‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ নিষিদ্ধ : পরীক্ষায় কোনো পুরুষ নয়

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:১০ পিএম, ১২ এপ্রিল ২০১৮
ছবি-প্রতীকী

একজন নারী চিকিৎসক বা ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ দিয়ে ধর্ষণের শিকার ক্ষতিগ্রস্ত নারী বা শিশুর পরীক্ষা করাতে হবে। পরীক্ষার সময় একজন নারী গাইনোকোলজিস্ট, একজন নারী ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ, ভিকটিমের একজন নারী আত্মীয়, একজন নারী পুলিশ সদস্য, নারী সেবিকাসহ মোট ছয় সদস্য সেখানে উপস্থিত থাকবেন।

বৃহস্পতিবার ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায়ের পর্যালোচনায় এ বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়।

‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ সংক্রান্ত রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুর ও বিচারপতি এ কে এম সাহিদুল করিমের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।

রায় ঘোষণার পর রিটকারীর পক্ষের আইনজীবীরা জানান, ধর্ষণের পরীক্ষা (টেস্ট) সাধারণত পুরুষ চিকিৎসকরাই করে থাকেন। সে হিসেবে হাইকোর্টের এ রায়ের ফলে এখন থেকে কোনো পুরুষ সদস্য
ক্ষতিগ্রস্ত নারীর টেস্ট করতে পারবেন না।

হাইকোর্টের রায়ে ধর্ষণের ক্ষেত্রে পিভি টেস্ট নামে পরিচিত আঙ্গুলের সাহায্যে বায়ো ম্যানুয়াল টেস্টও নিষিদ্ধ করেছেন আদালত। এখন থেকে ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশু ভিকটিমের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার ক্ষেত্রে ২০১৭ সালে সরকার ঘোষিত গাইডলাইন (প্রোটোকল ফর হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার) কঠোরভাবে অনুসরণ করারও নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

আদালত বলেছেন, ‘দুই আঙ্গুলের সাহায্যে বাংলাদেশে প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতি আইনসম্মত বা বিজ্ঞানভিত্তিক নয়। এমনকি এ পদ্ধতিতে পরীক্ষা বিশ্বাসযোগ্যও নয়।’

রায়ে বলা হয়েছে, ‘একজন নারী চিকিৎসক বা ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ দিয়ে ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর পরীক্ষা করতে হবে। এ সময় একজন নারী গাইনোকোলজিস্ট, একজন নারী ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ, ভিকটিমের একজন নারী আত্মীয়, একজন নারী পুলিশ সদস্য, নারী সেবিকা রাখতে হবে।’

‘তবে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ যে সনদ দেবে তাতে অভ্যাসগত যৌনতা বলে কোনো মন্তব্য করা যাবে না। পরীক্ষার পর ধর্ষিতার যাবতীয় গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে। এছাড়া বিচারাধীন মামলায় নিম্ন আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণকালে নারীকে অমর্যাদাকর কোনো প্রশ্নও করা যাবে না।’

রায়ে আরও বলা হয়, ‘যদি ক্ষতিগ্রস্তের আঘাত বা ক্ষত গভীর থাকে, সেক্ষেত্রে একজন গাইনোকোলজিস্টের কাছে তাকে পাঠাতে হবে। এক্ষেত্রে ঠিক কোন কারণে এ গভীর ক্ষতের পরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে তা লিখতে হবে। কোনো আঘাত বা ক্ষত না থাকলে ক্ষতিগ্রস্ত নারী, শিশু ও তরুণীর ক্ষেত্রে স্পার্স স্পেক্যুলাম (এক ধরনের যন্ত্র, যা দিয়ে যৌনাঙ্গ এলাকায় পরীক্ষার করা হয়) পরীক্ষা করা যাবে না।’

