ঢাবি ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতি : সন্দেহের তীর ইউসিসির দিকে
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র জালিয়াতি যেন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় এর প্রবণতা কিছুটা কমে আসলেও বিভিন্ন ডিভাইস ও কোচিং সেন্টারের দূরদর্শিতায় তা শূন্যের কোটায় বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি)২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে বিভিন্ন ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং সেন্টার ইউসিসি জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে।
জানা গেছে, কোচিং সেন্টারটির যাত্রাবাড়ী ব্রাঞ্চের ম্যানেজার অরুণ কুমার দাসসহ ইউসিসির কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা ও শিক্ষক এ অসাধু কাজে জড়িত। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির অভিযোগে আটক শিক্ষার্থীদের সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
চলতি বছর সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় বাণিজ্য বিভাগ থেকে তৃতীয় স্থান লাভ করে অয়ন কুমার দাস। পরে জালিয়াতির অভিযোগে তাকে থানায় সোপর্দ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এছাড়া বিজ্ঞান বিভাগ থেকে মেধাক্রম ৫ম তাজরিন আহমেদ খান মেধা ও মেধাক্রম ৭৮তম নূর মাহফুজা দৃষ্টি ওরফে নিপুর বিরুদ্ধেও জালিয়াতির প্রমাণ পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
এদের মধ্যে অয়ন কুমার দাস কোচিং সেন্টার ইউসিসি যাত্রাবাড়ী ব্রাঞ্চের এবং মেধা ও দৃষ্টি ইউসিসি বগুড়া ব্রাঞ্চের শিক্ষার্থী। অয়ন ইউসিসি যাত্রাবাড়ী ব্রাঞ্চের ম্যানেজার অরুণ কুমার দাসের ছেলে। ছেলের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন অরুণ কুমার পরীক্ষার দিন সকালে সরবরাহ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
অন্যদিকে ইউসিসির বগুড়া ব্রাঞ্চে কোচিং করা মেধা ও দৃষ্টিকে ব্রাঞ্চের জীববিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষক অর্ণব চৌধুরী মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তাদের প্রশ্ন সংগ্রহ করেছেন বলে জানা গেছে। এছাড়াও ‘ঘ’ ইউনিট ভর্তি পরীক্ষার জালিয়াতির দায়ে আটক আব্দুল্লাহ আল কাজিম মুহসী, তারিকুল ইসলাম তুহিন, এনামুল হক, মিলন হোসেন ও আবু সাঈদ ইউসিসি কোচিং সেন্টারের শিক্ষার্থী বলে জানান তারা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কোচিংয়ে আশানুরূপ পারফরম্যান্স না দেখাতে পারলেও ঢাবির ভর্তি পরীক্ষায় তৃতীয় স্থান লাভ করে অয়ন কুমার। গত শনিবার (৩ ডিসেম্বর) ভর্তি সাক্ষাৎকার দিতে আসলে অয়ন কুমারের পুনরায় ভর্তি পরীক্ষা নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। শুধু বাংলা বিষয়ে ৩০ নম্বরের নেয়া ওই পরীক্ষায় অয়ন কুমার দাস পান মাত্র ৫। অথচ মূল পরীক্ষায় তিনি বাংলায় ২৭ পেয়েছিলেন।
একই অবস্থা বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ৫ম ও ৭৮তম মেধাক্রম অধিকারী মেধা ও দৃষ্টিরও। তাদের দুজনের একজন পুনরায় নেয়া ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করেন এবং অন্যজন সর্বনিম্ন নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হন।
অন্যদিকে অয়ন কুমার দাসসহ তিনজনকে নিয়ে একটি ভিডিও স্ক্রিপ্ট তৈরি করেছে ইউসিসি গ্রুপ। সেখানে অয়ন বলেন, ইউসিসি ছাড়া অন্য কোনো কোচিংয়ে সে ক্লাস করেননি। এছাড়া অয়ন কুমার দাসকে নিয়ে একটি জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তিও ছাপিয়েছে ইউসিসি।
জালিয়াতির অভিযোগে অয়ন কুমারকে একদিন পর থানা থেকে ছাড়িয়ে নেন তার মা মিনু দাস কান্তি ও চাচা চন্দন কুমার দাস। এ বিষয়ে শাহবাগ থানার ওসি আবু বকর সিদ্দিক জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে (অয়ক কুমার দাস) আমাদের হেফাজতে রাখা হয়েছিল। পরে ছেড়ে দিতে বললে ছেড়ে দেয়া হয়।’
