‘ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্য’

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৫:৫৩ পিএম, ০৯ আগস্ট ২০১৭

আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বলেছেন, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে আপিল বিভাগের দেয়া রায়ে পাতার পর পাতা অযৌক্তিক ও অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্য করা হয়েছে। প্রায় চারশ পৃষ্ঠা অপ্রাসঙ্গিক লেখা হয়েছে।

বুধবার আইন কমিশন কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব এ কথা বলেন। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর নিরপেক্ষভাবে মতামত জানানোর জন্য আইন কমিশনের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে আপিল বিভাগের দেয়া রায়কে ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, অপরিপক্ব ও পূর্ব পরিকল্পিত’ বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। তিনি বলছেন, এই রায়ের বিষয়টি শুনানির আগেই প্রধান বিচারপতির মনে একটি ধারণা হিসেবে ছিল বলে তার মনে হয়েছে।

আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, ‘এই রায় হওয়ার আগে থেকেই কি এটা প্রিকনসিভড নোশন ছিল, যে পার্লামেন্ট ডিসফাংশনাল, পার্লামেন্টের সদস্যরা ইমম্যাচিউরড, অশিক্ষিত, অজ্ঞ এই কথাগুলো যদি রায়ের আগে থেকেই বলে থাকেন তাহলে তো বলা হবে, এই রায় এবং এর শুনানি আগে থেকেই প্রিকনসিভড। শুনানি করার সময় উনার মনের মধ্যেই ছিল।’

এটা ‘ভালো বিচারকের আচরণ’ নয় বলেও মন্তব্য করেন সাবেক এই প্রধান বিচারপতি। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পর রায় নিয়ে কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এই প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিক্রিয়া জানানো হলো।

বিচারপতি খায়রুল হক বলেন, ‘কোনো মামলার রায় ঘোষণা হয়ে গেলেই সেটা জনগণের। প্রকাশিত রায় নিয়ে প্রত্যেক নাগরিকের সমালোচনা করার অধিকার রয়েছে। কেউ সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন। এমন কি সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত।’

তবে সুপ্রিম কোর্ট ভুল করলে মানুষ যাবে কোথায় এমন প্রশ্ন রেখে খায়রুল হক বলেন, ‘যার যার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রায়ের সমালোচনা করা যেতে পারে। এটা নিয়ে আইনগত কোনো বাধা নেই।’

সর্বোচ্চ আদালতের দেয়া রায়ের বিভিন্ন প্রসঙ্গ টেনে সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক বলেন, ‘আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় পড়ে দেখেছি, এতে অনেক অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্য রয়েছে। রায়ে সংবিধানের অপব্যাখ্যা করা হয়েছে। তাই সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ফিরিয়ে আনতে হলে আবারও সংবিধান সংশোধন করতে হবে। মূল সংবিধানে যেহেতু সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ছিল না, সেহেতু এটা রাখা সংবিধান পরিপন্থী।’

তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘রায়ে পাতার পর পাতা অযৌক্তিক ও অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্য করা হয়েছে। প্রায় চারশ পৃষ্ঠা অপ্রাসঙ্গিক লেখা হয়েছে রায়ে। যা বাঞ্ছনীয় নয়, প্রয়োজন ছিল না। অযাচিত মন্তব্য করে রায়ের কলেবর বৃদ্ধি করা হয়েছে।’

খায়রুল হক বলেন, ‘সংসদ সদস্যদের যোগ্যতা নিয়ে রায়ের পর্যবেক্ষণে নানা মন্তব্য করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের মতো এপেক্স কোর্ট এমন আচরণ করতে পারেন না। বিচার বিভাগের বাইরে গিয়েও মন্তব্য করা হয়েছে। যা প্রয়োজন ছিল না। একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, আরেকটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে অপরিপক্ব বলা ঠিক নয়।’

তিনি বলেন, ‘আমরা লক্ষ্য করছি, এই রায় দেয়ার আগে থেকে কয়েকজন বিচারপতি বিভিন্ন সেমিনারে সংসদ সদস্যদের নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছেন। তাহলে বলা হয়, মামলার রায় দেয়ার আগে এবং শুনানির আগে থেকেই এ ধরনের রায় দেয়ার পরিকল্পনা ছিল। এই প্রথম কোনো রায়ে মূল সংবিধানকে বাদ দিয়ে সামরিক শাসনের পক্ষে গেছে।’

তিনি বলেন, ‘উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে সংসদের হাতেই ছিল। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর সময়ে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত করা হয়। পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় গিয়ে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী এনে বিচারক অপসারণের বিষয় নিষ্পত্তির ভার দিতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করেন। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে সেই ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরে গেলেও আপিল বিভাগের রায়ে তা বাতিল হয়ে যায়।’

তিনি বলেন, ‘সংসদ সদস্যরা স্বাধীন। তারা দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে ভোট দিতে পারেন না। সংসদের বিল যায়, বিলের ওপর ভোট হয়। সেটা কোনো দলের বিরুদ্ধে যায় না।’

সাবেক এই প্রধান বিচারপতি আক্ষেপ করে বলেন, ‘সংবিধানে ১ নম্বর অনুচ্ছেদে গণপ্রজাতন্ত্রের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই রায় দেশকে বিচারিক প্রজাতন্ত্রের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। রায় পড়ে মনে হয়েছে, মূল সংবিধানকে বাদ দিয়ে মার্শাল ল’ আমলে চলে যাওয়ার চেষ্টা চলছে।’

খায়রুল হক বলেন, ‘রায়ে প্রধান বিচারপতি লিখেছেন, প্রধান বিচারপতি হিসেবে তাকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান না করা হলে বিচারকরা তার কথা শুনবেন না। এটা তো হতে পারে না। এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা স্বাধীন তা সংবিধানেই উল্লেখ আছে।’

তিনি প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি কি প্রধান শিক্ষক, আর অন্যান্য বিচারপতিরা ছাত্র নাকি যে, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে তাকে (প্রধান বিচারপতি) অন্যান্য বিচারপতিদের পরিচালনা করতে হবে?’

সংবাদ সম্মেলনে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ছাড়াও আইন কমিশনের সদস্য বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর ও গবেষণা কর্মকর্তা ফজলুল করিমসহ অন্যান্য কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।

এফএইচ/বিএ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।