মানবতাবিরোধী অপরাধ : লিয়াকত-আমিনুলের ফাঁসি
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় পলাতক সাবেক মুসলিম লীগ নেতা হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার মো. লিয়াকত আলী (৬১) ও কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম উপজেলার আমিনুল ইসলাম (৬২) ওরফে রজব আলীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।
মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা সাতটি অভিযোগই প্রমাণিত হয়েছে। তাই সাতটি অভিযোগেই তাদেরকে ফাঁসি আদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।
সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ রায় ঘোষণা করেন। ট্রাইব্যুনালের অন্য বিচাপতিরা হলেন- বিচারপতি আমির হোসেন ও সদ্য বিচারপতি মো. আবু আহমেদ জমাদার।
রায় ঘোষণার সময় আদালতে আজ রাষ্ট্রপক্ষে এ মামলার প্রসিকিউটর ছিলেন রানা দাশগুপ্ত ও রেজিয়া সুলতানা চমন। পলাতক দুই আসামির পক্ষে রাষ্ট্র নিয়োজিত আইনজীবী ছিলেন গাজী এমএইচ তামিম।
রায়ে ফাঁসির আদেশের পাশাপাশি পলাতক এই দুই আসামিকে গ্রেফতার জন্য পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি)-কে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে।
দণ্ডিত দুই আসামির মধ্যে হবিগঞ্জের লাখাই থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মো. লিয়াকত আলী একাত্তরে স্থানীয় রাজাকার কামান্ডার ছিলেন। আর কিশোরগঞ্জের আমিনুল ইসলাম ছিলেন ওই এলাকার অল-বদর বাহিনীর নেতা।
সকালে ১০টা ৫০ মিনিটে রায় ঘোষণার কার্যক্রম শুরু হয়। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম শুরুতেই জানিয়ে দেন -এটি ট্রাইব্যুনালের ৩৫তম রায়। পরে ৩১২ পৃষ্ঠার রায়ের সার সংক্ষেপের প্রথম অংশ পড়া শুরু করেন ট্রাইব্যুনালের বিচারক আবু আহমেদ জমাদার। বিচারপতি আমির হোসেন পড়েন রায়ের দ্বিতীয় অংশ। সর্বশেষে বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম সাজা ঘোষণা করেন।
মামলার অভিযোগপত্রের তথ্যানুযায়ী, লিয়াকত একাত্তরে ছিলেন মুসলিম লীগের কর্মী। আর আমিনুল ইসলাম ওরফে রজব আলী ওই সময়ে ছাত্র সংঘের সদস্য ছিলেন।
লিয়াকত আলী ২০০৩ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। সভাপতি থাকা অবস্থাতেই যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ২০১০ সালে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়।
রায়ের পর প্রসিকিউটর রানাদাস গুপ্ত সাংবাদিকদের বলেন, একাত্তরে হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন এলাকায় হত্যা, গণহত্যার মত মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত থাকার দায়ে পলাতক দুই আসামির মৃত্যুদণ্ডের রায় এসেছে আদালতে। রায়ে দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগিতায় তারা বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটান তা উঠে এসেছে।
রায়ে বলা হয়, আসামিদের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা সাতটি অভিযোগই প্রমাণিত হয়েছে। মৃত্যু পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তাদের সাজা কার্যকর করার নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।
এই রায়ের এক মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করার সুযোগ পাবেন আসামিরা। তবে সে জন্য তাদের আত্মসমর্পণ করতে হবে।
গত ১৬ আগস্ট এ মামলার শুনানি শেষ করে যেকোনো দিন রায় ঘোষণা করা হবে মর্মে সিএভি (অপেক্ষমাণ) রাখেন আদালত। মামলার তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ১৮ মে এ দু’জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। সেই থেকে তারা পলাতক রয়েছেন।
