৪ বছর হিমঘরে থাকার পর কবর পাচ্ছে ধর্মান্তরিত নীপার লাশ
দীর্ঘ ৪ বছর মর্গে (হিম ঘরে) থাকা হিন্দু থেকে মুসলিম ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়া নীলফামারীর হোসনে আরা লাইজুর (নীপা রানী রায়) লাশ ইসলামিক রীতি অনুযায়ী দাফন করার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি হোসনে আরা লাইজুর দাফনের পূর্বে তার (লাইজু/নীপা) পরিবারকে (মা-বাবাকে) দেখার সুযোগ করে দিতে জেলা প্রশাসক (ডিসিকে) নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
একইসঙ্গে আদালতের এই আদেশ লিখিত আকারে হাতে পাওয়ার তিন দিনের মধ্যে স্থানীয় জেলা প্রশাসক (ডিসি) এবং একজন ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের সহযোগিতায় বাস্তবায়ন করতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
এক আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বৃহস্পতিবার হাইকোর্টের বিচারপতি মো. মিফতাহ উদ্দিন চৌধুরীর একক বেঞ্চ এই রায় ঘোষণা করেন। আদালতে মেয়ের বাবার পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট সমীর মজুমদার। অন্যদিকে ছেলের বাবার পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট সাফিউর রহমান, তার সঙ্গে ছিলেন নাসরিন বেগম ও জান্নাত রাখি।
জানা যায়, নীলফামারীর ডোমার উপজেলার বামুনিয়া ইউনিয়নের খামার বমুনিয়া গ্রামের অক্ষয় কুমার রায়ের মেয়ে নীপা রানী রায়ের (২০) সঙ্গে একই উপজেলার পূর্ব বোড়াগাড়ী গ্রামের জহুরুল ইসলামের ছেলে হুমায়ুন ফরিদ লাজুর (২৩) প্রেমের সম্পর্ক ছিল। তারা ২০১৩ সালের ২৫ অক্টোবর পালিয়ে যান। এরপর নীপা রানী রায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ও মোছা. হোসনে আরা বেগম লাইজু নাম নেন। নীলফামারী নোটারি পাবলিক ক্লাবের মাধ্যমে অ্যাভিডেভিটে দুই লাখ ১ হাজার ৫০১ টাকা দেনমোহরে হুমায়ুন ফরিদ লাজুকে বিয়ে করেন তিনি।
অক্ষয় কুমার রায় ২০১৩ সালের ২৮ অক্টোবর বাদী হয়ে নীলফামারী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে একটি অপহরণ মামলা দায়ের করেন। মামলার পর তারা স্বামী-স্ত্রীর পরিচয়ের সকল কাগজপত্রসহ আদালতে হাজির হয়ে জবানবন্দি প্রদান করেন নীপা। পরে আদালত সার্বিক বিবেচনায় অপহরণ মামলাটি খারিজ করে দেন।
মেয়ের বাবা মামলার খারিজ আপিলে তার মেয়েকে অপ্রাপ্তবয়স্ক ও মস্তিষ্কবিকৃত (পাগল) দাবি করে আদালতে কাগজপত্র দাখিল করেন। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে মেয়েটির শারীরিক পরীক্ষার জন্য রাজশাহী সেফ হোমে পাঠিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন।
পরে ২০১৪ সালের ১৫ জানুয়ারি হুমায়ূন ফরিদ ওরফে লাজু ইসলাম বিষপান করে আত্মহত্যা করেন। এরপর লাজুর আত্মহত্যার বিষয়টি আদালতে উপস্থাপন করে মেয়ের বাবা মেয়েকে (নীপা রানী ওরফে মোছা. হোসনে আরা বেগম লাইজু) নিজ জিম্মায় নিতে আদালতে আবেদন করেন। আদালত তা মঞ্জুর করলে ২০১৪ সালের ১৬ জানুয়ারি মেয়েকে নিয়ে বাবা তার বাড়িতে নিজ জিম্মায় রাখেন। তবে মেয়েকে অপ্রাপ্তবয়স্ক ও মস্তিস্কবিকৃত (পাগল) দাবি করে আদালতে আগে যে মামলাটি দায়ের করা হয়েছিল সেটি চলমান থেকে যায়।
২০১৪ সালের ১০ মার্চ কীটনাশক পান করেন নীপা। পরে তাকে ডোমার উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ভর্তি করা হলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঘটনার দিন রাত ৮ টার দিকে তিনি মারা যান। ডোমার থানা পুলিশ হাসপাতাল থেকে মেয়েটির মরদেহ রাতেই উদ্ধার করে।
পরদিন (১১ মার্চ) নীলফামারী জেলার মর্গে মেয়েটির মরদেহ ময়নাতদন্ত করা হয়।
এরপর পুত্রবধূ দাবি করে তার শ্বশুড় জহুরুল ইসলাম ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক নীপার দাফন ও মেয়েটির বাবা অক্ষয় কুমার রায় হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে মেয়ের সৎকারের জন্য নীলফামারী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আবেদন করেন।
আদালতে উভয়পক্ষের শুনানি নিয়ে নীপার মরদেহ তার শ্বশুরের কাছে হস্তান্তরের নির্দেশ দেন। ফলে বিষয়টি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নীপার মরদেহ রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতলের হিমঘরেই থেকে যায়।
এদিকে ম্যাজিস্ট্রেট আদালত তার আদেশে নীপার মরদেহ শ্বশুরের কাছে হস্তান্তরের নির্দেশ দিলেও সে আদেশের বিরুদ্ধে নীপার বাবা আপিল করেন।
এরপর জজ আদালত নীপার মরদেহ তার বাবার কাছেই হস্তান্তরের নির্দেশ দেন।
কিন্তু সেই আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আবেদন করেন নীপার শ্বশুর। বৃহস্পতিবার সেই আবেদনের নিষ্পত্তি করে আদালত আদেশ দিলেন।
এফএইচ/এনএফ/জেআইএম