‘প্রকৃত সত্য জানতে রায় প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করাই শ্রেয়’
চলমান মামলার বিষয়ে শুনানিতে বিষয়বস্তুর বাইরে গিয়েও কথা হয়, আদালত যা বোঝাতে চান সেটা অনেকে বুঝতে ভুল করেন। তাই আদালতের রায় প্রকাশ না করা পর্যন্ত অপেক্ষা না করে শুনানির সময় করা মন্তব্য চূড়ান্ত হিসেবে ধরে নেয়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ বলেছেন হাইকোর্ট।
আদালত আরও বলেন, এজন্য প্রকৃত সত্য জানতে রায় প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করাই শ্রেয়।
গত ১ আগস্টের নির্দেশনার প্রসঙ্গ টেনে আদালত বলেন, ওইদিন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ থেকে ‘রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ছাড়া দেশে কোনো ভিআইপি নেই’ বলে কোনো আদেশ দেননি। কিন্তু তারপরও কিছু অনলাইন গণমাধ্যম আদালতের আদেশ না দেখেই এ নিয়ে ভিত্তিহীন সংবাদ প্রচার করেছে। তাই বলছি, চূড়ান্ত রায়ের আগে আদালতের কোনো আলাপ-চারিতার ওপর ভিত্তি করে জনগণ যেন কোনো সিদ্ধান্ত না নেয়।
‘রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ছাড়া কেউ ভিভিআইপি বা ভিআইপি নন’ বলে আদালতের করা মন্তব্য কিছু কিছু গণমাধ্যম ‘হাইকোর্টের আদেশ’ বলে রিপোর্ট প্রকাশ করে। এসব প্রতিবেদন সংযুক্ত করে হাইকোর্টে রিট আবেদনের ওপর শুনানি শেষে বুধবার এমন মন্তব্য করেন আদালত।
এরপর সংবিধান, রাষ্ট্রীয় পদক্রম (ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স) ও দেশে প্রচলিত আইন অনুযায়ী যারা যেভাবে প্রটোকল পাচ্ছিলেন, তাদের আগের মতোই প্রটোকল দিতে জেলা প্রশাসক (ডিসি), পুলিশ সুপারসহ (এসপি) সংশ্লিষ্টদের প্রতি নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট। কোনো প্রকার ব্যর্থতা ছাড়াই এ প্রটোকল চলমান রাখতে নির্দেশ দেন আদালত।
আদালতের এ আদেশ অতিসত্বর দেশের সকল জেলা জজদের কাছে পৌঁছে দিতে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আদেশের অনুলিপি মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও জনপ্রশাসন সচিবের কাছে পাঠাতে বলা হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. শাহিনুর রহমানের করা এক রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে বুধবার হাইকোর্টের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি মোহাম্মদ আলীর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এসব নির্দেশনা দেন।
রিট আবেদনকারীর পক্ষে আইনজীবী ছিলেন অ্যাডভোকেট একরামুল হক টুটুল, সৈয়দ মামুন মাহবুব, তাপস কুমার বিশ্বাস। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত তালুকদার।
আদেশের পর অ্যাডভোকেট একরামুল হক টুটুল সাংবাদিকদের জানান, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিসহ সাংবিধানিক পদধারীদের এবং রাষ্ট্রীয় পদক্রম (ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স) অনুযায়ী যারা যারা প্রটোকল পাচ্ছিলেন, তাদের আগের মতোই প্রটোকল দিতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
শুনানিতে আইনজীবী বলেন যে, বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চ ‘দেশে কোনো ভিআইপি নেই’ বলে কোনো আদেশ দেননি। কিন্তু তারপরও কিছু অনলাইন গণমাধ্যম আদালতের আদেশ না দেখেই এনিয়ে ভিত্তিহীন সংবাদ প্রচার করেছে।
আদালত এ সময় বলেন, এটা বোঝা উচিত যে, আমরা (আদালত) মামলা বোঝার জন্য কিছু কথা বলি, কখনও তা বিষয়বস্তুর বাইরে যেয়েও বলা হয়। আমরা যা বোঝাতে চাই, সেই বার্তা কেউ কেউ বুঝতে ভুল করেন। তাই আদালতের রায় প্রকাশ পর্যন্ত অপেক্ষা না করে শুনানিকালে করা মন্তব্যকে চূড়ান্ত হিসেবে ধরে নেয়াটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এ কারণে প্রকৃত সত্য জানতে রায় প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করাই শ্রেয়।
আদালত আরও বলেন, আমাদের (বিচারপতি) ‘মাই লর্ড’ বলে সম্বোধন করা হয়ে থাকে। কিন্তু বিচারপতিরা মানবীয় গুণাবলির বাইরে নন। আমরা কেউ ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে নই। কখনও কখনও আমরা কথা বলার সময় আমাদের চিন্তা যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারি না।
‘এটা প্রত্যেকেরই মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, যখন একজন বিচারপতি তার চিন্তা নিয়ে আদালতে কথা বলেন বা মন্তব্য করেন, সেই মন্তব্যকে চূড়ান্ত ধরে নেয়াটাই ঝুঁকিপূর্ণ। এক্ষেত্রে বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চ বিষয়বস্তুর বাইরে যেয়ে মন্তব্য করেন এবং সেই মন্তব্য নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে।’