বর্তমানে লাখাই উপজেলার এক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মুসলিম লীগের সাবেক সভাপতি মো. লিয়াকত আলী। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তারা দু’জনে পাশাপাশি তিন জেলার (হবিগঞ্জ জেলার লাখাই, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর ও কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামে) বিভিন্ন এলাকায় অপরাধ করেছেন। মামলায় দুইজনের বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, আটক, অপহরণ, নির্যাতন ও লুটপাটের ৭ অপরাধের অভিযোগ আনা হয়।
মামলায় তাদের বিরুদ্ধে সাত অভিযোগ
প্রথম
৯৭১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ভোর ৫টা থেকে বেলা পৌনে দুইটা পর্যন্ত লিয়াকত আলী, আমিনুল ইসলাম ও তার সঙ্গীরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীদের সঙ্গে নিয়ে লাখাই থানার কষ্ণপুর গ্রামে অভিযান চালিয়ে গণহত্যা ও লুটপাট করে। নুপেন রায়ের বাড়িতে রাধিকা মোহন রায় ও সুনীল শর্মাসহ ১৫ জন জ্ঞাত ও ২৮ জন অজ্ঞাত হিন্দুকে গুলি করে হত্যা করে।
দ্বিতীয়
১৯৭১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর দুপুর ২টা থেকে পৌনে ৩টা পর্যন্ত লিয়াকত আলী, আমিনুল ইসলাম ও তার সঙ্গীরা পাকিস্তানিদের সঙ্গে নিয়ে চন্ডিপুর গ্রামে চন্দ্র কুমার ও জয়কুমারসহ ৯ জন হিন্দুকে গুলি করে হত্যা করে এবং গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে লুটপাট চালায়।
তৃতীয়
১৯৭১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর বিকেল ৩টার দিকে লাখাই থানার গদাইনগর গ্রামে লিয়াকত আলী, আমিনুল ইসলাম ও পাকিস্তানি আর্মি কর্তৃক চিত্ত রঞ্জন দাসের বাড়ির বাইরের আঙ্গিণায় জগদ্বীশ দাস, পিয়ারি দাস ও মহাদেবমাসসহ ২৬ জ্ঞাত-অজ্ঞাত আরও ৭/৮ জন আহত করে, তবে তারা বেঁচে যান।
চতুর্থ
১৯৭১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর লিয়াকত আলী, আমিনুল ইসলাম পাকিস্তানি আর্মিদের সঙ্গে নিয়ে কৃষ্ণপুর এলাকায় অভিযান চালানোর সময় হরিদাস রায় ও খিতিস রায়সহ ১০ জন হিন্দুকে অপহরণ করে অষ্টগ্রাম থানার সদানগর গ্রামের শ্মশানঘাটে নিয়ে গেলে রাত ১০টার দিকে আর্মিরা তাদেরকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি ও বেয়নেট চার্জ করে। এতে ঘটনাস্থলে ৮ জন মারা যান এবং ২ জন আহত হয়ে বেঁচে যান।
পঞ্চম
লিয়াকত আলী, আমিনুল ইসলাম ও তার সঙ্গীরা ৭১ সালের ভাদ্র মাসের প্রথম সপ্তাহে যেকোনো দিন বেলা ১০টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসির নগর থানার ফান্দাউক বাজার থেকে রঙ্গু মিয়া ও বাচ্চু মিয়াকে অপহরণ করে নিয়ে রাজাকার ক্যাম্পে টর্চার সেলে নির্যাতন করে।
পরের দিন দুপুর ১২টার দিকে রঙ্গু মিয়াকে নাসির নগর থানাধীন ডাকবাংলোর পাশে দত্তবাড়ির খালে হত্যা করে মরদেহ পানিতে ফেলে দেয়। অপহৃত বাচ্চু মিয়া অর্থের বিনিময়ে রাজাকারদের হাত থেকে মুক্তি পান।
ষষ্ঠ
১৯৭১ সালের ৭ নভেম্বর দুপুর আনুমানিক ১২টার সময় লিয়াকত আলী, আমিনুল ইসলাম, রাজাকার ও পাকিস্তানি সঙ্গীদের নিয়ে অষ্টগ্রাম থানার সাবিয়ানগর গ্রামে চৌধুরী বাড়ির উত্তর পাশে খালি জায়গায় ইশা খা ও আরজু ভূইয়াসহ ৫ জনকে গুলি করে হত্যা করে।
সপ্তম
১৯৭১ সালের ৭ নভেম্বর দুপুর আনুমানিক ১২টা থেকে সাড়ে ১২টার দিকে লিয়াকত আলী, আমিনুল ইসলাম, রাজাকার ও পাকিস্তানি সঙ্গীদের নিয়ে অষ্টগ্রাম থানার সাবিয়ানগর গ্রামে খাঁ বাড়িতে অভিযান চালিয়ে মনির খাঁ ও সফর আলীসহ আওয়ামী লীগ ও স্বাধীনতাকামী ১০ জনকে গুলি করে হত্যা করে।
ওই সময় রাজাকাররা বাড়িতে লুটপাট করে। এসব ঘটনায় ১৯৭২ সালে আমিনুল ইসলাম ওরফে রজব আলীর বিরুদ্ধে অষ্টগ্রাম থানায় তিনটি মামলা করা হয়। ওই অভিযোগে তার যাবজ্জীবন দণ্ড হয়েছিল।
এফএইচ/আরএস/জেআইএম