রিভিউ হলেই খারিজ হয়ে যাবে এমনটা নয়


প্রকাশিত: ০৩:২৬ পিএম, ১৪ মে ২০১৭

প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহা বলেছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে রিভিউ ব্যবস্থা ছিল না। আমরা আপিল বিভাগ সেটা দিয়েছি ন্যায়বিচারের স্বার্থে। আমরা চাই না বিচার বিভাগ প্রহসনের হোক।

সাঈদীর আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন শুনানি শেষ করার পর প্রধান বিচারপতি অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে জানতে চান রাষ্ট্রপক্ষ শুনানি করবে কি না। জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সম্মতি জানিয়ে বলেন, আমি তো মৃত্যুদণ্ড চাই। তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, রিভিউ হলেই যে তা খারিজ হয়ে যাবে এমনটা নয়।

মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডের সাজা থেকে খালাস চেয়ে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর করা রিভিউ আবেদন এবং মৃত্যুদণ্ড চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা রিভিউ আবেদনের ওপর আপিল বিভাগে শুনানি শুরু হয়েছে।

রোববার প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম দিন সাঈদীর করা আবেদনের ওপর তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন শুনানি করেন। তার শুনানি শেষে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের ওপর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম শুনানি শুরু করেন। এ অবস্থায় সোমবার আবার শুনানির জন্য দিন নির্ধারণ করেন আদালত।

দুপুর ১২টায় শুনানির শুরুতেই রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বক্তব্য উপস্থাপন করতে গেলে প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনি কেন। জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমি তো রিভিউ চেয়েছি। প্রধান বিচারপতি বলেন, এটা মি. হোসেনের (খন্দকার মাহবুব হোসেন) বিষয়। তিনি তো খালাস চেয়েছেন। আপনি তো (অ্যাটর্নি জেনারেল) ফাঁসি চেয়েছেন। এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল হ্যাঁ সূচক জবাব দেন।

এরপর প্রধান বিচারপতি সাঈদীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনকে বলেন, ‘আগে যদি খালাসের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়ে যায়, রিভিউ যদি গ্রহণ করি, খালাস দিলে কি ফাঁসি দিতে পারব? রিভিউয়ের বিষয় আসে না। মি. হোসেন, আসল রিভিউ তো আপনারটি।’

এরপর খন্দকার মাহবুব হোসেন শুনানি শুরু করেন। তখন প্রধান বিচারপতি তাকে প্রশ্ন করেন, কয়টা অভিযোগে যাবজ্জীবন? কয়টা অভিযোগের বিষয়ে শুনানি করতে চান? জবাবে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, তিনটি। ১০, ১৬, ১৯ নম্বর অভিযোগ।

এরপর খন্দকার মাহবুব হোসেন তার লিখিত যুক্তিতর্কের কপি আদালতে জমা দেন। তিনি প্রথমে ১০ নম্বর অভিযোগের ওপর শুনানি শুরু করেন। জমা দিয়ে চার্জ-১০ এ যুক্তিতর্ক শুরু করার কিছু সময় পর প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এখানে তো বললেন না যে সাক্ষীরা জীবিত আছে। এটা ৪১, ৪২, ৪৫ বছর রাজনৈতিক মেরুকরণ, আত্মীয়তা, বিয়ে-টিয়ে করে অনেক পরিবর্তন চলে আসছে। বুড়িগঙ্গার পানি গড়িয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে বাষ্প হয়ে চেরাপুঞ্জি, হিমালয়ে গিয়ে সেখানে বরফ গলে প্রশান্ত মহাসাগরে গিয়ে পড়েছে।’

একপর্যায়ে একাত্তরে পিরোজপুর ছেড়ে সাঈদীর যশোরে থাকার প্রসঙ্গ আসে। এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যখন পালিয়ে বেড়াচ্ছে তখন ওয়াজ করার জন্য আপনি পরিবার-পরিজন নিয়ে যশোরে গিয়েছিলেন সে যুক্তি কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। সাধারণত ওয়াজ হয় ধানকাটার পর শীতকালে। আপনি বলেছেন, মে মাসে। মে মাসে তো বর্ষাকাল। এখনও কি এই সময়ে ওয়াজ হয়? এখন তো অনেক উন্নতি হয়েছে, তারপরও কি মার্চ-এপ্রিল কিংবা মে মাসে ওয়াজ হয়?

