নিরপরাধ ব্যক্তি কারাগারে, দুদক মহাপরিচালককে হাইকোর্টের তলব
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় নিরপরাধ (ভুল আসামি) ব্যক্তিকে গ্রেফতার করার পর কারাগারে থাকার কারণ জানাতে দুদকের মহারিচালকসহ (আইন) চারজনকে তলব করেছেন হাইকোর্ট। দুদকের মহাপরিচালক (আইন) মইনুল ইসলাম ছাড়া অন্যান্যদের মধ্যে রয়েছেন দুদকের মামলার বাদী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল জাহিদ, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়রে সচিবের একজন প্রতিনিধি ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিবের মনোনীত প্রতিনিধি।
আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি তাদেরকে আদালতে সশরীরে উপস্থিত হয়ে নিরপরাধ ব্যক্তিকে গ্রেফতারের কারণ ব্যাখ্যা করতে বলা হয়েছে। আদেশের বিষয়টি জাগো নিউজকে নিশ্চিত করেছেন আইনজীবী অমিত দাশ গুপ্ত।
সঙ্গে সঙ্গে রুলও জারি করেছেন হাইকোর্ট। রুলে কারাগারে থাকা ‘ভুল’ আসামি জাহালমকে কেন অব্যাহতি দেওয়া হবে না এবং তাকে মুক্তি দিতে কেন ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে।
আগামী চার সপ্তাহের মধ্যে স্বরাষ্ট্র সচিব, আইন সচিব, দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষে চেয়ারম্যান, দুদকের মহাপরিচালক (আইন), মামলার বাদী দুদক পরিচালক আব্দুল্লাহ আল জাহিদ, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান, আইজি-প্রিজন ও সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন আদালতে উপস্থাপন করার পর সোমবার হইকোর্টের বিচারপতি এফআরএম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কেএম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ স্বপ্রণোদিত হয়ে এই আদেশ দেন।
জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত ‘৩৩ মামলায় ‘ভুল’ আসামি জেলে : ‘স্যার, আমি জাহালম, সালেক না’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনটি আদালতের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট অমিত দাসগুপ্ত। অন্যদিকে শুনানির সময় রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জেনারেল এবিএম আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার।
ডেপুর্টি অ্যাটর্নি জেনারেল জেনারেল এবিএম আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার সাংবাদিকদের জানান, টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় গ্রেফতার পাটকল শ্রমিক জাহালমের আটকাদেশ কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।
একই সঙ্গে জাহালমের গ্রেফতারের ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে দুদক চেয়ারম্যানের প্রতিনিধি, মামলার বাদী দুদক কর্মকর্তা, স্বরাষ্ট্র সচিবের প্রতিনিধি ও আইন সচিবের প্রতিনিধিকে আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টায় সশরীরে আদালতে হাজির থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বঃপ্রণোদিত হয়ে এই আদেশ দেন।
আইনজীবী অমিত দাশ গুপ্ত আরও বলেন, প্রকৃত আসামিকে খুঁজে বের না করে কেন নিরীহ শ্রমিক জাহালমকে গ্রেফতার করা হয়েছে? এ ঘটনার ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য দুদকের মহাপরিচালক (আইন), দুদকের দায়ের করা মামলার বাদী, স্বরাষ্ট্র সচিবের প্রতিনিধি এবং আইন সচিবের প্রতিনিধিকে আদালতে হাজির থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
অমিত দাশ গুপ্ত আরো জানান, জাহালমের আটকাদেশ কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, এই রুলের জবাব দেওয়ার জন্য দুদক চেয়ারম্যানের প্রতিনিধি, স্বরাষ্ট্রসচিব, আইনসচিব, মামলার বাদী, সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আবু সালেকের বিরুদ্ধে সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির ৩৩টি মামলা হয়েছে। কিন্তু আবু সালেকের বদলে জেল খাটছেন, আদালতে হাজিরা দিয়ে চলেছেন এই জাহালম।
