জয় হলো ভালোবাসার, মুক্তি পেল সেই তুষার
কথায় আছে ‘প্রেমের মরা জলে ডুবে না।’ তেমনি সত্যিকারের ভালোবাসা কখনো হার মানে না বা হারায় না। প্রেম-ভালোবাসার জয় কোনো না কোনোভাবে হবেই। তেমনি ভালোবাসার টানে ব্রাহ্মণ বাবা-মায়ের ঘর ছেড়ে হরিজন সম্প্রদায়ের ছেলে তুষারকে বিয়ে করেছিল সুষ্মিতা দেবনাথ অদিতি। হিন্দুত্বের সেই সাম্প্রদায়িক প্রথা ভেঙে জয় হলো ভালোবাসার।
ভালোবাসার অপরাধে ‘অপরাধী’ হয়ে ১৪ বছরের কারাদণ্ড নিয়ে জেলে থাকা প্রেমিক তুষার বুধবার (৭ আগস্ট) কারামুক্ত হন। বর্ণ প্রথাকে পায়ে ঠেলে মনের জোরে ভালোবাসাকে জয় করে তুষার-সুষ্মিতার প্রেম নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে। হাইকোর্ট থেকে জামিন পাওয়ার ছয়দিনের মাথায় বুধবার গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন তুষার। এ সময় স্ত্রী সুষ্মিতা দেবনাথ অদিতি ও বাবা রঞ্জিত দাস উপস্থিত ছিলেন।
কারামুক্তির পর তুষার সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি খুশি। আমার স্ত্রী আইনি লড়াই করে আমাকে মুক্ত করেছে। আমাদের ভালোবাসার জয় হয়েছে। আমার ভালোবাসা আজ সার্থক।’
ভালোবেসে বিয়ে করার পর অদিতির মায়ের (শাশুড়ি) করা মামলায় ১৪ বছরের কারাদণ্ড দিয়ে তুষারকে কারাগারে পাঠান আদালত। এখানে সমস্যা হলো আসামি তুষার দলিত সম্প্রদায়ের আর মেয়ে ব্রাহ্মণ।
আদালত বলেন, এখানে উঁচু-নিচু জাতের একটি বিষয় আছে। ভালোবেসে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হলেও ধর্ষণ ও অপহরণের অভিযোগে শাশুড়ির করা মামলায় হাইকোর্টে করা আপিলের শুনানিতে গত ১ আগস্ট এমন মন্তব্য করেন আদালত। তখন আদালত বলেন, এখানে সমস্যা হলো আসামি দলিত সম্প্রদায়ের। আর মেয়ে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের। আমাদের সমাজে তো এরকম প্রথা রয়েছে যে উঁচু-নিচু অসম বিয়ের ঘটনা ঘটলে সমাজচ্যুতির ভয় থাকে।
ভালোবাসার টানে ব্রাহ্মণ বাবার ঘর ছেড়ে হরিজন সম্প্রদায়ের ছেলে তুষারকে বিয়ে করে সুষ্মিতা। ধর্মীয় বর্ণ বৈষম্যের শিকার সামাজিক নাটকীয়তার এক পর্যায়ে নিজের স্ত্রীকে অপহরণের দায়ে ১৪ বছরের সাজা মাথায় নিয়ে তুষারকে কারাবরণ করতে হয়। এরপর গত (১ আগস্ট) হাইকোর্ট থেকে জামিন মিলে তুষারের। কিশোর সংশোধনী আর কোর্টের বারান্দা ঘুরে ৮৯ দিনের সন্তানকে কোলে নিয়ে স্বামীর জামিনের পর সেদিন সুষ্মিতার মুখে ফুটেছিল হাসি। এরপর আজ সেই হাসির পূর্ণতা পেল।
সিনেমার গল্পের মতো তুষার-সুষ্মিতার বিয়ে আর ভালোবাসা সম্পর্ক নিয়ে আইনজীবী জানান, প্রায় দুই বছর আগে ২০১৭ সালের ১৫ অক্টোবর হরিজন সম্প্রদায়ের ছেলে তুষার দাস ভালোবেসে বিয়ে করেন ব্রাহ্মণ মেয়ে সুষ্মিতা দেবনাথ অদিতিকে। এ দম্পতির কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে এক কন্যাসন্তান। কিন্তু বিয়ে মেনে নিতে পারেনি সুষ্মিতার পরিবার।
তাই ভালোবেসে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পরও ধর্ষণ ও অপহরণের অভিযোগে মেয়ের মায়ের করা মামলায় একদিনেই সব কার্যক্রম শেষ করে রায় দেন শরীয়তপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক আ. ছালাম খান। এ নিয়ে হাইকোর্ট বিস্ময় প্রকাশ করেন। একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা দ্রুত শেষ করায় আদালত বলেন, তার মতো যদি সারা দেশের বিচারকরা কাজ করতেন তাহলে তো নিম্ন আদালতে মামলার জট থাকতো না।
