শিক্ষার্থীদের হয়রানির অভিযোগ নিতে স্কুলে বক্স স্থাপনের পরামর্শ
স্কুল শিক্ষার্থীদের কেউ নির্যাতন বা যৌন হয়রানির শিকার হলে সেই তথ্য অভিযোগ আকারে জমা দিতে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভিযোগ বক্স স্থাপনের পরামর্শ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
বুলিং (ধর্ষণ বা হয়রানি) প্রতিরোধে সরকারের করা খসড়া নীতিমালায় এ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে অভিযোগ বক্স স্থাপন এবং শিক্ষার্থীদের অভিযোগ বক্সে অভিযোগ জমা দেয়ার বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যাপক প্রচারণাও চালাতে বলা হয়েছে। কারণ স্কুলের শিক্ষার্থীরা কম বয়সী বা লজ্জায় অভিভাবক কিংবা শিক্ষকদের কাছে অনেক সময় অভিযোগ করতে চায় না। তাই দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইভটিজিং রোধে অভিযোগ বক্স স্থাপনের পরামর্শ দেন আদালত।
আরও পড়ুন >> অরিত্রীর আত্মহত্যা : দুই শিক্ষকের বিচার শুরু
এ অভিযোগ বক্স খোলার দায়িত্ব থাকবে স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটির। সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষক বা ব্যবস্থাপনা কমিটির কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে বিষয়টি তদন্তের জন্য জেলা প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের কাউকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠনের বিধান নীতিমালায় রাখা যায় কি-না, সে বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ নিতে বলা হয়েছে।
এছাড়া আগামী ২২ অক্টোবরের মধ্যে নীতিমালা চূড়ান্তের অগ্রগতির বিষয়টিও আদালতকে জানাতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্রী অরিত্রি অধিকারীর আত্মহত্যার ঘটনায় হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত কমিটির সুপারিশ করা নীতিমালার খসড়া বুধবার আদালতে উপস্থাপন করা হয়। পরে আদালত এসব পরামর্শ ও নির্দেশনা দেন। যাতে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতা বা কোনো দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়।
আত্মহত্যা প্রতিরোধের বিষয়ে শুনানির নির্ধারিত দিন বুধবার হাইকোর্টের বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এসব পরামর্শ ও নির্দেশনা দেন।
আদালতে এদিন রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার এ বি এম আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ (বাশার)। অন্যদিকে, আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীর পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার অনীক আর হক, ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ও আইনুন্নাহার সিদ্দিকা।
শিশুসহ শিক্ষার্থীদের নির্যাতন ও যৌন হয়রানি রোধে প্রতিটি স্কুলে অভিযোগ বক্স স্থাপনের পরামর্শ দিয়ে হাইকোর্ট বলেন, প্রতিটি স্কুলে শিশুদের হয়রানির অভিযোগ শোনার জন্য একটি অভিযোগ বক্স খুলতে হবে। শিশুরা তাদের নির্যাতনের অভিযোগগুলো মা-বাবা অথবা স্কুলের শিক্ষক বা অন্য কারও কাছে বলতে পারে না। সেক্ষেত্রে স্কুলে একটি অভিযোগ বক্স থাকলে কে বা কারা তাকে হয়রানি করেছে শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে তা অভিযোগ আকারে লিখে ওই বক্সে জমা দিতে পারবে।
আরও পড়ুন >> অরিত্রির মৃত্যু, শুধুই আত্মহত্যা?
