বর্ষবরণে বোমা হামলা

এক আসামির আত্মপক্ষ শুনানিতে ৩ বছর পার, দুই যুগেও হয়নি বিচার

মিনহাজুল ইসলাম
মিনহাজুল ইসলাম মিনহাজুল ইসলাম , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০১:২৫ পিএম, ১৪ এপ্রিল ২০২৫
ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা

• খালাস ঠেকাতে বিচার শেষ করা হচ্ছেনা: আইনজীবী
• রাষ্ট্রীয় নির্দেশনার দিকে তাকিয়ে আছি: রাষ্ট্রপক্ষ
• হত্যা মামলার রায় হলেও কার্যকর হয়নি মৃত্যুদণ্ড

২০০১ সালে রাজধানীর রমনা পার্কের বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। ওই হামলায় নিহত হন ১০ জন, আহত হন আরও অনেকে। এ ঘটনায় করা হত্যা মামলায় ১১ বছর আগে আটজনকে মৃত্যুদণ্ড ও ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় আদালত। তবে একই ঘটনায় করা বিস্ফোরক আইনের মামলায় ২৪ বছরেও শেষ হয়নি বিচারিক কার্যক্রম।

বিজ্ঞাপন

বিস্ফোরক আইনের আলোচিত এ মামলা বর্তমানে ঢাকার সপ্তম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ সাইফুর রহমানের আদালতে বিচারাধীন। চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি এ মামলায় আসামি আরিফ হাসান সুমনের আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য দিন ধার্য ছিল। তবে বরাবরের মতো এদিনও শুনানি পিছিয়ে আগামী ২০ এপ্রিল নতুন দিন ধার্য করেন বিচারক।

আদালত সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালের ২১ মার্চ বিস্ফোরক মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। রাষ্ট্রপক্ষে মোট ৮৪ জন সাক্ষীর মধ্যে ৫৪ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেন আদালত। ওই বছরের ৩ এপ্রিল আত্মপক্ষ সমর্থনে নিজেদের ‘নির্দোষ’ দাবি করে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করেন সাত আসামি। অন্য আসামিরা পলাতক থাকায় আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাননি। ওইদিন যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য ১১ আগস্ট দিন ধার্য করেন বিচারক।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

বিনা বিচারে জেল খাটাতে এ মামলার বিচার আটকে রাখা হচ্ছে। একজন আসামির আত্মপক্ষ সমর্থন শুনানির জন্য একটি বা দুটি তারিখই যথেষ্ট। কিন্তু তিন বছরের বেশি সময় ধরে আত্মপক্ষ সমর্থনের তারিখ পেছানো হচ্ছে।- আইনজীবী মিজানুর রহমান

নিয়ম অনুযায়ী যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষেই রায় ঘোষণা করা হয়। তবে আসামি আরিফ হাসান সুমনের আত্মপক্ষ সমর্থন শুনানি বাকি থাকায় তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে আবেদন করেন তার আইনজীবী মিজানুর রহমান। এরপর গত তিন বছর ধরে আসামি আরিফ হাসানের আত্মপক্ষ সমর্থনের তারিখ শুধু পেছাচ্ছেই। আজও তা আলোর মুখ দেখেনি। আর এই এক আসামির আত্মপক্ষ শুনানির জালেই আটকে আছে দুই যুগ বয়সী এ মামলার বিচার।

এদিকে, ২০২২ সালের ২৮ জুলাই ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল থেকে মামলাটি মহানগর বিশেষ ট্রাইব্যুনালে ফেরত পাঠানো হয়। এ প্রসঙ্গে অভিযোগ করে আসামি আরিফ হাসান সুমনের আইনজীবী মিজানুর রহমান বলেন, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে একটি মামলা বিচারাধীন থাকলে প্রতি মাসে কয়েকবার মামলার তারিখ দিতে হয়। দীর্ঘদিন পরপর তারিখ দেওয়া যায় না। মামলাটির যেন দীর্ঘ তারিখ দেওয়া যায় এবং বিচারকাজ প্রলম্বিত করা যায় সেজন্যই দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল থেকে তখন মামলাটি বদলি করা হয়।

