পিলখানা ট্র্যাজেডি: আমাদের গন্তব্য এক, মূল রায় সোমবার
বহুল আলোচিত পিলখানার বিডিআর ট্র্যাজেডিতে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যার মামলায় রায় ঘোষণা শুরু করেছেন হাইকোর্ট। তবে আদেশের অংশসহ মূল রায় সোমবার ঘোষণা করা হবে। রায়ের পর্যবেক্ষণে ভিন্ন মত থাকলেও আদেশের অংশের বিষয়ে তিন বিচারপতিই একমত হয়েছেন।
হাইকোর্টের বিচারপতি মো. শওকত হোসেনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিশেষ (বৃহত্তর) বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করছেন। বেঞ্চের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার।
বেঞ্চের নেতৃত্বদানকারী বিচারপতি মো. শওকত হোসেন বলেছেন, ‘এ মামলাটি আমাদের আদালতে আসার পর ৩৭০ কার্যদিবস শুনানি গ্রহণ করেছি। শুধুই মামলার অাটশ ৫০ জন আসামি এ রায় শোনার জন্য অপেক্ষা করছেন না, দেশের অনেকেই রায় জানতে চান। কেউ কেউ নির্ঘুম রাত কাটাবে। তাই আমাদের দায়বদ্ধতা আছে। এটা অনেক বড় রায়। আমরা একটা ভালো রায় দেয়ার চেষ্টা করছি। তাই একটু ধৈর্য ধরতে হবে। আমাদের পর্যবেক্ষণ আলাদা আলাদা থাকতে পারে। তবে আমাদের গন্তব্য এক। রায়ের আদেশের অংশের বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি। এ রায় ঘোষণার জন্য আমাদেরও রক্তচাপ বেড়ে গেছে। সোমবার সকাল সাড়ে ১০টায় আবার আদালত বসবে এবং বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার তার পর্যবেক্ষণ সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরবেন। আশা করি, আগামীকাল (সোমবার) দুপুরের আগেই আমরা মূল রায় দেয়া শুরু করতে পারব।’
রোববার বেলা ১০টা ৫৫ মিনিটে বিচারপতি মো. শওকত হোসেন রায় ঘোষণা শুরু করেন। তার কিছু পর্যবেক্ষণ দেয়ার পরই বেঞ্চের অপর সদস্য বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী তার পর্যবেক্ষণ দেয়া শুরু করেন। বিকেল পর্যন্ত তিনি পর্যবেক্ষণের ঘোষণা দেন। সোমবার সকালে বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার তার পর্যবেক্ষণ ঘোষণা করবেন। এরপরই মূল রায় (আদেশের অংশ) দেয়া শুরু হবে। সোমবার বেলা সাড়ে ১০টার পর থেকে আদেশের অংশ ঘোষণা শুরু হতে পারে বলে আদালত জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, আগামীকাল (সোমবার) মূল রায় ঘোষণা করা হবে বলে আশা করি। রায়ে কতজনের মৃত্যুদণ্ড, কতজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে, কার সাজা বহাল হবে, কাকে খালাস দেয়া হবে-সে বিষয়ে তিন বিচারপতিই একমত হয়েছেন।
আদালতে বিচারপতি মো. শওকত হোসেন তার পর্যবেক্ষণে বলেন, পিলখানায় হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে দেশে একটা ভয়াবহ ও ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়। ওইদিন ৫৭ জন মেধাবী সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যা করা হয়। এমনকি বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) মহাপরিচালকের স্ত্রীকেও হত্যা করা হয় নৃসংশভাবে।
তিনি বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও এতসংখ্যক সেনা কর্মকর্তা নিহত হয়নি। এটা ছিল নির্বিচারে হত্যা (মাস কিলিং)। ওইদিন দেশের সূর্য সন্তানদের হত্যা করা হয়। তাদের বিদেহী আত্মার প্রতি গভীর শোক ও সমবেদনা জানাচ্ছি। তাদের পরিবারের সদস্যদের প্রতিও সমবেদনা জানাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশের বিচার বিভাগের জন্য এটা একটি ঐতিহাসিক মামলা। এ মামলার বিচারকালে বেশকিছু আইনগত প্রশ্ন ওঠে। আপিল বিভাগে রাষ্ট্রপতি রেফারেন্স পাঠান। আপিল বিভাগের সিদ্ধান্তের পর বিচার শুরু হয়।
পিলখানার এ ঘটনায় ২০০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর লালবাগ থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। পরে এসব মামলা নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তরিত হয়। মামলায় সিআইডি দীর্ঘ তদন্ত শেষে হত্যা মামলায় ২৩ বেসামরিক ব্যক্তিসহ প্রথমে ৮২৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে। পরে সম্পূরক অভিযোগপত্রে আরও ২৬ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত করায় আসামির সংখ্যা হয় ৮৫০ জন। এছাড়া বিস্ফোরক আইনে করা মামলায় ৮০৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয় সিআইডি। পরে আরও ২৬ জনকে অভিযুক্ত করে মোট ৮৩৪ জনের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয়া হয়।
রাজধানীর পুরান ঢাকার আলিয়া মাদরাসা মাঠে স্থাপিত ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক ড. মো. আখতারুজ্জামান ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর ইতিহাসের কলঙ্কজনক এ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন, ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে (তিন বছর থেকে ১৭ বছর পর্যন্ত) কারাদণ্ড, ২৭৮ জনকে খালাস এবং চারজন আসামি বিচার চলাকালে মারা যাওয়ায় মামলার দায় থেকে তারা অব্যাহতি পায়।
আদালতের রায় ঘোষণার পর ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে আসামিরা দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল ও জেল আপিল করেন। এর মধ্যে ৬৯ জনকে খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। গুরুত্বপূর্ণ এ মামলার শুনানির জন্য সুপ্রিম কোর্ট বিশেষ উদ্যোগ নেন। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এই মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানির জন্য বিশেষ বেঞ্চ গঠন করে দেন। দেশের ইতিহাসে আসামির সংখ্যার দিক দিয়ে সবচেয়ে বড় এ মামলায় ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের ওপর ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে শুনানি শুরু হয়। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের পর গত ১৩ এপ্রিল মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন আদালত।
মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিতরা সবাই বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিডিআর) সদস্য ছিলেন। যাবজ্জীন কারাদণ্ডে দণ্ডিতদের মধ্যে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু ও আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীও রয়েছেন। এর মধ্যে নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু ২০১৫ সালের ৩ মে রাজশাহী কারাগারে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
এ মামলায় হাইকোর্টে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা, মোমতাজ উদ্দিন ফকির, মোশাররফ হোসেন কাজল, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোশাররফ হোসেন সরদার, শেখ বাহারুল ইসলাম ও জাহিদ সরওয়ার কাজল।
আসামিপক্ষে আইনজীবী ছিলেন খন্দকার মাহবুব হোসেন, আবদুল বাসেত মজুমদার, মহসীন রশীদ, এস এম শাহজাহান, এ এস এম আবদুল মুবিন, মো. আমিনুল ইসলাম, দাউদুর রহমান মিনা ও শামীম সরদারসহ আরও অনেকে। আসামিপক্ষে রাষ্ট্র নিয়োজিত আইনজীবী ছিলেন হাসনা বেগম।
এফএইচ/জেডএ/আরআইপি