ডেপুর্টি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ জানান, আদালত রাষ্ট্রপক্ষকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, দেশের সকল স্কুলে স্কুলে অভিযোগ বক্স স্থাপনের বিষয়টি প্রচারণা করতে। সঙ্গে সঙ্গে তথ্য মন্ত্রণালয়কে এ মামলায় বিবাদী করা যায় কি-না, সে বিষয়টিও দেখার জন্য বলেছেন হাইকোর্ট।
একই সঙ্গে বুলিং (ধর্ষণ বা হয়রানি) প্রতিরোধে যে কমিটি থাকবে সে কমিটির প্রধান যদি স্কুলের প্রধান হন এবং তার বিরুদ্ধেই যদি নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে তাহলে কমিটি তদন্ত করবে কীভাবে? সেজন্য জেলা প্রশাসক পর্যায়ের কোনো কর্মকর্তাকে ওই কমিটিতে সংযুক্ত করা যায় কি-না, সেই বিষয়টি নির্ধারণে আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।
এরপর অরিত্রির মৃত্যুর ঘটনায় বুলিং নিরোধ কমিটির অগ্রগতি এবং শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য বা মনোবল শক্ত রাখার জন্য মনোবিজ্ঞানী নিয়োগ দেয়া যায় কি-না, সেটিও আগামী ২২ অক্টোবরের প্রতিবেদনে তুলে ধরার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
সরকারের করা খসড়া নীতিমালায় বুলিংয়ের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, বিদ্যালয় চলাকালীন বা বিদ্যালয় শুরু হওয়ার আগে বা পরে, শ্রেণিকক্ষে বা বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বা বাইরে কোনো শিক্ষার্থী কর্তৃক (এককভাবে বা দলগতভাবে) অন্য কোনো শিক্ষার্থীকে শারীরিকভাবে আঘাত করা, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করা, অশালীন বা অপমানজনক নামে ডাকা, অসৌজন্যমূলক আচরণ করা, কোনো বিশেষ শব্দ বারবার ব্যবহার করে উত্ত্যক্ত বা বিরক্ত করাকে স্কুল বুলিং হিসেবে গণ্য হবে।
নীতিমালায় তিন ধরনের বুলিংয়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে কাউকে কোনো কিছু দিয়ে আঘাত, চড়-থাপ্পড় দেয়া, লাথি ও ধাক্কা মারা, থুথু নিক্ষেপ, জিনিসপত্র জোর করে নিয়ে যাওয়া বা ভেঙে ফেলা এবং অসৌজন্যমূলক আচরণ শারীরিক বুলিংয়ের পর্যায়ে পড়বে।
উপহাস করা, খারাপ নামে সম্বোধন বা অশালীন শব্দ ব্যবহার ও হুমকি মৌখিক বুলিং হিসেবে চিহ্নিত হবে।
এছাড়া সামাজিক স্ট্যাটাস, ধর্মীয় পরিচিতি বা বংশগত অহংবোধ থেকে কোনো শিক্ষার্থীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন, কারও সম্পর্কে গুজব ছড়ানো এবং প্রকাশ্যে অপমান করা হলে তা সামাজিক বুলিং হিসেবে গণ্য হবে।
নীতিমালায় এক শিক্ষার্থী কর্তৃক আরেক শিক্ষার্থীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে আঘাত করা এবং অসৌজন্যমূলক আচরণ রোধে অভিযুক্ত শিক্ষার্থীকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কারের বিধান রাখা হয়েছে।
আরও পড়ুন >> শিক্ষার্থীদের কাউন্সিলিং নীতিমালা গঠনে কমিটি
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে করা খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, সরকারি/বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায়ই স্কুল বুলিং (শিক্ষার্থী কর্তৃক শিক্ষার্থীকে নির্যাতন করা/ভয় দেখানো) এর প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বুলিংয়ের শিকার শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে আসতে চায় না।
এতে ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়, বিদ্যালয়ের পরিবেশ নষ্ট হয়। যদিও স্কুল বুলিং সাধারণত ফৌজদারি অপরাধের পর্যায়ে পড়ে না।
তবে, এমন কিছু ঘটতে পারে বলে মনে হলে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে পূর্ব থেকে পুলিশের সাহায্য নেয়ার কথা নীতিমালায় বলা হয়েছে। এছাড়া বিদ্যালয়ে কোনো প্রকার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা যাবে না। যাতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে দল/উপদলের সৃষ্টি হয়। বুলিং ও ভিকটিম উভয়কে অত্যন্ত যত্নসহকারে কাউন্সেলিং করতে হবে। যাতে তাদের আচরণে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়।
বুলিং প্রতিরোধে বুলিংকারী শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে স্কুল কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ নিলে অভিভাবকরা বিরোধিতা না করে সহযোগিতা করবে। সন্তানকে স্কুলের নিয়মকানুন মেনে চলা ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সুন্দর আচরণের জন্য উদ্বুদ্ধ করবে। এছাড়া, বুলিংয়ের ব্যাপারে স্কুল কর্তৃপক্ষের জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ, মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার, সচেতনতা সৃষ্টিতে নাটক মঞ্চস্থ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে নিরুৎসাহিত, স্কুলে আইসিটি ডিভাইস আনা নিষিদ্ধের কথাও নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।
ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ছাত্রী অরিত্রির আত্মহত্যার ঘটনায় হাইকোর্ট ২০১৮ সালের ৪ ডিসেম্বর স্বপ্রণোদিত হয়ে আত্মহত্যা রোধে একটি জাতীয় নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা দেন। আদালত অন্তর্বর্তী আদেশের পাশাপাশি রুলও জারি করেন। রুলে অরিত্রির মতো যেন আর কোনো শিক্ষার্থী আত্মহত্যার ঘটনা না ঘটনায়, তার উপায় খুঁজে জাতীয় নীতিমালা করার নির্দেশ কেন দেয়া হবে না তা জানতে চাওয়া হয়। সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়।
এরপর সরকারের সংশ্লিষ্টরা কমিটি গঠন করে একটি খসড়া নীতিমালা তৈরির পর হাইকোর্টে দাখিল করে।
এফএইচ/এসআর/এমএআর/পিআর