একদিনে মামলায় সাতজন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ, আসামির জবানবন্দি, উভয় পক্ষের আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন এবং পরিশেষে রায় ঘোষণা করেছেন। রায়ে অপহরণের দায়ে আসামি তুষার দাস রাজকে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। অথচ ১১ মাস আগে একই বিচারক আসামিকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে আদেশ দিয়েছিলেন। যে মামলায় একবার অব্যাহতি দিলেন, সেই মামলায় আবার কীভাবে সাজা দিলেন তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন আইনজীবী। একদিনের মধ্যে একটি মামলার বিচার সম্পন্ন করায় হাইকোর্ট বিস্ময় প্রকাশ করেন।
এ সময় আদালত বলেন, একটি নির্দিষ্ট মামলার ব্যাপারে বিচারক সাহেবের এত উৎসাহ কেন? তার কী স্বার্থ? গত ছয় মাসে তার আদালতের পরিসংখ্যান কী তা দেখা দরকার। আদালত বলেন, তার মতো যদি সারা দেশের বিচারকরা কাজ করতেন তাহলে তো নিম্ন আদালতে মামলার জট থাকতো না।
১৪ বছরের সাজাপ্রাপ্ত তুষার দাস রাজকে জামিন দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে নিম্ন আদালতের করা ২০ হাজার টাকা জরিমানার আদেশও স্থগিত করেছেন আদালত। ১ আগস্ট হাইকোর্টের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ জামিন মঞ্জুর করে এ আদেশ দেন।
আদালতে আসামিপক্ষের আইনজীবী ছিলেন শিশির মোহাম্মদ মনির। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সারোয়ার হোসেন বাপ্পী।
শুনানিতে আদালত বলেন, এখানে সমস্যা হলো আসামি দলিত সম্প্রদায়ের আর মেয়ে ব্রাহ্মণ। এখানে উঁচু-নিচু জাতের একটি বিষয় রয়েছে। আদালত বলেন, আমাদের সমাজে তো এরকম প্রথা রয়েছে যে উঁচু-নিচু অসম বিয়ের ঘটনা ঘটলে সমাজচ্যুতির ভয় থাকে।
আইনজীবী বলেন, আসামি দলিত সম্প্রদায়ের না হলে মামলা ও হয়রানির শিকার হতো না। আমাদের আইনে জাত বা বর্ণ বলে কিছু নেই। আইনের চোখে সবাই সমান। সবাই মানুষ হিসেবে বিবেচিত।
এ সময় হাইকোর্ট বলেন, যা বাস্তবতা, তা মানতেই হবে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। এখানে যদি মেয়ের বাবা এ বিয়ে মেনে নেন, তবে যদি তাকে সমাজচ্যুত করা হয়, একঘরে করা হয় তখন কী হবে। সেটাও দেখতে হবে। যদিও আইনে এরকম উঁচু-নিচু বর্ণে বিয়েতে বাধা নেই। একদিকে আইন অপরদিকে বাস্তবতা। সবকিছুই বিবেচনা করতে হবে।
এ সময় মামলার রায় নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে আদালত বলেন, বিচারক (শরীয়তপুরের) তার রায়ে বলেছেন, আসামির বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। তারা স্বেচ্ছায় বিয়ে করেছেন। বাচ্চাও হয়েছে। এটা বলার পর অপহরণের অভিযোগে সাজা দেন কীভাবে? রায়ে যেভাবে বলা হয়েছে, সেখানে তো অপহরণ হতে পারে না। তখন ওই দম্পতির সন্তানের বয়স জানতে চেয়ে আদালত বলেন, বাচ্চার বয়স কত? জবাবে আইনজীবী বলেন, আজ ১ আগস্ট পর্যন্ত ৮৯ দিন।