আদালত বলেন, ‘চূড়ান্ত রায়ে আদালত তার চিন্তা ও চেতনা প্রকাশ করার সুযোগ পেয়ে থাকে। সেই চূড়ান্ত রায় না হওয়া পর্যন্ত এরকম একটি সাধারণ মন্তব্যকে কেন্দ্র করে জনগণ কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হবে না বলে প্রত্যাশা করি।’
‘সাংবাদিকরা রাষ্ট্র ও সমাজের মুখপাত্র হিসেবে সংবাদ তুলে ধরে। আমরা সাংবাদিকদের খুবই শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখি। এ কারণেই এটা প্রত্যাশা করি যে, তারা খুবই দায়িত্বশীলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবেন। যে দায়িত্বশীলতা আংশিক নয়, পুরো সত্য তুলে ধরবে।’
গত ২৫ জুলাই রাতে সরকারের একসেস টু ইনফরমেশন (এ টু আই) প্রকল্পের যুগ্ম সচিব আব্দুস সবুর মন্ডলের গাড়ির অপেক্ষায় মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি এক নম্বর ফেরিঘাটে প্রায় তিন ঘণ্টা ফেরি বসিয়ে রাখা হয়। ফেরিঘাটে আটকে পড়া স্কুলছাত্র তিতাস ঘোষকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স পার করার জন্য বারবার অনুরোধ জানিয়েও ফেরি ছাড়া যায়নি। ফলে অ্যাম্ব্যুলেন্সেই মৃত্যু হয় তিতাসের।
ওই ঘটনায় বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন সংযুক্ত করে তিতাসের পরিবারকে তিন কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হাইকোর্টে রিট আবেদন করা হয়। ওই রিট আবেদনের ওপর শুনানিকালে গত ৩১ জুলাই হাইকোর্ট বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ছাড়া দেশে কেউ ভিআইপি নয়। এ দুজন ছাড়া অন্য সকল সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত বিধায় তারা অগ্রাধিকার পেয়ে থাকেন।’
আদালত সে সময় বলেন, ‘সারাবিশ্বে ফায়ার ব্রিগেড, অ্যাম্ব্যুলেন্স ও নিরাপত্তার জন্য পুলিশের গাড়ি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যেতে দেয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশে তার উল্টোটা হয়। আমরা ঘটনাটি (তিতাসের মৃত্যু) জানি। এরা (যুগ্ম সচিব) কেউ ভিআইপি নন। ভিআইপি কারা সেটা আইনেই বলে দেয়া আছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার জন্য যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এটা অন্য কারও ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। ভিআইপি থাকলেও অ্যাম্বুলেন্সকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আগে যেতে দেয়া হয়ে থাকে। কারণ এর সঙ্গে একজন মানুষের জীবন-মৃত্যুর বিষয় জড়িত।’
এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর হাইকোর্টের একজন বিচারপতিকে প্রটোকল দিতে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন থেকে খুলনার প্রশাসনকে চিঠি দেয়া হয়। ওই চিঠি নিয়ে কিছু গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় যে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ছাড়া অন্য কেউ ভিআইপি নয় বলে হাইকোর্ট রায় দিয়েছেন। এরপরও হাইকোর্টের বিচারপতির জন্য ভিআইপি প্রটোকল চাওয়া হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদন যুক্ত করে রিট আবেদন করা হয়।
গত ১৩ ফেব্রুয়ারি বিচারপতিদের প্রটোকল দেয়ার বিষয়ে চার দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। সেই রায়ে বলা হয়, ১. সুপ্রিম কোর্টের কোনো বিচারপতি ছুটির দিনে কোনো জেলা সদরে পরিদর্শন, ভ্রমণ বা সফরে গেলে অন্তত জেলা ও দায়রা জজ পদমর্যাদার একজন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা সফরকারী বিচারপতিকে সার্কিট হাউজ বা তার অবস্থানের জায়গায় অভ্যর্থনা জানাবেন। সফরকারী বিচারপতি জেলা সদর দফতরে অবস্থান করলে জেলা ও দায়রা জজ অবশ্যই তাকে সৌজন্য কল করবেন।
২. অফিস চলাকালে কোনো বিচারপতি সফরে গেলে জাজ ইনচার্জ নেজারত বিচারপতিকে অভ্যর্থনা জানাবেন। তবে আদালতের কার্যক্রম শেষে জেলা ও দায়রা জজ অথবা তার অনুপস্থিতেতে একজন বিচারিক কর্মকর্তা সফরকারী বিচারপতিকে সৌজন্য কল দেবেন।
৩. সফরকারী বিচারপতি উপজেলা বা গ্রামে অবস্থান করলে জাজ ইনচার্জ নেজারত অথবা একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা তার দেখভাল করবেন।
৪. সফরকারী বিচারপতির বিদায়ের সময় জেলা ও দায়রা জজ কিংবা অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজকে অবশ্যই উপস্থিত থাকতে হবে। এ সময় জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার বা তাদের প্রতিনিধিদের উপস্থিত থাকতে হবে।
এফএইচ/এমএআর/এমকেএইচ