বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রশ্নে আইনজীবীদের ভিন্ন মত


প্রকাশিত: ০২:১৪ পিএম, ০২ মে ২০১৭

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রশ্নে প্রধান বিচারপতি, প্রধানমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রীর সাম্প্রতিক বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় পাল্টাপালি সংবাদ সম্মেলন করেছে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির দুই অংশ।

সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন ও সাধারণ সম্পাদক এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকনের আহ্বানে অনুষ্ঠিত প্রথম সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, দেশের গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মানবাধিকার ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষায় আইনজীবী সমিতি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে আসছে।

সম্প্রতি প্রধান বিচারপতির একটি বিশেষ বক্তব্যকে কেন্দ্র করে প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রীর বক্তব্য আইনজীবী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি এবং কিছু প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে। বিচার বিভাগ নিয়ে জনমনে কোনো রকম সংশয় ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি হোক তা আমরা চাই না বলে বিএনপি-সমর্থিত আইনজীবীদের সংবাদ সম্মেলন থেকে বলা হয়।

এর কিছুক্ষণ পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনকে ‘দুঃখজনক’ ও ‘অনভিপ্রেত’ উল্লেখ করে পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করেন সমিতির সহ-সম্পাদক মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম, সহ-সভাপতি মো. অজি উল্লাহ ও কোষাধ্যক্ষ রফিকুল ইসলাম হিরুসহ সমিতির কয়েকজন নেতা।

s-cort

তারা বলেন, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য টুইস্ট করে তার বিপরীতে প্রতিক্রিয়া দেয়া আইনজীবী সমিতির দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। সমিতির এ রকম প্রতিক্রিয়া জনগণের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে এবং রাষ্ট্রের বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের মাঝে বিরাজমান সম্প্রীতির মধ্যে ফাটল ধরাতে পারে।

মঙ্গলবার দুপুর দেড়টায় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির শহীদ শফিউর রহমান মিলনায়তনে প্রথম সংবাদ সম্মেলনের পর পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করে সমিতির অপর অংশ। এ অংশ আওয়ামী লীগ-সমর্থিত আইনজীবী হিসেবে পরিচিত।

উভয় সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যের বাইরে সমিতির নেতারা কোনো মন্তব্য করেননি, এমনকি সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্নের উত্তরও দেননি।

প্রথম সংবাদ সম্মেলনে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন লিখিত বক্তব্যে বলেন, সম্প্রতি প্রধান বিচারপতি বলেছেন, প্রশাসন কোনো দিনই চায়নি এখনও চায় না বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করুক।

এর জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘অন্য কোনো দেশে প্রধান বিচারপতিরা প্রকাশ্যে এত কথা, এত উষ্মা প্রকাশ করেন না। কোনো দুঃখ কষ্ট থাকলে তা প্রকাশ্যে না বলে নির্বাহী বিভাগকে জানান।’

আইনমন্ত্রীর এমন বক্তব্যে জয়নুল আবেদীন লিখিত বক্তব্যে বলেন, ‘বিচারকি দায়িত্ব কোনো গোপন বিষয় নয়। মাজদার হোসেন মামলার পরে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে অনেক কথা হয়েছে।

বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা, বিধি প্রণয়নের জন্য সর্বোচ্চ আদালত অনেক দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। এরপরও চাকরির বিধি-বিধান, গেজেট আজ পর্যন্ত প্রকাশ হয়নি। সরকার এখন পর্যন্ত মোট ৬৭ বার সময় নিয়েছে।’

‘সুতরাং প্রধান বিচারপতির গোপনে কিছু বলার নাই। সরকার বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করুক তা যে চায় না, এ সময়ক্ষেপণ তারই প্রমাণ।’

highcourt

লিখিত বক্তব্যে জয়নুল আবেদীন আরও বলেন, ‘আইন প্রণয়নে সংবিধান মানা হয় কিনা এবং নির্বাহী বিভাগের কাজ সংবিধান অনুযায়ী হয় কিনা- তা সংবিধানের অভিভাবক হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের দেখার দায়িত্ব। অন্য দেশে আইনের শাসন, মানবাধিকার ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আছে বলেই সেসব দেশের প্রধান বিচারপতিদের এত কথা বলতে হয় না।’

