শ্রীপুরের মেয়র ইন্দোনেশিয়ায়, কারাগারে কে?

জাহাঙ্গীর আলম
জাহাঙ্গীর আলম জাহাঙ্গীর আলম , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১২:৫৬ পিএম, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮
মেয়র আনিছুর রহমান ও নূরে আলম মোল্লা

গাজীপুরের শ্রীপুর পৌরসভার মেয়র ও গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আনিছুর রহমান ৯ দিনের সরকারি সফরে শনিবার (৮ সেপ্টেম্বর) ইন্দোনেশিয়া যান। বিদেশ যাওয়ার পরদিন রোববার (৯ সেপ্টেম্বর) আদালতে আত্মসমর্পণ করে অর্থ আত্মসাতের মামলায় জামিনের আবেদন করেন এই মেয়র। আর ঢাকার বিভাগীয় স্পেশাল জজ আদালতের বিচারক মিজানুর রহমান তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

এরপর জাগো নিউজের কাছে অভিযোগ আসে শ্রীপুর পৌরসভার মেয়র আনিছুর রহমান সরকারি সফরে বিদেশে আছেন। আদালত যাকে কারাগারে পাঠিয়েছেন তিনি আসল মেয়র নন। জাগো নিউজের পক্ষ থেকেই এই অভিযোগের সত্যতা অনুসন্ধানে নেমে পাওয়া যায় চাঞ্চল্যকর তথ্য। প্রমাণ মেলে মেয়র সরকারি সফরে ইন্দোনেশিয়ায় রয়েছেন। তার নাম ব্যবহার করে কারাগারে রয়েছেন তার কাছ থেকে সুবিধাভোগ করা যুবলীগ কর্মী নূরে আলম মোল্লা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, মেয়রের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা নেন নূরে আলম মোল্লা। মেয়রও তার ওপর অনেকটাই আস্থাশীল। যে কারণে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের করা মামলার সার্বিক বিষয় তদারকি করতেন নূরে আলম মোল্লা। বিদেশ যাওয়ার আগে মেয়র এই যুবলীগ কর্মীকে তার মামলার বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দিয়ে যান।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, পৌরসভার রসিদের মাধ্যমে আদায়কৃত ট্যাক্স ও বিবরণীর ৪৩ লাখ ৭৬ হাজার ১০৭ টাকা পৌরসভার তহবিলে জমা না করে কয়েকজন সহযোগীর মাধ্যমে আত্মসাৎ করেন শ্রীপুর পৌরসভার মেয়র আনিছুর রহমান। এছাড়া ইজারার নামে শ্রীপুর পৌরসভার অন্তর্গত পাঁচটি হাট-বাজার থেকে সাত লাখ ৩৫ হাজার ২০০ টাকা আত্মসাৎ করেন তিনি। অর্থ আত্মসাতের দায়ে এ দুটি ঘটনাসহ মেয়রের বিরুদ্ধে চারটি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের করা মামলায় ৯ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের শ্রীপুর পৌরসভার মেয়র আনিছুর রহমানসহ দুজনকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন ঢাকার বিভাগীয় স্পেশাল জজ মিজানুর রহমান খান। কারাগারে যাওয়া অপর আসামি শ্রীপুর পৌরসভার সাবেক হিসাবরক্ষক আব্দুল মান্নান।

এদিন চার মামলায় মেয়র আনিছুর রহমান (যুবলীগ কর্মী নূরে আলম মোল্লা) ও আব্দুল মান্নান দুই মামলায় আইনজীবী সৈয়দ রেজাউর রহমানের মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন করেন। দুদকের আইনজীবী রুহুল ইসলাম খান তাদের জামিনের বিরোধিতা করেন। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে বিচারক মেয়র আনিছুর রহমানকে এক মামলায় জামিন মঞ্জুর এবং অপর তিন মামলায় জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। অপরদিকে আব্দুল মান্নানের দুই মামলায় জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করেন আদালত।

চার মামলার মধ্যে এক মামলায় অভিযোগ থেকে জানা যায়, পৌরসভার রসিদের মাধ্যমে আদায়কৃত ট্যাক্স ও বিবরণীর ৪৩ লাখ ৭৬ হাজার ১০৭ টাকা পৌরসভার তহবিলে জমা না করে আত্মসাৎ করেন তারা। ওই ঘটনায় ২০১৫ সালের ২১ জানুয়ারি দুদকের উপ-সহকারী পরিচালক ফখরুল ইসলাম মামলা করেন। ২০১৬ সালের ১২ জুলাই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চার্জশিট দাখিল করেন।

