মুক্তিযোদ্ধাদের বয়সের ফ্রেমে বাঁধা যায় না : হাইকোর্ট

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৩:৪২ পিএম, ১৯ মে ২০১৯

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স নির্ধারণীর বিষয়ে হাইকোর্ট বলেছেন, ‘শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর কোথাও মুক্তিযোদ্ধাদের বয়সের ফ্রেমে বাঁধা যায় না।’

পৃথক পৃথক ১৫টি রিটের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে রায় ঘোষণার সময় রোববার হাইকোর্টের বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এমন পর্যবেক্ষণ দেন।

আদালতে রিটের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন ব্যারিস্টার ওমর সাদাত ও এ বি এম আলতাফ হোসেন। তাদের সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী এ আর এম কামরুজ্জামান কাকন ও শুভ্রজিৎ ব্যানার্জি। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোখলেছুর রহমান।

এর আগে ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স ন্যূনতম ১২ বছর ৬ মাস নির্ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে জারি করা সংশোধিত পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট।

একই সঙ্গে ২০১৪ এবং ২০১৬ সালের গেজেট ও পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করেন আদালত। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোখলেসুর রহমান জাগো নিউজকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

রায় ঘোষণাকালে আদালত পর্যবেক্ষণে বলেন, ‘শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর কোথাও মুক্তিযোদ্ধাদের বয়সের ফ্রেমে বাঁধা যায় না। মুক্তিযুদ্ধ মূলত মানুষ আবেগের তাড়না থেকে করে। দেশের প্রতি ভালোবাসার কারণে করে। বয়স দিয়ে কখনও ভালোবাসা বাঁধা যায় না।’

আদালত আরও বলেন, ‘প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সাত-আট বছর বয়সী মুক্তিযোদ্ধা ছিল। বাংলাদেশে তো শিশু মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বইও আছে। এটা নতুন কোনো ঘটনা নয়। গত ৪৫ বছর ধরে তারা (রিটকারীরা) সব সুবিধা পেয়ে আসছে। হঠাৎ করে তারা জানলেন তারা আর মুক্তিযোদ্ধা নেই। তাই যে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর ভিত্তি করে দেশ স্বাধীন হয়েছে, সেই মুক্তিযোদ্ধাদের যদি অস্বীকার করি তাহলে আমরা আর সামনে এগুতে পারব না।’

পরে রিটকারীদের অন্যতম আইনজীবী ওমর সাদাত বলেন, ‘পরিপত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যূনতম বয়স নির্ধারণ করা হয়েছিল, যার ধারাবাহিকতায় অনেক মুক্তিযোদ্ধার ভাতা আটকে যায়। কিন্তু আদালত আজ তাদের (১৫ জন রিটকারীর) সেই বকেয়া ভাতা পরিশোধের নির্দেশ দিয়েছেন। একইসঙ্গে আজকের এ রায়টি গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে যে, দিনে দিনে মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞা পরিবর্তন করতে থাকলে এমন একদিন আসবে যেদিন মুক্তিযোদ্ধারা হয়ে যাবেন রাজাকার আর রাজাকাররা হয়ে যাবেন মুক্তিযোদ্ধা। তাই আদালত বলেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞা পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নেই, এটি একেবারেই অপরিবর্তনীয়।’

আদালত আরও বলেছেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে সংজ্ঞা দেয়ার কিছু নেই। এটি ঐতিহাসিক সাক্ষির ভিত্তিতে কে মুক্তিযোদ্ধা আর কে মুক্তিযোদ্ধা না তা নির্ধারণ হবে। মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযোদ্ধাই। এখানে তর্কের কোনো অবকাশ নেই।’

২০১৬ সালে প্রথম প্রকাশিত এক গেজেটে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধার ন্যূনতম বয়স হতে হবে ১৩ বছর। এরপর চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি এক পরিপত্রের মাধ্যমে ওই গেজেটটি সংশোধন করে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যূনতম বয়স হতে হবে ১২ বছর ৬ মাস। পরে মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স নিয়ে জারি করা ওই পরিপত্রের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করেন বাংলাদেশ ভূতাত্বিক জরিপ অধিদফতরের পরিচালক মাহমুদ হাসানসহ আরও ১৬ মুক্তিযোদ্ধা।

রিটকারীদের মধ্যে বাংলাদেশ ভূতাত্বিক জরিপ অধিদফতরের পরিচালক মাহমুদ হাসান ১৯৮৮ সালের ২৬ জুন মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ভূতাত্বিক জরিপ অধিদফতরে চাকরিতে যোগ দেন। তার জন্ম তারিখ অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর তার বয়স হয় ১২ বছর ৪ মাস ১২ দিন। এর পরিপ্রেক্ষিতেই ভূতাত্বিক জরিপ অধিদফতর গত ২ মার্চ এক অফিস আদেশে রিটকারীকে (হাসান মাহমুদ) বলে, ১৭ জুলাই তার বয়স ৫৯ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। সরকারি বিধি অনুযায়ী ১৮ জুলাই থেকে তার অবসরোত্তর ছুটি (পিআরএল) শুরু হবে। এ অবস্থায় তিনি ছুটি ভোগ করতে চাইলে অধিদফতর থেকে তাকে আবেদনও করতে বলা হয়।

এরপর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের এক অফিস আদেশে জানানো হয়, গত ১৭ জানুয়ারি মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যূনতম বয়স ১২ বছর ৬ মাস নির্ধারণ করে যে সংশোধিত পরিপত্র জারি করে, তার সঙ্গে রিটকারীর বয়স সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

পাবলিক সার্ভিস রিটায়ারমেন্ট অ্যাক্ট, ১৯৭৪ অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রিটকারী মাহমুদ হাসান ৬০ বছর পর্যন্ত চাকরির সুযোগ পাওয়ার কথা। ফলে রিটকারীদের প্রতি যে অফিস আদেশ দেয়া হয়েছে তা স্পষ্টতই এ আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করেন তার আইনজীবী।

এফএইচ/এনডিএস/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।