অসহায় বিচারপ্রার্থীদের আইনি সেবায় আইনমন্ত্রীর গুরুত্বারোপ
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, অসহায় বিচারপ্রার্থীদের যত দ্রুত আইনি সেবা দেয়া যাবে তত বেশি তারা আইন সহায়তার সুফল পাবেন। সরকারি আইন সহায়তা কার্যক্রম সত্যিকারভাবে কার্যকর করার ক্ষেত্রে প্যানেল আইনজীবীদের আরও বেশি সংবেদনশীল হতে হবে।
রোববার (৫ মে) সন্ধ্যায় সুপ্রিম কোর্ট মিলনায়তনে ‘উচ্চ আদালতে সরকারি আইনি সেবা : চলমান প্রক্রিয়া ও প্রত্যাশা’ শীর্ষক এক আলোচনা অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় তিনি এ কথা বলেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন উপস্থিত ছিলেন।
মন্ত্রী বলেন, সরকারি আইন সহায়তা কার্যক্রম সত্যিকারভাবে কার্যকর করার ক্ষেত্রে প্যানেল আইনজীবীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাই দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তাদের আরও বেশি সংবেদনশীল হতে হবে। ক্লায়েন্টের প্রতি তাদের আচরণ হতে হবে মার্জিত বা সহনশীল। আশা রাখবো, সরকারি স্টিকার সম্বলিত মামলাসমূহ দায়ের থেকে নিষ্পত্তি পর্যন্ত জড়িত সকল পক্ষ সর্বোচ্চ মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে নিষ্পত্তির চেষ্টা করবেন, যাতে করে অসহায় মানুষজন অযথা হয়রানির শিকার না হয়।
তিনি বলেন, জার্মান সরকারের উন্নয়ন সংস্থা- জিআইজেড এর সাম্প্রতিক এক নিরীক্ষার তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশের ৮৭ ভাগ মানুষ স্থানীয় পর্যায়ে বিরোধ নিষ্পত্তিতে আগ্রহী এবং শতকরা ৩০ ভাগ নাগরিকের প্রাথমিক দ্বন্দ্বের কারণ প্রতিবেশীর সাথে ছোট-খাটো বিরোধ বা মারামারি, যা স্থানীয়ভাবেই নিষ্পত্তিযোগ্য। সুতরাং, আমাদের আইনি সেবার পরিকল্পনা করার সময় সাধারণ বিরোধের ধরন এবং সেই ধরন অনুযায়ী উপযুক্ত সমাধান কী হতে পারে তা খুঁজে দেখতে হবে; বিরোধ যদি ছোট হয় তাহলে তার সমাধানের আইনি প্রক্রিয়াকেও স্বল্পমূল্যের, সহজতর এবং দ্রুততর হতে হবে; বিচার ব্যবস্থাকে স্থানীয় পর্যায়ে অর্থাৎ বিরোধের উৎসমূলে নিয়ে যেতে হবে।
আর তা করতে হলে ইউনিয়ন লিগ্যাল এইড কমিটিসহ স্থানীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের সক্ষমতা বৃদ্ধি করে তাদেরকে আরও কার্যকর করতে হবে। পাশাপাশি, আইনগত সহায়তার বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধিসহ স্ব-প্রণোদিত, দ্রুত ও কার্যকর আইনি সেবা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে অংশীদারিত্ব বৃদ্ধির বিষয়টিও গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা প্রয়োজন।
আইনমন্ত্রী আরও বলেন, আইন সহায়তার বিষয়টি নিয়েও নতুন করে ভাববার আছে এবং এ বিষয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের সময় এসেছে। এখন পর্যন্ত আইনি সেবা বলতে আমরা আদালতে মামলা পরিচালনার জন্য আর্থিক সহায়তাকেই বুঝি। আইনি বিষয়ে তথ্য প্রদান, পরামর্শ ও মীমাংসাও কিন্তু কার্যকর আইন সহায়তা।
তিনি মনে করেন, কিছু কিছু বিষয়ে আইন সহায়তা প্রদানকালে পুঁথিগত আইন প্রয়োগের দৃষ্টির পাশাপাশি সামাজিক ও মানবিক দৃষ্টিকোণকেও স্থান দেওয়া উচিত। যেমন- আপষযোগ্য মামলা আদালতের বাইরে এবং মাদকের মামলায় মাদকাসক্তদের কারাগারে না পাঠিয়ে সমাজে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য পুনর্বাসনের ব্যাপারটা ভেবে দেখা উচিত।
মন্ত্রী বলেন, আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল যে কেউ আইনগত সহায়তা পাবেন, এটাই স্বাভাবিক। আইনগত সহায়তা পাওয়া তার প্রতি করুণা নয় বরং এটা তার আইনগত অধিকার। কারণ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের মূল সংবিধানেই গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সামাজিক সুবিচার ও সমতা- এই চার মূলনীতিসহ বিচার প্রক্রিয়ায় ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকল নাগরিকের প্রবেশাধিকারের বিধান সন্নিবেশ করে গেছেন।
মন্ত্রী আরও বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর দীর্ঘ ২১ বছর আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল মানুষগুলোর এই আইনগত সহায়তা পাওয়ার অধিকারের প্রতি কেউ দৃষ্টি দেয়নি। তাদের এই অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরি ও তার দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসতে হয়েছে। ধন্যবাদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। তিনি প্রথমবার সরকার গঠন করেই ২০০০ সালে ‘আইনগত সহায়তা প্রদান আইন’ প্রণয়ন করেন। কিন্তু ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে সাত বছর আওয়ামী লীগ সরকারে না থাকায় এই আইনের বাস্তবায়ন কার্যক্রম থমকে দাঁড়ায়।
২০০৯ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে আইনি সেবাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে তৃণমূল পর্যায়ে বিস্তৃত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকায় ‘জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার’ প্রধান কার্যালয় স্থাপন করেন। এরপর প্রাতিষ্ঠানিক আইনি কাঠামোয় দরিদ্র ও অসহায় মানুষের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে এ সংস্থার অধীনে প্রত্যেক জেলায় ‘জেলা লিগ্যাল এইড অফিস’ স্থাপন করে ৬৪টি লিগ্যাল এইড অফিসারের পদ সৃষ্টি করা হয়।
তিনি বলেন, বর্তমানে এসব অফিসে একজন করে সিনিয়র সহকারী জজ/সহকারী জজকে পূর্ণকালীন লিগাল এইড অফিসার হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে। দরিদ্র ও সুবিধা বঞ্চিত শ্রমিকদের আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রাম শ্রম আদালতে শ্রমিক আইন সহায়তা সেল চালু করা হয়েছে। সরকারি আইনি সেবা প্রদান আরও বিস্তৃত ও সহজ করার লক্ষ্যে ২০১৬ সালে NLASO -এর প্রধান কার্যালয়ে টোল ফ্রি জাতীয় হেল্পলাইন ১৬৪৩০ চালু করা হয়েছে।
এফএইচ/আরএস/জেআইএম