আদালতে আজ ছেলেই বিচারক, আমরা দেখব : হাইকোর্ট

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:৪১ এএম, ২৬ জুন ২০১৮
ছবি-ফাইল

‘আদালতে আজ আমি কোনো আদেশ দেব না। আজকের আদালতে বিচারক সেই ছেলে। নিজের ওরশজাত সন্তানই বিচার করবে বাবা-মা আবার একত্রিত হবে কিনা।’ আলাদা হওয়া এক দম্পতির দুই সন্তানের কান্না এবং আবারও বাবা-মায়ের এক হতে আকুতি দেখে সোমবার এমন কথা বলছিলেন হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের বিচারক।

ওই ‘বিচারক ছেলের’ মায়ের নাম কামরুন নাহার মল্লিকা। তিনি রাজশাহীর মেয়ে। বাবা মেহেদী হাসান মাগুরার মুহাম্মদপুরের ছেলে। কোনো এক সূত্র ধরে ঢাকার গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের ছাত্রী মল্লিকার সঙ্গে ঢাকা কলেজের ছাত্র মেহেদীর পরিচয় হয়। পরে প্রেম এবং দুইপক্ষের সম্মতিতে ২০০২ সালের ৯ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে করেন তারা।

লেখাপড়া শেষে মেহেদী হাসান একটি প্রাইভেট ব্যাংকে চাকরি শুরু জীবন শুরু করেন। আর মল্লিকা চাকরি করেন ধানমন্ডির একটি স্কুলে। বিয়ের পর সুখেই কেটে যায় অনেকটা বছর। এর মধ্যে তাদের ঘরকে আলোকিত করে আসে দুটি সন্তান। সন্তানদের শিক্ষিত করতে ভর্তি করানো হয় ইংরেজি মাধ্যমে স্কুলেও। তবে সুখের দাম্পত্য জীবনে বাজে বিচ্ছেদের সুর।

পাচঁ বছর ধরে দু’জনের মনোমালিন্যের একপর্যায়ে বিবাহ-বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে। ২০১৭ সালের ১২ মে হঠাৎ স্বামী মেহেদী হাসান সন্তানদের মাগুরার গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে স্ত্রী কামরুন নাহার মল্লিকের হাতে তালাকনামা ধরিয়ে দেন। বাড়ি থেকে বের যান স্ত্রী কামরুন নাহারও।

বিচ্ছেদের পার চলে গেছে এক বছরের বেশি সময়। এর মধ্যে বাবা মেহেদী হাসান ছেলে সালিম সাদমান দ্রুব (১২) ও সাদিক সাদমান লুব্ধক (৯)-কে তাদের ফুফুর তত্ত্বাবধানে রেখে গ্রামের একটি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। বাবা ঢাকার উত্তরায় থাকলেও শিশু দুটির সুখের জন্য তার ব্যক্তিগত গাড়িটিও সন্তানদের ব্যবহারের জন্য দিয়ে দেন। সেখানেই বড় হচ্ছিল শিশু দুটি।

এদিকে মা বারবার চেষ্টা করেও সন্তানের সঙ্গে দেখা করতে পারছিলেন না। মা কামরুন নাহার মল্লিকার অভিযোগ, সব রকম চেষ্টা করেও সন্তানের সঙ্গে দেখা করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত সন্তানদের নিজের হেফাজতে নেয়ার জন্য হাইকোর্টের শরণাপন্ন হন তিনি।

আদালত শুনানি নিয়ে গত ২৯ মে শিশু দুটিকে হাইকোর্টের হাজির করতে সংশ্লিষ্ট পুলিশ ও শিশু দুটির বাবাকে নির্দেশ দেন। ২৫ জুন তাদের হাজির করতে বলা হয়। একই সঙ্গে সন্তানকে কেন মায়ের হেফাজতে দেয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন।

নির্দেশ মোতাবেক শিশুদুটিকে সোমবার (২৫ জুন) আদালতে হাজির করে পুলিশ। একই সঙ্গে শিশু দুটির বাবা-মা, মামা, নানি ও ফুফুসহ আত্মীয় স্বজনেরা আদালতে হাজির হন।

সোমবার দুপুরে এ বিষয়ের ওপর শুনানি শুরু করেন হাইকোর্টের বিচারপতি জেবিএম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ। দুইপক্ষের আইনজীবীদের বক্তব্য শোনার পর আদালত এক পর্যায়ে শিশু দুটির বক্তব্য শুনতে চায়। এ সময় বড় ছেলে সালিম সাদমান দ্রুত আদালতকে বলেন, ‘আমরা বাবা ও মাকে এক সঙ্গে দেখতে চাই। আমরা দু’জনকেই চাই। আমরা আর কিছু চাই না।’ শিশুরদের বক্তব্য শুনে আদালত আবারও আইনজীবীদের বক্তব্য শুনেন।

এ সময় সন্তানের মায়ের পক্ষে আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল আদালতে বলেন, ‘আজ এক বছর ধরে মা তার সন্তানকে দেখতে পাচ্ছে না। আজকে যখন কোর্টে হাজির করা হয়েছে তখনও শিশুর ফুফু কথা বলতে বাধা দিয়েছে।’