তিনি বলেন, ‘যদি আইন বিভাগ সংবিধান মোতাবেক আইন প্রণয়ন না করেন বা সংবিধান পরিবর্তন করেন, সুপ্রিম কোর্টের এখতিয়ার রয়েছে সেই আইন বাতিল করার। রাষ্ট্রের আইন বিভাগ স্বাধীনভাবে আইন প্রণয়ন করতে পারছে কিনা, শাসন বিভাগ আইন যথাযথভাবে পালন করছেন কিনা- এসব বিষয় দেখার এখতিয়ার ও দায়িত্ব বিচার বিভাগের। তাই আমরা সকল মহলকে বিচার বিভাগ সম্পর্কে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে মন্তব্য করার অনুরোধ করছি।’

এ সময় আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উদ্দিন খোকন প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সমালোচনা করে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীকে যারা পরামর্শ দেন তারা ভুল পরামর্শ দেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সমন্বয় করে চলতে হবে। আমি বলব, বিচারকি কিন্তু সমন্বয় করে দেয়া যায় না।’

আইনজীবী সমিতির সহ-সভাপতি উম্মে কুলসুম রেখা, সহ-সম্পাদক শামীমা সুলতানা দীপ্তি এবং কার্যনির্বাহী সদস্য মো. হাসিবুর রহমান, মহসিনা আক্তার ও শেখ তাহসিন আলী এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

একই ভেন্যুতে বিএনপি-সমর্থিত আইনজীবীদের সংবাদ সম্মেলনের পরপরই আওয়ামী-সমর্থিত আইনজীবীরা সংবাদ সম্মেলন করেন। তাদের পক্ষে সিনিয়র সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. অজি উল্লাহ লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন।

লিখিত বক্তব্যে অ্যাডভোকেট অজি উল্লাহ বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্মানিত সভাপতি ও সম্পাদকের উদ্যোগে যে সংবাদ সম্মেলন হয়েছে তা অত্যন্ত দুঃখজনক ও অনভিপ্রেত। কারণ, যে সকল তুচ্ছ অজুহাতে এ সংবাদ সম্মেলন হয়েছে, তাতে বিচার বিভাগেরই মর্যাদাহানি হয়েছে। এ সংবাদ সম্মেলন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এ ধরনের সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বার কিংবা বিচার বিভাগের কোনো স্বার্থ রক্ষা হয়নি, হবেও না।’

বিচার বিভাগ নিয়ে সরকারের সাম্প্রতিক বক্তব্য সমর্থন করে তিনি বলেন, ‘সরকারের কেউই বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় কিংবা বিচার বিভাগের কোনো ভাবমূর্তি ক্ষণ্ন হয় এমন কোনো বক্তব্য প্রদান করেননি, যাতে আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সম্পাদকের এ সংবাদ সম্মেলনের প্রয়োজন ছিল। এছাড়া আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সম্পাদক সমিতির কার্যকরী অন্যান্য সদস্যের সঙ্গে কোনো প্রকার আলোচনা ছাড়াই এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। আমরা তাদের সম্মেলনের তীব্র নিন্দা জানাই।’

পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলন করলেও সুপ্রিম কোর্ট বারে কোনো বিভক্তি নেই বলেও দাবি করেন মো. অজি উল্লাহ। আইনজীবীদের পেশাগত বিষয়ে তারা এক বলেও উল্লেখ করেন তিনি। বলেন, ‘রাজনৈতিক সমর্থন নিয়ে নির্বাচিত হওয়ায় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে।’

কোষাধ্যক্ষ রফিকুল ইসলাম হিরু, সহকারী সেক্রেটারি শফিকুল ইসলাম এবং কার্যনির্বাহী সদস্য নূরে আলম উজ্জল, কুমার দেবুল দে ও হাবিবুর রহমান এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

এফএইচ/এমএআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।