পিলখানা হত্যা মামলার আপিল শুনানি ৩৫৯ কর্মদিবসে
বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম জঘন্য ও বর্বরোচিত পিলখানা হত্যা মামলার (বিডিআর হত্যা মামলা হিসেবে পরিচিত) ডেথ রেফারেন্স ও কারাবন্দি আসামিদের দায়ের করা সকল ফৌজদারি আপিলের ওপর হাইকোর্টের শুনানি চলছে। সর্বাধিক আসামির মৃত্যদণ্ড ঘোষণা করে দেয়া রায়ের মামলায় ৩৫৯ কার্যদিবসে আপিল শুনানি শেষ হয়েছে।
রেকর্ড সংখ্যক দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির এই মামলায় ডেথ রেফারেন্স ও জেল আপিল শুনানি শুরুর পর বিচারপ্রার্থীরা এর দীর্ঘসূত্রিতা নিয়ে অভিযোগ তুলেছেন। তবে অভিযোগ অস্বীকার করেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
তিনি বলেন, ঐতিহাসিক এই মামলায় রেকর্ড সংখ্যক আসামির মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়েছে। দণ্ডপ্রাপ্তদের বিষয়ে রায় ও সাক্ষীর জবানবন্দি ও হাজার হাজার পৃষ্ঠার নথি-পত্র পর্যালোচনা করে আসামিদের করা আপিলের শুনানি চলছে। বিশাল এই মামলায় দ্রুত সময়ের মধ্যে বিচারিক কাজ শেষ করার সুযোগ নেই। তবে ভিকটিম ও বিচার প্রার্থীদের যে শঙ্কা ছিল মামলার শুনানি কবে নাগাদ শেষ হবে, সেটা এখন আর নেই। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আশা করছি এ বছরের মধ্যেই মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব হবে।
পিলখানায় সেনা কর্মকর্তা হত্যা মামলায় হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইন কর্মকর্তার আইনি যুক্তি উপস্থাপনের জন্য ২ এপ্রিল দিন ধার্য রয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের সময়ের আবেদনে এ দিন ধার্য করা হয়েছে। বিচারপতি মো. শওকত হোসেনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিশেষ (বৃহত্তর) বেঞ্চে ২০১৫ সালের ১৮ জানুয়ারি শুনানি শুরু হয়। বেঞ্চের অপর দুই সদস্য হলেন, বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার।
রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আশা করি এ বছরের মধ্যেই মামলাটি নিষ্পত্তি হবে। মামলাটিতে অনেক আসামি থাকায় তাড়াহুড়ো করার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, একই সাক্ষীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে একজন আসামির মৃত্যুদণ্ড হয়েছে, অপর একজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। আসামিপক্ষের আইনজীবীরা এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এতে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। এ রকম আরও বেশকিছু আইনগত বিষয় উঠেছে। এ কারণে সময় প্রয়োজন।
আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম বলেন, আসামিপক্ষের মৌলিক বিষয়ে যুক্তি উপস্থাপন শেষ হয়েছে। এখন রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি উপস্থাপনের জন্য দিন ধার্য রয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষ হলে তা খণ্ডন করে আসামিপক্ষ যুক্তি উপস্থাপনের সুযোগ পাবে।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জাহিদ সরওয়ার কাজল জাগো নিউজকে জানান, এর আগে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি এক আদেশে আদালত ২৮ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপক্ষের অ্যাটর্নি জেনারেলের যুক্তি উপস্থাপনের দিন ধার্য করেন। এ অবস্থায় ২২ ফেব্রুয়ারি চার সপ্তাহ সময় আবেদন করেন রাষ্ট্রপক্ষ। এরপর উভয়পক্ষের যুক্তি উপস্থাপন চলে কিছুক্ষণ। এ সময় আদালত কিছু আইনগত বিষয়ে আইনজীবীদের কাছে জানতে চান। শুনানি শেষে আদালত পরবর্তী দিন ধার্য করেন।
এ মামলা শুনানির জন্য প্রধান বিচারপতি ২০১৫ সালের ৪ জানুয়ারি তিন সদস্যের বিশেষ বেঞ্চ গঠন করেন। এ বেঞ্চের বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে শুনানি গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করায় তার পরিবর্তে বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারকে দায়িত্ব দিয়ে বেঞ্চ পুনর্গঠন করা হয়। শুনানিতে প্রথমে রাষ্টপক্ষের অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম একশ ৫২ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির মামলার বিষয়বস্তুর উপর যুক্তি উপস্থাপন করেন। তার সঙ্গে রয়েছেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জাহিদ সরওয়ার কাজল। আসামিপক্ষে অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, এসএম শাহজাহান, এএসএম আবদুল মুবিন, মো. আমিনুল ইসলাম, দাউদুর রহমান মিনা, শামীম সরদারসহ অপরাপর আইনজীবীরা যুক্তি উপস্থাপন করেন। এরপর উভয়পক্ষে আইনগত বিষয়ে যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয়। আসামিপক্ষে আইনগত যুক্তি উপস্থাপন শেষে রাষ্ট্রপক্ষ আইনগত যুক্তি উপস্থাপন করবে।
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ও ২৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীতে তৎকালীন বিডিআর(বর্তমানে বিজিবি)সদর দফতরে (পিলখানা) সংঘটিত ট্রাজেডিতে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন। এরপর ওই বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি লালবাগ থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে পৃথক দুটি মামলা হয়। পরে মামলা দুটি নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তর হয়। এরমধ্যে হত্যা মামলায় অভিযোগপত্র দাখিলের পর রাজধানীর লালবাগের আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত বিশেষ আদালতে বিচার করা হয়। বিচার শেষে গত বছরের ৫ নভেম্বর হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ ড. মো. আখতারুজ্জামান। মামলার আসামি ছিল ৮শত ৪৬জন।
এ মামলায় উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) তৌহিদুল আলমসহ ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, বিএনপির সাবেক সাংসদ নাসির উদ্দীন আহম্মেদ পিন্টু (কারাগারে মৃত্যু), স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতা তোরাব আলীসহ ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে আরও ২৫৬ জনকে। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস পেয়েছেন ২৭৭ জন।
নিম্ন আদালতে এ রায়ের বিরুদ্ধে কারাবন্দি ১৩৮ জন ফাঁসির আসামিসহ অন্য আসামিরা হাইকোর্টে আপিল করেন। একইসঙ্গে নিম্ন আদালত থেকে ফাঁসির দণ্ড অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে ডেথ রেফারেন্স। এছাড়া খালাসপ্রাপ্তদের মধ্যে ৬৯ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। এখন এসব আপিল ও ডেথ রেফারেন্স শুনানি চলছে। ২০১৫ সালের ১৮ জানুয়ারি থেকে এ শুনানি শুরু হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৩শ ৫৯ কার্যদিবস শুনানি হয়েছে। এই মামলার শুনানির জন্য সুপ্রিম কোর্ট বিশেষ উদ্যোগ নেয়। বিশেষ ব্যবস্থায় এ মামলার ৩৭টি পেপারবুক তৈরি করা হয়। প্রতিটি পেপারবুক ৩৭ হাজার পৃষ্ঠার বেশি।
এফএইচ/ওআর/এমএস