এ সময় আইনজীবী সন্তানদের সঙ্গে মায়ের কথা বলার জন্য সুযোগ করে দিতে আদালতের অনুমতি চান। পরে আদালতের অনুমতি পেয়ে মা ছেলেদের কাছে এগিয়ে যেতেই দুই ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি শুরু হয়। এ সময় ছেলেরাও দীর্ঘদিন পর মাকে পেয়ে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকে। চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র এবং তাদের বড় ছেলে সালিম সাদমান দ্রুব হাত বাড়িয়ে বাবাকেও ডাকেন। দুইশিশু তখন বাবাকে উদ্দেশ করে বলতে শোনা যায়- ‘বাবা তুমিও আসো। তুমি আমাদের কাছে আসো। আম্মুকে সরি বলো। আম্মু তুমিও বাবাকে সরি বলো।’

এ সময় বাবাও এগিয়ে এলে আদালতের ভেতর এক আবেগঘন পরিবেশ তৈরি হয়। বাবা-মা এবং তাদের সন্তানদের একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্নার দৃশ্য দেখে আদালতে উপস্থিত বিচারপতি, আইনজীবী, সাংবাদিকসহ সকলের চোখে পানি চলে আসে।

এ সময় আদালতের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি জেবিএম হাসান আবারও শিশু দুটিকে কাছে ডেকে নেন। সঙ্গে মাকেও কাছে ডাকেন। আদালত বলেন, ‘এ দৃশ্য দেখেও কি আপনাদের মন গলে না। আপনারা কি সন্তানের জন্য নিজেদের স্বার্থ ত্যাগ করতে পারবেন না। সংসার করলে হাজারটা অভিযোগ থাকে। আমরাও সংসার করছি। সন্তানের স্বার্থের থেকে আপনাদের ইগো বেশি হয়ে গেল। সামনের তাকিয়ে দেখুন আপনাদের এ দৃশ্য দেখে সকলের চোখ দিয়েই পানি পড়ছে।’

এ সময় আদালতের উভয়পক্ষের আইনজীবীসহ শতাধিক আইনজীবী দাঁড়িয়ে সমস্বরে সন্তানদের বিষয়টি চিন্তা করে বাবা-মাকে মেনে নেয়ার দাবি জানান। একই সঙ্গে সন্তানদের চাওয়া অনুযায়ী তাদের দাম্পত্য জীবন যাতে বজায় থাকে এ সে রকম একটি আদেশ দেয়ার দাবি জানান।

পরে আদালত দুটি সন্তান, বাবা-মা এবং শিশু দুটির নানী ও ফুফুকে আদালতের এজলাসের কাছে ডেকে নেন। এ সময় একে একে প্রত্যেকের বক্তব্য শুনেন। পরে আরও বিস্তারিত শুনতে বিচারপতিদের খাস কামরায় ডেকে নিয়ে বাবা ও মায়ের একান্ত বক্তব্য শোনেন।

এ সময় আদালতে উপস্থিত সিনিয়র কয়েকজন আইনজীবীরা অনুমতি নিয়ে কথা বলতে চাইলে বিচারক তাদেরকে থামিয়ে দেন। আদালত বলেন, আজ আমরা কোন আদেশ দেব না। ৮০ শতাংশ বিচার এই ছেলেই করেছে, বাকি ২০ শতাংশ আইনজীবী আদালত উপস্থিত সকলের। সন্তানরা চায় বাবা-মাকে নিয়ে মিলে মিশে থাকতে। আপনাদের কোনো আপত্তি আছে? তখন মা-বাবাও সমস্বরে বলেন, ‘হ্যাঁ, সন্তানের মঙ্গলই আমাদের মঙ্গল। তারা যা চায় তাই হবে।’

বিচারক বলেন, আমার বিচরিক জীবনে বিবাহ বিচ্ছেদের পর আরও চারটি (দম্পতি) পরিবারকে একত্রিত করেছি। তারাও কান্না করেছিল। কিন্তু আজকের পরিবেশ আমার জীবনে স্বরণীয় ঘটনা। এমন ম্যাচিউর ছেলে আপনাদের। আপনারা দম্পতি একত্রিত হয়ে যান।

আদালত আরও বলেন, আগামী ৪ জুলাই পর্যন্ত শিশু সন্তান দুটি মায়ের হেফাজতে থাকবে। তবে এ সময়ে বাবা শিশু দুটির দেখাশোনা করার সুযোগ পাবেন। আগামী ৪ জুলাই পরবর্তী দিন ঠিক করে শিশুদুটিকে হাজির করার নির্দেশ দিয়ে বিষয়টি মুলতবি করেন।

আদালতে শিশু দুটির বাবার পক্ষে ছিলেন আইনজীবী তাপস বল। মায়ের পক্ষে ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল এবং তার সঙ্গে ছিলেন একেএম রিয়াদ সলিমুল্লাহ।

আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা। দুটি বাচ্চার এমন কান্নার দৃশ্য দেখে আজকে আদালতে উপস্থিত সবাই চোখের পানি ফেলেছে। এমন একটি পরিবেশ আদালতের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে যা, আমাদের সবাইকে আপ্লুত করেছে। বাচ্চা দুটি আজ আদালতে উচ্চস্বরে বলতে ছিল, আমরা বাবা এবং মাকে একসঙ্গে দেখতে চাই। আমার ধারণা, বাচ্চাদের সেই আকুতি হয়ত বাবা-মায়ের মধ্যে দাগ কেটেছে। আমরা আশা করবো, বাবা-মা তাদের দাম্পত্য কলহ ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করবে।’

আদেশের পর সন্তানের মা কামরুন নাহার মল্লিকা সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি আমার সন্তানকে পেয়েছি। আমি খুশি। এর থেকে বেশি কিছু বলার ভাষা নেই।’ বাবা মেহেদী হাসান বলেন, ‘আমার সন্তানেরা সন্তুষ্ট। এরপর আমার আর বলার কিছু নেই।’

এফএইচ/আরএস/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।