প্রধান বিচারপতির দীর্ঘ ছুটির নজির : আছে কি নেই

মুহাম্মদ ফজলুল হক
মুহাম্মদ ফজলুল হক মুহাম্মদ ফজলুল হক , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৪:৩২ পিএম, ০২ অক্টোবর ২০১৭

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের চূড়ান্ত রায়ের পর দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন ছিল সরগরম। আলোচনা-সমালোচনার রেশ ‘শিথিল হওয়ার’ এই ক্ষণেই নতুন করে আলোচনায় এলেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (এসকে সিনহা)।

প্রধান বিচারপতির এক মাসের ছুটির বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, প্রধান বিচারপতির ছুটি নজিরবিহীন নয়।  তবে অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছেন বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা।

সাবেক আইনমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, যেকোনো কারণে প্রধান বিচারপতি ছুটিতে যেতেই পারেন। এর সঙ্গে অন্যকিছু মেলান ঠিক হবে না। তিনি যেহেতু ছুটিতে গেছেন এখন বিষয়টি রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে যাবে।

ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের পর রাজনৈতিক টানাপোড়েন সৃষ্টি হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এই ছুটি কি না- এর জবাবে সাবেক আইনমন্ত্রী বলেন, এটা তো মন্তব্য করার বিষয় না। যেহেতু বিষয়টি নিয়ে সংসদে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে যে, ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের মন্তব্য নিয়ে রিভিউ করা হবে। ষোড়শ সংশোধনীর বিষয়টি রিভিউর মাধ্যমে সমাধান হবে।

ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, এখানে রাজনৈতিক কোনো টানাপোড়েন আছে বলে আমি মনে করি না।

প্রধান বিচারপতির ছুটিতে যাওয়ার বিষয়ে আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম জাগো নিউজকে বলেন, ব্যক্তিগত কারণে যেকোনো বিচারপতি স্বাভাবিকভাবেই ছুটিতে যেতে পারেন।

ষোড়শ সংশোধনী ও আদালতে পাকিস্তানের প্রসঙ্গ ও সরকারের সঙ্গে বিচার বিভাগের টানাপোড়েনের কারণে এই ছুটি কি না? জবাবে তিনি বলেন, কখনোই না। আমি আওয়ামী লীগের আইন সম্পাদক হিসেবে বলছি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে বিচার বিভাগ কখনোই কোনো চাপে ছিল না। বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন। বিচারপতি ব্যক্তিগত কারণে ছুটিতে যেতেই পারেন। এটা স্বাভাবিক বিষয়।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও বিএনপি চেয়ারপাসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহাবুব হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে আজ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। পরে কথা বলবেন বলে জানান।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও বিএনপির চেয়ারপাসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন জাগো নিউজকে বলেন, অ্যাটর্নি জেনারেল একটি নজির দেখাক? কোন প্রধান বিচারপতি একসঙ্গে এত লম্বা ছুটিতে গেছেন? আমরা এ রকম ঘটনা অতীতে দেখিনি।

তিনি বলেন, কারও অসুস্থতা, ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সমস্যা থাকলে তিনি হয়ত দু-তিনদিনের ছুটিতে যেতে পারেন। দু-একদিনের ছুটিতে যাওয়ার পর তার সমস্যা সমাধান না হলে আবার তো ছুটি নিতে পারেন। কেন তিনি এতদিনের ছুটিতে যাবেন?

‘কোর্ট খোলার দিন গেট টুগেদারের দিনক্ষণ নির্ধারিত রয়েছে। আইনজীবীরা সকলে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন, বারের সবাই গেট টুগেদার করবেন। হঠাৎ প্রধান বিচারপতি ছুটিতে চলে গেলেন। তার মানে তো তিনি গেট টুগেদারে উপস্থিত থাকছেন না।’

জয়নুল আবেদীন বলেন, বারের আইনজীবীরা ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন, আমাদের জবাবদিহি করতে হয়। আমরা সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে ওনার (প্রধান বিচারপতির) কাছে গিয়েছিলাম, ছুটিতে যাওয়ার কারণ জানার জন্য। প্রথমে উনি বলেছেন, অসুস্থ তাই দেখা করতে পারবেন না। তারপর কী কারণে ছুটিতে যাচ্ছেন জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, এখন ছুটির বিষয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলবেন না।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিরু সাবেক সম্পাদক ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল জাগো নিউজকে বলেন, হঠাৎ করে প্রধান বিচারপতির দীর্ঘদিন ছুটিতে যাওয়ার ঘটনা গত ৩০ বছরে কখনও দেখিনি। বিচারপতির কোনো সমস্যা থাকলে দু-একদিনের ছুটিতে যেতে পারেন, দীর্ঘ এক মাসের ছুটির বিষয়টি নজিরবিহীন।

বাদল বলেন, এখানে তো বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগের বিষয় রয়েছে। কারণ আপিল বিভাগের বিচারপতির সংখ্যা কম আবার প্রধান বিচারপতির ছুটি, সব মিলিয়ে বেঞ্চ বসবে কয়টা? আগে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি বেঞ্চ বিচার কার্যক্রম পরিচালনার পর অপর একটি বেঞ্চে (জ্যেষ্ঠ বিচারপতি) বিচার পরিচালনা করতেন। এখন দ্বিতীয় বেঞ্চ বসার সুযোগ নেই। এখন হাইকোর্টের ডিভিশনাল মামলাগুলো শুনানি হবে না।

তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্টের সম্পাদক গেট টুগেদারের খুদে বার্তা (এসএমএস) দিয়ে আসছেন, কিন্তু আজ তো দেখছি প্রধান বিচারপতির অনুপস্থিতিতে গেট টুগেদার অনুষ্ঠানেরও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

আইনজীবী বাদল আরও বলেন, এর আগে দেখতাম কোর্ট খোলার আগের দিন আপিল বিভাগের কজলিস্ট সুপ্রিম কোর্টের ওয়েব সাইটে তিনটার দিকেই দেখা যেত। কিন্তু প্রধান বিচারপতি ছুটিতে যাওয়ার দিনে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েব সাইটে কোন কজলিস্ট দেখছি না। এসব বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।

প্রসঙ্গত, সোমবার প্রধান বিচারপতি ছুটি সংক্রান্ত একটি চিঠি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়েছেন। সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি একজন ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেবেন।

আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক এ প্রসঙ্গে বলেন, সোমবার অসুস্থতার কারণে প্রধান বিচারপতি ছুটিতে গেছেন। প্রধান বিচারপতি নিজের ছুটি নিজেই মঞ্জুর করেছেন। যেহেতু আমাদের ছুটির বিষয়ে তিনি একটি ইনটিমিশন দিয়েছেন, সেহেতু ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করতে হবে। এখন সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি একজন অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেবেন।

প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির বেঞ্চ ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় ঘোষণা করেন। ওই মূল রায়টি লেখেন প্রধান বিচারপতি। তিনি রায়ে বাংলাদেশে রাষ্ট্র-সমাজ, রাজনীতি, নির্বাচন কমিশন, সংসদ সামরিক শাসন প্রভৃতি নানা বিষয়ে পর্যবেক্ষণ দেন। রায়ের পর প্রধান বিচারপতি সরকারি দলের সমালোচনার মুখে পড়েন। এ সময় প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের দাবিও ওঠে।

জাতীয় সংসদেও প্রধান বিচারপতির সমালোচনা করেন এমপিরা। একই সঙ্গে এই দাবিও ওঠে যে, চলতি অবকাশের পূর্বে প্রধান বিচারপতিকে পদত্যাগ করতে হবে।

এফএইচ/একে/এমএআর/বিএ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।