়েছে?
৩. মালয়েশিয়া থেকে যখন সিদ্ধান্ত আসল ১০ জুনের মাধ্যমেই শ্রমিক পাঠাতে হবে তখন এখান থেকে প্রতিবাদ করা হয়েছে। এই প্রতিবাদে সম্মুখীন হয়ে ১১ নম্বর বিবাদী নুর আলী, যিনি এই সিন্ডিকেটের মাস্টারমাইন্ড, তিনি সরকারের কাছে একটা প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তাতে তিনি বলেছিলেন, এক একজন সিন্ডিকেটের আরও ২০ জন করে রিক্রুটিং এজেন্সি অন্তর্ভুক্ত। এতে ২০০ জন হয়ে যায়। এই ২০০ জনের মাধ্যমে আমরা পাঠাব। ধীরে ধীরে সবাইকে তাতে যুক্ত করব। তখন সরকার এটাকে অনুমোদন করেছে। কিন্তু আমরা এটাকে তদন্ত করে দেখতে বলেছি, সবাই মিলেমিশে পাঠিয়েছিল না-কি, ১০ জনই পাঠিয়েছে।
৪. মালয়েশিয়ায় বা বিদেশে শ্রমিক পাঠাতে হলে শ্রমিকদের মেডিকেল পরীক্ষা করতে হয়। মালয়েশিয়ার জন্য ২৬টি মেডিকেল সেন্টার খোলা হয়েছিল। ওই ২৬টার মধ্যে ৮টা ছিল সিন্ডিকেটের মধ্যে। দেখা গেছে, যেখানে মেডিকেল পরীক্ষার ফি ছিল ১৫০০ থেকে দুই হাজার টাকা। কিন্তু তারা নিয়েছে পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা করে। পাঠিয়েছে তিন লাখ শ্রমিকের মতো। আর মেডিকেল পরীক্ষা করানো হয়েছে পাঁচ লাখের মতো। যারা যেতে পারেননি তাদের মেডিকেল পরীক্ষার টাকা ফেরতও দেয়া হয়নি। এই মেডিকেল সেন্টারের মাধ্যমে কত টাকা আদায় হয়েছে সেটাও খুঁজে দেখতে হবে।
৫. জনশক্তি কর্মকসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ইসরাফিল আলমসহ চারজন সংসদ সদস্য মালয়েশিয়া গিয়েছিলেন সিন্ডিকেটের বিষয়ে তদন্ত করতে। বেসরকারি চ্যানেল এটিএন বাংলার একটা ওপেন টকশোতে তিনি বলেছিলেন, তদন্ত করা উচিত। শ্রমিকদের থেকে যে টাকা নেয়া হয়েছে সেটা পাচার হয়েছে কি-না, সেটাও তদন্ত করতে বলা হয়েছে। এছাড়া সিন্ডিকেটের অন্যান্য অনিয়মও তদন্ত করতে পারবেন কমিটি।
গত ২৬ জুন মালয়েশিয়ায় শ্রমিক প্রেরণ নিয়ন্ত্রণকারী ১০ রিক্রুটিং এজেন্সির সিন্ডিকেট এবং তাদের অনিয়ম তদন্ত ১৮ জুলাইয়ের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেন আদালত। কিন্তু কমিটি প্রতিবেদন দাখিল না করে আবারও সময় চান।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে সিন্ডিকেটের অনিয়ম তদন্তে হাইকোর্টের নির্দেশে কমিটি গঠন করে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।
কমিটিতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবকে আহ্বায়ক করা হয়েছে। গত বছরের ২৯ অক্টোবর মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানো নিয়ন্ত্রণকারী ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সির সিন্ডিকেটের অনিয়ম তদন্তে কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন আদালত।
মালেশিয়া ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি উপেক্ষা করে ১০ এজেন্সির মাধ্যমে লোক নেয়ার ঘটনার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বঞ্চিত অপর ১০ এজেন্সি হাইকোর্টে রিট করেন।
এফএইচ/এমএআর/এমএস