জামায়াতের বিচারে বাধাটা কোথায়?

মুহাম্মদ ফজলুল হক
মুহাম্মদ ফজলুল হক মুহাম্মদ ফজলুল হক , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:৩২ পিএম, ০১ জানুয়ারি ২০১৯

মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে শীর্ষ নেতাদের দণ্ড কার্যকর হওয়ার পর সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামের কার্যক্রম নেই বললেই চলে। প্রথমে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে দেয়া রায়ে ‘ক্রিমিনাল সংগঠন’ হিসেবে স্বীকৃতি পায় দলটি। এরপর দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জামায়াতের নির্বাচনী প্রতীক দাঁড়িপাল্লাও বাতিল হয়। পরে উচ্চ আদালতের রায়ের আলোকে নির্বাচন কমিশন (ইসি) থেকে নিবন্ধন হারায় দলটি। এখন সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচারের জন্য আলোচনা শুরু হয়েছে।

সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচার গত পাঁচ বছরে শুরু না করায় হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের পক্ষ থেকে। সংস্থার প্রধান জানান, দলটির নিবন্ধন বাতিল করে দিয়ে ইসি (নির্বাচন কমিশন) তার কাজ সম্পন্ন করেছে। এখন দল হিসেবে তাদের বিচারে বাধাটা কোথায়? যা-ই হোক বিষয়টি আপনাদের (সাংবাদিকদের) ওপর ছেড়ে দিলাম। আপনারা অনুসন্ধান করে বের করেন, কেন বিচার হচ্ছে না?’

মঙ্গলবার দুপুরে ধানমন্ডির তদন্ত সংস্থার প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে আব্দুল হান্নান খান ও এম সানাউল হক তাদের হতাশার কথা ব্যক্ত করেন।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আব্দুল (এমএ) হান্নান খান বলেন, ২০১৪ সালে জামায়াতের তদন্ত শেষ হলেও এখন পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধের দায়ে দলটির বিচার শুরু না হওয়ায় আমরা মর্মাহত। আমরা দ্রুত এর ফয়সালা চাই।

সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে, এর (জামায়াতে ইসলামীর বিচার) ফয়সালাটা হওয়া উচিত। কারণ, অলরেডি তার (জামায়াত) নিবন্ধন নেই। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে, পর্যবেক্ষণও এসেছে। প্রতিটা জাজমেন্টে এসেছে জামায়াত ক্রিমিনাল অরগানাইজেশন। এটার সুরাহা হওয়া উচিত বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি।’

জামায়াতের বিচার কেন হচ্ছে না- তা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে হান্নান খান বলেন, ‘বিচার কেন হচ্ছে না- এটা আমারও প্রশ্ন। এ বিষয়ে প্রসিকিউশনকে জিজ্ঞাসা করেন আপনারা। বিষয়টি এতই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় ছিল যে, আমরা দ্রুততার সঙ্গে অর্থাৎ ২০১৪ সালের ২৭ মার্চ এর তদন্ত সম্পন্ন করি, তাও প্রায় পাঁচ বছর হতে চললো।’

‘ইসি (নির্বাচন কমিশন) অলরেডি কাজ করে দিয়েছে, নিবন্ধন বাতিল করে দিয়ে। তাহলে দল হিসেবে বিচারের জন্য এখন বাধাটা কোথায়? আমরা সকলেই চাই, কিন্তু কেন হচ্ছে না আমার জানা নেই। যা-ই হোক আমরা আপনাদের (সাংবাদিকদের) ওপর বিষয়টি ছেড়ে দিলাম, আপনারা অনুসন্ধান করে বের করেন, কেন হচ্ছে না?’

প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালের ১ আগস্ট বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেন, বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সুপ্রিম কোর্টের অ্যানেক্স ২৪ নম্বর বিচারকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণার রায় দেন।

২০১৩ সালের ২ নভেম্বর হাইকোর্টের তিন বিচারপতির বৃহত্তর বেঞ্চ জামায়াতে ইসলমীর নিবন্ধন বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করে। ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর দলটির নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণার বিরুদ্ধে নিয়মিত আপিল করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় আপিল করেন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ। তার পক্ষে অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড সৈয়দ মাহবুবুর রহমান এটি সংশ্লিষ্ট শাখায় জমা দেন।

নিবন্ধন বাতিলের রায়ে বলা হয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে রুল নিষ্পত্তি করা হলো। জামায়াতে ইসলামীকে দেয়া নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন অবৈধ। এটার (নিবন্ধন) কোনো আইনগত ভিত্তি নেই।

রায় ঘোষণার পরপরই সংবিধানের ১০৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সার্টিফিকেট দেন হাইকোর্ট।

২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করেন নির্বাচন কমিশন (ইসি)। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২–এর আওতায় রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর জামায়াতে ইসলামীকে নিবন্ধন দেয়া হয়েছিল। দলটির নিবন্ধন নম্বর ছিল ১৪। ২০০৯ সালে হাইকোর্টে দায়ের করা ৬৩০ নম্বর রিট পিটিশনের রায়ে আদালত জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করায় গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০ এইচ ধারা অনুযায়ী দলটির নিবন্ধন বাতিল করা হলো।

এদিকে, ২০১৬ সালের ১৩ ডিসেম্বর দাঁড়িপাল্লা সুপ্রিম কোর্টের মনোগ্রাম হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় তা রাজনৈতিক দলের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার না করতে সর্বোচ্চ আদালতের ফুল কোর্টের সভায় সিদ্ধান্ত হয়। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার সভাপতিত্বে আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিদের উপস্থিতিতে ফুল কোর্ট সভায় ওই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

জামায়াতের নিবন্ধন ও প্রতীক বাতিল হওয়ার পরও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন দলটির ২৫ প্রার্থী। তাদের মধ্যে ২২ জন বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে এবং বাকি তিনজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটযুদ্ধে নামেন।

নিষিদ্ধ সংগঠন জামায়াতের কোনো প্রার্থী যাতে নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন সেজন্য রিট দায়ের করা হয়। আদালত তিন কার্যদিবসের মধ্যে রিট নিষ্পত্তির দায়িত্ব দেন নির্বাচন কমিশনকে। নির্বাচন কমিশন বৈঠক শেষে তাদের নির্বাচন করার অনুমতি দেন। যদিও দলটির প্রার্থীরা নির্বাচনে খুব বেশি ভোট পাননি।

এফএইচ/এমএআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।