পার্বত্য অঞ্চলের ভূমি বিরোধ জিইয়ে রাখা সমীচীন নয় : আইনমন্ত্রী
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, আইন থাকা সত্বেও বিধি প্রণয়ন করা হয়নি বলে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভূমি বিরোধ সমস্যা সমাধানের কাজ গতি পাচ্ছে না। তিনি বলেন, যেসব ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি আইনের প্রভিশন বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য যথেষ্ঠ সেসব ক্ষেত্রে বিধি প্রণয়নের অপেক্ষায় থেকে সমস্যা জিইয়ে রাখা সমীচীন নয়। বিধি প্রণয়নের কাজ চলার পাশাপাশি আইনের মাধ্যমে যেসব সমস্যা সমাধান করা যায় সেগুলো করা বাঞ্জনীয়।
মঙ্গলবার ঢাকায় বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এন্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) আয়োজিত ‘পার্বত্য চট্ট্রগ্রামের ভূমি সমস্যা নিষ্পত্তিকরণে রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ ও বাধাসমূহ নিরূপণে করণীয়’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় এসব কথা বলেন তিনি। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ১৯৭৫ পরবর্তী দীর্ঘ প্রায় দুই দশক ধরে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিরাজ করছিল সংঘাতময় পরিস্থিতি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় দেশের কোনো অঞ্চল বা কোনো জনগোষ্ঠীকে অস্থিতিশীল বা উন্নয়নের বাইরে রেখে কোনো দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। সেই উপলব্ধি থেকে ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে দীর্ঘ দুই দশক যাবৎ বিরাজমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিরসনের উদ্যোগ নেয়।
সেই লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতাদের কয়েক দফা সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা শান্তি চুক্তি নামে পরিচিত। এই ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তি চুক্তি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্যতম বড় একটি সাফল্য। কারণ এই চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের দীর্ঘ দুই দশকের সংঘাতময় পরিস্থিতির অবসান ঘটে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এজন্য দেশে-বিদেশে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হন।
আইনমন্ত্রী বলেন, পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। চুক্তি কার্যকর করার জন্য ১৯৯৮ সালের ১৫ জুলাই পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং ১৯৯৯ সালের ৭ই মে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হয়। শান্তি চুক্তির সবচেয়ে জটিল ও বিরোধপূর্ণ বিষয় তথা ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ১৯৯৯ সালে গঠন করা হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন। উল্লেখ্য শান্তি চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে বাংলাদেশ সরকার এ পর্যন্ত ৪৮টি ধারা সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করেছে, ১৫টি ধারার আংশিক বাস্তবায়ন হয়েছে এবং ৯টি ধারার বাস্তবায়ন চলমান রয়েছে।
তিনি বলেন, পার্বত্য শান্তি চুক্তির অন্যতম জটিল বিষয় হলো ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি। চুক্তির অন্যান্য বিষয়ের মতো এ বিষয়েও শেখ হাসিনার সরকার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। চুক্তির খ-খণ্ডের ২৬ নং ধারা অনুযায়ী সরকার ১৯৯৮ সালে পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন সংশোধন করেছে এবং বিশেষ ক্ষেত্র ব্যতীত ভূমি বন্দোবস্ত স্থগিত করেছে। সর্বোপরি চুক্তি অনুযায়ী শেখ হাসিনার সরকার ১৯৯৯ সালে একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন গঠন করে। ওই কমিশনকে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন বহির্ভূতভাবে কোনো ভূমি বন্দোবস্ত করা হয়ে থাকলে তা বাতিল করার এবং বন্দোবস্তজনিত কারণে কোন বৈধ মালিক ভূমি হতে বেদখল হয়ে থাকলে তার দখল পুনর্বহালের ক্ষমতা প্রদান করা হয়। চেয়ারম্যান ব্যতীত কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেন যথাক্রম পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান, সংশ্লিষ্ট জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, সংশ্লিষ্ট সার্কেল চিফ ও চট্টগ্রাম বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার অথবা তাদের মনোনীত প্রতিনিধি।
কমিশনের এই অন্তর্ভুক্তিমূলক চরিত্র পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ নিরসনে সরকারের আন্তরিকতার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। কমিশনের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য শেখ হাসিনার সরকার ২০০১ সালে প্রণয়ন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি আইন। তিনি বলেন, পাবর্ত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নে বিশেষত ভূমি বিরোধ নিরসনে বর্তমান সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে এবং এ কাজের অংশ হিসেবে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়ায় গতি আনার জন্য ২০১৬ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি আইনে ৯টি সংশোধনী আনা হয়েছে। সংশোধনীসমূহ পাবর্ত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়ায় অধিকতর গতি আনবে বলে তিনি আশাবাদী। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের কার্যক্রম চালানোর সুবিধার্থে সরকার রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানে দুটি আঞ্চলিক অফিস স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে এবং তা কার্যকর করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, বর্তমান সরকার যেভাবে পাবর্ত্য চট্টগ্রামের জনগণকে আস্থায় নিয়ে সমস্যার মূল অনুসন্ধান ও সমাধানে চেষ্টা করে যাচ্ছে, তাতে অচিরেই চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া গতিশীল হবে। বিআইআইএসএস- এর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল একেএম আব্দুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রফেসর ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, মেজর জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর কবির তালুকদার, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. কামাল উদ্দিন তালুকদার প্রমুখ সেমিনারে বিষয়ভিত্তিক আলোচনায় অংশ নেন।
এফএইচ/ওআর/এমএস