আরেক মামলায় অভিযোগ থেকে জানা গেছে, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে ২০১০ সালে শ্রীপুর পৌরসভার অন্তর্গত পাঁচটি হাট-বাজার থেকে সাত লাখ ৩৫ হাজার ২০০ টাকা আত্মসাৎ করেন। ওই ঘটনায় ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই দুদকের উপ-সহকারী পরিচালক ফখরুল ইসলাম মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত করে ২০১৫ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর চার্জশিট দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপ-সহকারী পরিচালক ইকবাল হোসেন। অন্য দুই মামলায়ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আনা দুদক তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে।

তবে জাগো নিউজের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে মেয়র আনিছুর রহমান নামে যাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে তিনি আসল মেয়ার নন। তার প্রকৃত নাম নূরে আলম মোল্লা। তিনি মেয়র আনিছুরের আস্থাভাজন একজন যুবলীগ কর্মী।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে শ্রীপুর পৌরসভার সচিব বদরুজ্জামান বাদল জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার উপস্থিতিতে ৮ সেপ্টেম্বর রাত ১১টায় মালিন্দো এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে শ্রীপুর পৌরসভার মেয়র আনিছুর রহমান ৯ দিনের এক সফরে ইন্দোনেশিয়ায় গেছেন। তার পরিচয় দিয়ে কে আত্মসমর্পণ করে কারাগারে গেছেন তা আমার জানা নেই।’

মেয়রের ছোট ভাই মাওনা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মোকলেছুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, শনিবার রাতে দক্ষিণ এশিয়ার পল্লী উন্নয়নবিষয়ক এক সম্মেলনে যোগ দিতে সরকারি সফরে মেয়র আনিছুর রহমান ইন্দোনেশিয়া যান। তিনি সেখানে ৯ দিন থাকবেন।

তিনি বলেন, শ্রীপুরের যুবলীগ কর্মী নূরে আলম মোল্লা নামে একজন মেয়রের নামে ঢাকার আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করলে আদালত তা নামঞ্জুর করেন বলে আমি শুনেছি।

‘হয়তবা আইনজীবী বলেছেন, মেয়রের নামে একজন দাঁড়িয়ে জামিনের আবেদন করলে আদালত তা মঞ্জুর করেবেন। মামলার জন্য মেয়রকে আদালতে যেতে হবে না। তবে মেয়র এ বিষয়ে কিছু জানেন না’ বলেন মোকলেছুর রহমান।

বিষয়টি নিয়ে মেয়র আনিছুরের আইনজীবী সৈয়দ রেজাউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, গাজীপুরের শ্রীপুর পৌরসভার মেয়র আনিছুর রহমান নামে একজন চার মামলায় আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করেন। চার্জশিটের সঙ্গে তার নাম ও পিতার নাম মিল ছিল। আদালত তিন মামলায় জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। তিনি সঠিক মেয়র কি-না এ বিষয়ে কাগজে প্রমাণিত হবে।

দুদকের আইনজীবী রুহুল ইসলাম খান জাগো নিউজকে বলেন, অর্থ আত্মসাতের চার মামলায় গাজীপুরের শ্রীপুর পৌরসভার মেয়র আনিছুর রহমান আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করেন। আদালত এক মামলায় জামিন মঞ্জুর করেন। অপর তিন মামলায় জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

তিনি আরও বলেন, জামিন আবেদনে তিনি নিজেকে গাজীপুরের শ্রীপুর পৌরসভার মেয়র আনিছুর রহমান বলে উল্লেখ করেন। মেয়রের নাম ব্যবহার করে অন্য ব্যক্তি কারাগারে রয়েছেন এমন কোন বিষয় আমার জানা নেই। আপনারা যেহেতু বলছেন মেয়রের নাম ব্যবহার করে অন্য একজন কারাগারে গেছেন, সেহেতু বিষয়টি আমরা ক্ষতিয়ে দেখবো।

জেএ/এমবিআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।