জাহালমের কারাবাসের তিন বছর পূর্ণ হবে আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি। দুদক এখন বলছে, জাহালম নিরপরাধ প্রমাণিত হয়েছেন। তদন্ত করে একই মত দিয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও। তাই একটি মামলায় তার জামিন হয়েছে। আরও ৩২টি মামলায় জামিন পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন তিনি।
সোমবার দেশের শীর্ষ স্থানীয় একটি দৈনিকে সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির ৩৩টি মামলায় নিরপরাধ পাটকল শ্রমিক জাহালমের জেলখাটা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, আবু সালেকের (মূল অপরাধী) বিরুদ্ধে সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির ৩৩টি মামলা হয়েছে। কিন্তু আবু সালেকের বদলে জেল খাটছেন, আদালতে হাজিরা দিয়ে চলেছেন জাহালম। তিনি পেশায় পাটকল শ্রমিক।
জাহালমের কারাবাসের তিন বছর পূর্ণ হবে আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি। দুদক এখন বলছে, জাহালম নিরপরাধ প্রমাণিত হয়েছেন। তদন্ত করে একই মত দিয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও। ফলে একটি মামলায় তার জামিন হয়েছে। আরও ৩২টি মামলায় জামিন পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন তিনি।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি চিঠির মাধ্যমে জাহালমের ঝামেলা শুরু। জাহালমের বাড়ি টাঙ্গাইলের ঠিকানায় দুদকের একটি চিঠি যায়। সেই চিঠিতে ২০১৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে নয়টায় জাহালমকে হাজির হতে বলে দুদক। জাহালম তখন নরসিংদীর ঘোড়াশালের বাংলাদেশ জুট মিলে শ্রমিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
দুদকের চিঠিতে বলা হয়, ভুয়া ভাউচার তৈরি করে সোনালী ব্যাংকের ১৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত আবু সালেক নামের এক লোক, যার সোনালী ব্যাংক ক্যান্টনমেন্ট শাখায় হিসাব রয়েছে। আবু সালেকের ১০টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ভুয়া ঠিকানাগুলোর একটিতেও জাহালমের গ্রামের বাড়ির কথা নেই। রয়েছে পাশের আরেকটি গ্রামের একটি ভুয়া ঠিকানা। কিন্তু সেটাই কাল হয়ে দাঁড়ালো জাহালমের জীবনে।
নির্ধারিত দিনে দুই ভাই হাজির হন দুদকের ঢাকার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। জাহালম বুকে হাত দিয়ে বলেছিলেন, ‘স্যার, আমি জাহালম। আবু সালেক না। আমি নির্দোষ।’
দুদকে হাজিরা দিয়ে জাহালম সোজা চলে যান নরসিংদীর জুট মিলের কর্মস্থলে। এর দুই বছর পর টাঙ্গাইলের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে জাহালমের খোঁজ করতে থাকে পুলিশ। সেখান না পেয়ে ২০১৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি নরসিংদীর ঘোড়াশালের মিল থেকে জাহালমকে আটক করা হয়।
জাহালম তখন জানতে পারেন, তার নামে দুদক ৩৩টি মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছে। তার বিরুদ্ধে সোনালী ব্যাংকের ১৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে, তিনি বড়মাপের অপরাধী। পুলিশের কাছেও জাহালম একই কথা বলেন, ‘স্যার, আমি জাহালম। আবু সালেক না। আমি নির্দোষ।’ তবে তখন কেউ শোনেনি তার এই আকুতি। তার ঠাঁই হয় কারাগারে।
কারাগারে কেটে যায় আরও দুটি বছর। জাহালমকে যতবার আদালতে হাজির করা হয়, ততবারই তিনি বলেন, ‘আমি জাহালম। আমার বাবার নাম ইউসুফ আলী। মা মনোয়ারা বেগম। বাড়ি ধুবড়িয়া গ্রাম, সাকিন নাগরপুর ইউনিয়ন, জেলা টাঙ্গাইল। আমি আবু সালেক না।’
তার ভাই শাহানূর দিনের পর দিন আদালতের বারান্দায় ঘুরতে থাকেন। হাজতখানার পুলিশ থেকে শুরু করে আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যাকে পান, তাকেই বলতে থাকেন, ‘আমার ভাই নির্দোষ।’ অথচ ব্যাংক, দুদক, পুলিশ ও আদালত-সবার কাছেই জাহালম হলেন ‘আবু সালেক’ নামের ধুরন্ধর ব্যাংক জালিয়াতিকারী।
এই চারটি পক্ষের ভুলেই হারিয়ে গেছে তার জীবনের তিনটি বছর। জাহালমের স্ত্রী থাকেন নরসিংদীতে। তিনিও সেখানকার একটি কারখানার শ্রমিক। বৃদ্ধা মা থাকেন গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের নাগরপুরের ধুবড়িয়া গ্রামে। ছেলে আর টাকা পাঠাতে পারেন না। তাই মনোয়ারা বেগম প্রতিদিন অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাতে বাধ্য হচ্ছেন।
এফএইচ/এমএএস/এসআর/এমকেএইচ