রায়ে হেলথ কেয়ার প্রোটোকল ব্যাপকভাবে প্রচার এবং সংশ্লিষ্টদের কাছে বিশেষ করে চিকিৎসক, আদালত, পিপি (নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ ট্রাইব্যুনাল), ধর্ষণ মামলায় পুলিশের সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তা, উৎসাহী আইনজীবীর কাছে সরবরাহ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। হেলথ কেয়ার প্রোটোকল বিষয়ে সচেতনা বাড়াতে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে সেমিনার করতেও বলা হয়েছে।

রিটের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন ব্যারিস্টার সারা হোসেন, ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া প্রমুখ।

দুই আঙুলের মাধ্যমে ধর্ষণ পরীক্ষা পদ্ধতির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১৩ সালের ৮ অক্টোবর ব্লাস্ট, আসক, মহিলা পরিষদ, ব্র্যাক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, নারীপক্ষসহ দুই চিকিৎসক এ সংক্রান্ত রিট আবেদনটি করেন।

রিটে দুই আঙুলের মাধ্যমে ধর্ষণ পরীক্ষার পদ্ধতিকে সংবিধানের ২৭, ২৮, ৩১, ৩২ ও ৩৫(৫) ও সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ ধারার পরিপন্থী দাবি করা হয়।

ব্লাস্টের রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের ১০ অক্টোবর বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকার সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ রুল জারি করেন। সেখানে ‘টু ফিঙ্গার্স টেস্ট’ কেন আইনানুগ কর্তৃত্ববহির্ভূত এবং অবৈধ হবে না জানতে চাওয়া হয়। পাশাপাশি স্বাস্থ্যসচিবকে ধর্ষণের শিকার মেয়েশিশু ও নারীদের জন্য নীতিমালা তৈরির নির্দেশ দেন।

পরীক্ষাটি বাতিলের দাবি যে কারণে: ধর্ষণের পর একজন মেয়েশিশু বা নারীকে দীর্ঘ ও কঠিন স্বাস্থ্যপরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এর একটি ‘টু ফিঙ্গার্স টেস্ট’। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চিকিৎসক জানান, স্বাস্থ্যপরীক্ষার প্রতিবেদনে সুনির্দিষ্ট কিছু তথ্য চাওয়া হয়। সে জন্য পরীক্ষাটি করা হয়ে থাকে। তবে শিশুদের যোনিপথের আঘাত খালি চোখেই দেখা যায়। সে জন্য খুব জরুরি না হলে পরীক্ষাটি করা হয় না।

মানবাধিকারকর্মীরা যে যুক্তি তুলছেন, তা হলো পরীক্ষাটির ফলাফল অনুমানভিত্তিক। এটি ধর্ষণের শিকার মেয়েশিশু ও নারী এবং চিকিৎসকের দৈহিক গড়নের ওপর নির্ভর করে। শিশু ও অল্প বয়স্ক নারীদের জন্য পরীক্ষাটি যন্ত্রণাদায়কও। আরও যে প্রশ্নটি উঠছে, তা হলো বিবাহিত নারীরা যখন ধর্ষণের শিকার হবেন, তখন ‘টু ফিঙ্গার্স টেস্ট’-এর কোনো যুক্তিই নেই।

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দিকনির্দেশনায় যা আছে: দিকনির্দেশনায় চিকিৎসককে প্রথমে স্বাস্থ্যপরীক্ষা সম্পর্কে ধর্ষণের শিকার নারী বা মেয়েশিশুর অভিভাবককে জানানোর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণে ঘটনার পারিপার্শ্বিকতার ওপর জোর দিতে বলা হয়েছে। চিকিৎসকেরা অন্যান্য আলামত যথেষ্ট বিবেচিত হলে ‘টু ফিঙ্গার টেস্টের’ প্রয়োজন আছে কি নেই, সে সম্পর্কে মন্তব্য করবেন। তাঁরা একান্ত প্রয়োজন না হলে টু ফিঙ্গার টেস্ট করবেন না বলেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

এছাড়া সনদ দেওয়ার ক্ষেত্রে মর্যাদাহানিকর ভাষা ব্যবহারে বিশেষ করে ‘অভ্যাস’, ‘অভ্যস্ত’ এমন শব্দ ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে।

এফএইচ/এমএআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।