এ বিষয়ে অয়ন কুমারের বাবা ইউসিসি যাত্রাবাড়ী ব্রাঞ্চের ম্যানেজার অরুণ কুমার দাসের সঙ্গে যোগাযোগ করলে প্রথমে তিনি তা অস্বীকার করেন। তবে ছেলের জালিয়াতির বিষয়টি এড়িয়ে যাননি।
জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ছেলে (অয়ন কুমার দাস) জালিয়াতি করেছে ঠিক, তাহলে কেন জালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত অন্যদের বিষয়ে নীরব থাকবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন? যদি অয়নকে ভুক্তভোগী হতে হয়, তাহলে অন্যদেরও ছাড় দেয়া যাবে না।
তবে অন্যদের বিষয়ে কিছুই জানাননি তিনি। এ বিষয়ে তার স্ত্রী মিনু দাস কান্তিও কথা বলতে রাজি হননি। এমনকি একপর্যায়ে মুঠোফোনও বন্ধ রাখেন তিনি।
এদিকে ইউসিসি গ্রুপের পরিচালক কামাল উদ্দিন পাটোয়ারী জাগো নিউজকে জানান, তার সঙ্গে অরুণ কুমারের কথা হয়েছে। জালিয়াতির বিষয়ে অরুণ কুমার বলেছেন তারা দুর্নীতি করেনি। যে কারণে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, যারা দুর্নীতি করেছে তারাই দুর্নীতির জবাব দেবে। যদি কেউ সরাসরি জড়িত থাকে তাহলে তার বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ব্যবস্থা নেবে।
তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, মুঠোফোনে কথায় বলার একপর্যায়ে অরুণ কুমারকে চেনেন না বলে দাবি করেন ইউসিসি গ্রুপের পরিচালক কামাল উদ্দিন পাটোয়ারী। যদিও ইউসিসির সব প্রসপেক্টাসে অরুণ কুমারের মোবাইল নম্বর দেয়া রয়েছে।
গত ২১ অক্টোবর (শুক্রবার) অনুষ্ঠিত ‘ক’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির অভিযোগে ১৩ জনকে আটক করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পরে তাদের দুই বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এদের মধ্যে পাঁচজনই ইউসিসির কয়েকজন শিক্ষকের সহযোগিতায় জালিয়াতির কথা স্বীকার করেন। এছাড়া ‘গ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় আটকদের মধ্যেও তিনজন নিজেদের জালিয়াতির সঙ্গে ইউসিসির শিক্ষকের সহযোগিতার কথা জানান।
গত বছর (২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষ) ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির অভিযোগে আটক হাসিবুল হাসান সামু ইউসিসির কোচিং সেন্টারের শিক্ষকের সহায়তায় ৫ লাখ টাকার চুক্তির কথা স্বীকার করেছিলেন। এছাড়া ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে চারটি ইউনিটে জালিয়াতির অভিযোগে আটক সাদনাম আহমেদ সৈকত, জায়েদ হাসান ও বদিউজ্জামান জুয়েলসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী নিজেদের ইউসিসির শিক্ষার্থী হিসেবে স্বীকার করেন।
২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের বিভিন্ন ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির সঙ্গেও বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং ইউসিসি জড়িত বলে অভিযোগ ওঠে। বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক সিনেটর বার্ষিক অধিবেশনে বিভিন্ন প্রমাণসহ জালিয়াতি চক্রের সঙ্গে ইউসিসির সম্পৃক্ততার অভিযোগ আনেন। ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির ঘটনায় সরাসরি ইউসিসিকেই দায়ী করেন তিনি। এমনকি জালিয়াতি চক্রের মধ্যে আটক সাদিয়া সুলতানার স্বীকারোক্তিমূলক ভিডিও চিত্রও দেখানো হয়।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) প্রক্টর অধ্যাপক ড. আমজাদ আলী বলেন, ভর্তি পরীক্ষায় আটকদের মধ্যে অনেকেই ইউসিসির নাম বলেছে। এখনো যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে তারা কোনো না কোনোভাবে ইউসিসির সঙ্গে জড়িত বলে প্রাথমিক তদন্তে ওঠে এসেছে।
সার্বিক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত চক্রের সঙ্গে ইউসিসি নামে একটি কোচিং সেন্টারের নাম আসছে। আমরা অধিকতর তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেব।
এমএইচ/আরএস/পিআর