জবাবে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, হয় একটা বৃহৎ পরিসরে, আরেকটি ছোট পরিসরে। তাছাড়া সাঈদী লেখাপড়া করার জন্যই পরিবার নিয়ে সেখানে ঘর ভাড়া করে থাকতেন।

প্রধান বিচারপতি বলেন, না, হয় না। আমার প্রশ্ন অন্য জায়গায়। আপনি তো পেশাদার বক্তা। আপনাকে প্রমাণ করতে হবে আপনি ছিলেন না। একজন শুধু ওয়াজ করার জন্য বাসা ভাড়া করে থাকবে? আপনি বিবাহিত, বউ-বাচ্চা আছে। এটা অগ্রহণযোগ্য। শোনেন, শোনেন, বলা উচিত না, তাও বলতে হয়। মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই হচ্ছে। আমাদের কাছে তথ্য আছে, যারা এই কমিটিতে আছে তাদের অনেকেই সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষের লোক। তাদের কেউ কেউ এখন কমিটির চেয়ারম্যান। এ পর্যায়ে অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, আমি তো সাঈদী হলাম সেদিন, মামলা-টামলা হওয়ার পরে।

প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনি তো তখন দেলাওয়ার হোসেন শিকদার ছিলেন। বলা হচ্ছে, আমাদের সন্দেহ লাগছে, মে মাসের পর আপনি (সাঈদী) এলাকাতে যান, এটা আমাদের পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন। অনেক মামলাতেই ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়েছে। খেয়াল করে দেখবেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মতে আমরা ফাঁসিও দিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু তা না করে তথ্য-প্রমাণ ও অন্যান্য বিষয়ের উপর বিবেচনা করে এ মামলায় সাজা কমানো হয়েছে।

এরপর প্রধান বিচারপতি অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে জানতে চান রাষ্ট্রপক্ষ শুনানি করবে কি না। জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল সম্মতি জানিয়ে বলেন, আমি তো মৃত্যুদণ্ড চাই। তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে রিভিউ ব্যবস্থা ছিল না। আমরা আপিল বিভাগ সেটা দিয়েছি ন্যায়বিচারের স্বার্থে। তাই আমরা চাই না বিচার বিভাগ প্রহসনের হোক।

প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, রিভিউ হলেই যে তা খারিজ হয়ে যাবে এমনটা নয়। এ মামলায় আমরা সাক্ষ্য-প্রমাণসহ সামগ্রিক দিক বিবেচনা করে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছি। এ রায় দেয়ার আগে আমরা বিচারপতিরা পর্যালোচনা বৈঠক করেছি। এরপর সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছে। আপনারা দেখেছেন এ মামলায় দ্বিধাবিভক্ত রায় হয়েছে। আর আপিল বিভাগ শুনানির পর কাউকে সাজা দেয়, রিভিউতে সেটা পরিবর্তন খুবই দুষ্প্রাপ্য।

অ্যাটর্নি জেনারেলকে আপিল বিভাগ বলেন, আপনি বরং এ সাজা কীভাবে বহাল থাকে তারপক্ষে যুক্তি দেখান। এজন্য আইনের বিভিন্ন ধারা দেখে আসবেন। এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল প্রস্তুতির জন্য সময় চান। পরে আদালত সোমবার পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করেন।

২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল করেন সাঈদী। এ আপিলের ওপর শুনানি শেষে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগে পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সাঈদীর বিরুদ্ধে দেয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশের সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন। রায়ে তিন বিচারপতি সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড, একজন খালাস ও একজন মৃত্যুদণ্ড দেন।

২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে ৬১৪ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়। এরপর গত বছর ১২ জানুয়ারি সাঈদীর মৃত্যুদণ্ড চেয়ে ৩০ পৃষ্ঠার রিভিউ আবেদন দাখিল করেন রাষ্ট্রপক্ষ। এরপর একই বছরের ১৭ জানুয়ারি খালাস চেয়ে ৯০ পৃষ্ঠার রিভিউ আবেদন করেন সাঈদী।

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগের এক মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন সাঈদীকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। সেই থেকে তিনি কারাবন্দী।

এফএইচ/জেডএ/ওআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।