মানুষ যত্নসহকারে কোর্টের রিপোর্ট পড়ে
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেছেন, আমার মনে হয়, মানুষ যত্নসহকারে কোর্টের রিপোর্ট পড়েন। অন্য কোনো রিপোর্ট এত যত্ন নিয়ে পড়েন না। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় যখন একের পর হাইকোর্টের বিভিন্ন বেঞ্চ বিব্রত হচ্ছিল তখন এ নিয়ে আমি প্রচুর রিপোর্ট করেছি। ওগুলোই ছিল তখনকার হট নিউজ।
বিচারপতি হওয়ার আগ পর্যন্ত কয়েক বছর সাংবাদিকতা করেন সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। বুধবার তারই স্মৃতিচারণ করলেন তিনি। বললেন, আমি ‘সংবাদ’ পত্রিকায় ছিলাম। বিচারপতি এম এ আজিজ (সাবেক সিইসি) সাহেব আমাকে অনুরোধ করেছিলেন। উনার বন্ধু ছিল সংবাদের তখকার সম্পাদক বজলুর রহমান সাহেব। আমি তখন অনেক ব্যস্ত আইনজীবী। বিচারপতি এমএ আজিজ সাহেব বললেন যে, ‘আমি কথা দিয়ে ফেলেছি বজলুর রহমান সাহেবকে, কিছু দিন সাংবাদিকতা করেন’। আমি সাংবাদিকতা শুরু করি।
বুধবার ‘লিগ্যাল এইড ও আইন সাংবাদিকতা’ শীর্ষক ঢাকায় এক কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এসব কথা বলেন।
‘জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা’র সুপ্রিম কোর্ট কমিটি ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন-এর যৌথ উদ্যোগে আইনবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ল’ রিপোর্টার্স ফোরামের সদস্যদের জন্য এই কর্মশালার আয়োজন করা হয়।
সুপ্রিম কোর্ট কমিটির চেয়ারম্যান বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিমের সভাপতিত্বে সুপ্রিম কোর্ট মিলনায়তনে এই কর্মশালায় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. জয়নুল আবেদীন, সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল ড. জাকির হোসেন, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম, ল’ রিপোর্টার্স ফোরামের সভাপতি সাঈদ আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক হাসান জাবেদ শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন।
কর্মশালার দ্বিতীয় পর্বে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইংরেজি দৈনিক ডেইলি অবজারভারের অনলাইন এডিটর কাজী আবদুল হান্নান। এ পর্বে আলোচক ছিলেন বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের মহাপরিচালক মো. শাহ আলমগীর ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন। এতে উপস্থিত ছিলেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, ল’রিপোর্টাস ফোরামের সাবেক সভাপতি এম বদি-উজ-জামান ও আশুতোষ সরকার প্রমুখ। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন কমিটির সদস্য সচিব ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল টাইটাস হিল্লোল রেমা।
প্রধান বিচারপতি বলেন, সরকারি খরচে আইনি সেবাসহ সব সরকারি সেবা সম্পর্কে এখনও প্রত্যন্ত অঞ্চলের লোকজন খুব অবগত নন। এ জন্য লিগ্যাল এইডের সুফল নিয়ে সাংবাদিকরা ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে পারেন। গণমাধ্যমের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সরকারি আইন সেবা কার্যক্রম আরও গতিশীল হবে বলেই আমি আশাবাদী।
'বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় যখন একের পর হাইকোর্ট বেঞ্চ বিব্রত হচ্ছিল তখন এ নিয়ে আমি প্রচুর রিপোর্ট করেছি। এই গুলোই ছিল তখন হট নিউজ। নিদারাগ হত্যাকাণ্ড মামলার ডেথ রেফারেন্স নিয়েও রিপোর্ট করেছি। এখন কিন্তু আদালতে বিচারকরা কী কথা বলেন এটাও আপনারা লিখে দেন। কিন্তু যেটা আদালতের রেকর্ডে আসে সেটাই রিপোর্ট করা উচিত। কারণ, আদালতে আমরা অনেক সময় অনেক কথা বলি। বিদেশে বিচারকরা কথা বলেন না। যেমন ইংল্যান্ডে কোর্ট অব অ্যাপিলেডে গিয়েছি, হাইকোর্টে গিয়েছি। সেখানে আদালতে আমার নিয়মিত উপস্থিতি ছিল। ওইখানে দেখেছি, বিচারকরা কোনো আর্গুমেন্ট করেন না, প্রশ্ন করেন না। কোনো কিছু জানার (কয়ারি) থাকলে জিজ্ঞাসা করেন',- বলেন তিনি।
প্রধান বিচারপতি বলেন, কিন্তু আমরা যেহেতু কথা বলি, অনেক সময় এটা নিয়ে সংবাদপত্রে লেখা হয়। এটা নিয়ে দুই-একবার সাংঘাতিক হুলুস্থুল কাণ্ড হয়েছে সারাদেশে। নিশ্চয়ই আপনারা জানেন, আমি কোনটার কথা ইঙ্গিত করেছি। এটা নিয়ে সাংঘাতিক হৈচৈ হয়েছে। কিন্তু বিচারক অন রেকর্ড কিছু লেখেননি, যা বলেছিলেন, শুধুই মৌখিকভাবে বলেছিলেন। এটা নিয়ে আপনারা হুবহু রিপোর্ট করে দিয়েছেন। তারপরতো তা নিয়ে সারাদেশে তুলকালাম কাণ্ড।
তিনি বলেন, বিচারকরা অনেক সময় কথাচ্ছলে বলে ফেলেন। সুতরাং এ নিয়ে কতটা রিপোর্ট করবেন সেটা ভেবে দেখা উচিত। যেটা অন রেকর্ড সেটা নিয়েই রিপোর্ট করা উচিত। আপনারা একটু ভেবে দেখবেন। সাংবাদিকদেরও দায়িত্ব রয়েছে। কারণ আদালত একটি স্পর্শকাতর জায়গা।
প্রধান বিচারপতি বলেন, আমার মনে হয়, মানুষ যত যত্নসহকারে কোর্ট রিপোর্টিং পড়ে অন্য কোনো রিপোর্টিং এত যত্ন নিয়ে পড়ে না। সুতরাং বিচারকরা যেসব কথা বলেন, তা নিয়ে লেখার সময় আপনারা যদি খুব সতর্ক হন, সেদিকটা দেখার জন্য আপনাদের অনুরোধ করবো।
তিনি বলেন, বিদেশে প্রত্যেক আদালতে সাংবাদিকদের বসার জন্য আলাদা জায়গা থাকে। সুতরাং এখানে আদালতে প্রবেশের ক্ষেত্রে যে প্রতিবন্ধকতার কথা আপনারা বলেছেন, সেটা আমি দেখবো। ভবিষ্যতে আর যাতে কোনো বাধা-বিপত্তি না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখবো।
সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেন, সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সমাজের অসংগতি দূরীকরণে এবং সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে সাংবাদিকতা তথা গণমাধ্যমের ভূমিকা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। মানুষের তথ্য জানার অধিকার এবং গণমাধ্যমের তথ্য জানানোর গভীর দায়বদ্ধতার প্রশ্নে সামাজিক অঙ্গীকার নিয়ে সাংবাদিকরা প্রতিনিয়ত অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করছে।
এফএইচ/জেডএ/এমএস