মামলার বিবরণে জানা যায়, ২০১৭ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে সুষ্মিতা দেবনাথ অদিতি ভালোবাসার টানে দলিত (মেথর) সম্প্রদায়ের ছেলে এইচএসসি পরীক্ষার্থী তুষার দাস রাজকে রাজধানীর ঢাকেশ্বরী মন্দিরে বিয়ে করে ওই বছরের ১৫ অক্টোবর।
এরপর অদিতির মা তুষারের বিরুদ্ধে মেয়েকে অপহরণ ও ধর্ষণের মামলা করেন। পরে পুলিশ ২৬ অক্টোবর দুজনকে গ্রেফতার করে আদালতে হাজির করলে তুষারকে কারাগারে ও অদিতিকে সেফহোমে পাঠানোর আদেশ দেন। একই বছরের ৩০ অক্টোবর অভিযোগ দাখিল করে মামলাটি কিশোর অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। বয়স নির্ধারণ করে মেডিকেল অফিসারের সনদে বলা হয়, অদিতির বয়স ১৮ থেকে ১৯ বছর। যদিও এসএসসি পরীক্ষার নিবন্ধন অনুযায়ী অদিতির বয়স ১৫ বছর। মেডিকেল সনদ পাওয়ার পর আদালত ২০১৮ সালের ২৪ জুন এক আদেশে তুষারকে জামিন ও অদিতিকে নিজ জিম্মায় পাঠায় আদালত। মামলাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়।
সেদিন থেকে শ্বশুর রঞ্জিত দাসের বাড়িতে ওঠে অদিতি। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ২০১৮ সালের ৫ আগস্ট মামলাটি বিচারের জন্য আমলে নেন। কিন্তু মামলার বাদী অদিতির মা পারুল দেবনাথ কিশোর আদালতের ২৪ জুনের আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আবেদন করেন।
হাইকোর্ট ২০১৮ সালের ৭ আগস্ট কিশোর আদালতের আদেশ স্থগিত করেন। অন্যদিকে তুষার হাইকোর্টের ওই আদেশ সংশোধনের জন্য আবেদন করেন। এরপর ২০১৮ সালের ৮ নভেম্বর তুষারকে জামিন এবং অদিতিকে নিজ জিম্মায় থাকার আদেশ দেন হাইকোর্ট।
এরপর একই আদালত (হাইকোর্ট) চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি অদিতির বয়স নির্ধারণ করতে শরীয়তপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালকে নির্দেশ দেন। কিন্তু নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক আ. ছালাম খান বয়স নির্ধারণ না করেই আসামির বিরুদ্ধে গত ১০ এপ্রিল অভিযোগ গঠন করেন।
এরপর গত ২৩ জুলাই একদিনে সাতজন সাক্ষী ও আসামির (তুষার) জবানবন্দি গ্রহণ করেন। সেদিনই দুপক্ষের আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক শেষ করেন। ওই দিনই কিছুক্ষণের মধ্যে তুষারকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড, ২০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ড দিয়ে রায় দেন। এ রায়ের পর তুষারকে কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর থেকে তুষার কারাগারে ছিলেন। এ অবস্থায় সাজার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল ও জামিন আবেদন করা হয়।
এদিকে চলতি বছরের ৩ মে অদিতির কোলজুড়ে আসে এক কন্যাসন্তান। তার নাম রাখা হয়েছে তোর্সা দাস কাব্য। তুষার কারাগারে যাওয়ার পর থেকেই শিশুকে নিয়ে অদিতি হাইকোর্টের বারান্দায় ঘুরতে থাকেন স্বামীর জামিনের জন্য। অবশেষে আজ ভালোবাসার মানুষটিকে জামিন দিয়েছেন হাইকোর্ট। ফলে স্ত্রী অদিতির মুখে ফুটেছে হাসি। যদিও চোখে ছিল পানি। সুখের খবরে চোখের এ পানি বলে জানান অদিতি।
অদিতি বলেন ‘আমি খুব খুশি। ছোট্ট মেয়েটা ওর বাবাকে কাছে পাবে। ভালোবেসে স্বেচ্ছায় তুষারকে বিয়ে করেছি। আমি মনে করি ভালোবাসায় কোনো উঁচু-নিচু বা বর্ণ বিষয় নেই।’
এফএইচ/এএইচ/এমকেএইচ