২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল (পহেলা বৈশাখ ১৪০৮ বঙ্গাব্দ) ভোরে রমনার বটমূলে সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানস্থলে দুটি বোমা পুঁতে রাখা হয়। পরে রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে সেগুলোর বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। ওইদিন বর্ষবরণের অনুষ্ঠান চলাকালে সকাল ৮টা ৫ মিনিটে একটি ও ১০টা ১৫ মিনিটের পর অন্য বোমাটি বিস্ফোরিত হয়।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি) নৃশংস ওই বোমা হামলায় প্রাণ হারান ১০ জন। এতে আহত হন আরও অনেকে। এ ঘটনায় হুজি নেতা মুফতি হান্নানসহ ১৪ জনকে আসামি করে ওইদিনই রমনা থানার পুলিশ বাদী হয়ে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে আলাদা দুটি মামলা করে।

মামলার বিবরণে বলা হয়, পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান ‘ইসলাম বিরোধী’ বিবেচনা করে ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালানো হয়। হামলায় ঘটনাস্থলেই নয়জনের মৃত্যু হয়। পরে হাসপাতালে মারা যান আরও একজন।

২০০৮ সালের ২৯ নভেম্বর শীর্ষ হুজি নেতা মুফতি আবদুল হান্নানসহ ১৪ জনকে অভিযুক্ত করে সিআইডির পরিদর্শক আবু হেনা মো. ইউসুফ আদালতে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে আলাদা দুটি সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এর মধ্যে ২০১৪ সালের ২৩ জুন ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. রুহুল আমিন হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে মুফতি হান্নান, বিএনপি নেতা ও সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিনসহ আটজনের মৃত্যুদণ্ড এবং ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন বিচারক।

বিজ্ঞাপন

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অন্য আসামিরা হলেন, মাওলানা আকবর হোসাইন, মুফতি আব্দুল হাই (পলাতক), হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম বদর (পলাতক), মাওলানা আবু বকর, মুফতি শফিকুর রহমান (পলাতক) ও আরিফ হাসান সুমন। এছাড়াও তাদের প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড দেওয়া হয়।

এ মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, মাওলানা সাব্বির, হাফেজ ইয়াহিয়া, মাওলানা শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ, মাওলানা আব্দুর রউফ ও মাওলানা শাহাদাৎ উল্লাহ জুয়েল। ৩০২/৩৪ ধারায় তাদের যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড, অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

এরপর খালাস চেয়ে উচ্চ আদালতে আপিল করেন আসামিরা। অন্যদিকে, মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের (ডেথ রেফারেন্স) জন্য নিয়ম অনুযায়ী মামলাটি হাইকোর্টে যায়। বিভিন্ন সময়ে আপিল শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা থমকে আছে। ফলে ১০ বছরেও আসামিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের অনুমোদন মেলেনি।

বিজ্ঞাপন

এদিকে, বিস্ফোরক আইনে করা মামলায় ২০১৪ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন মামলার অন্যতম আসামি মুফতি হান্নানসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে আনুষ্ঠানিক বিচারকাজ শুরু করেন। এ মামলায় অভিযোগপত্রভুক্ত ৮৪ জন সাক্ষীর মধ্যে সাক্ষ্য দিয়েছেন ৫৪ জন।

এ মামলায় অভিযুক্তরা হলেন- মুফতি আব্দুল হান্নান, মাওলানা আকবর হোসাইন, মুফতি আব্দুল হাই, হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম বদর, মাওলানা আবু বকর, মুফতি শফিকুর রহমান, মাওলানা তাজউদ্দিন, আরিফ হাসান সুমন, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, মাওলানা সাব্বির, হাফেজ ইয়াহিয়া, মাওলানা শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ, মাওলানা আব্দুর রউফ ও মাওলানা শাহাদাৎ উল্লাহ জুয়েল।

এর মধ্যে ২০১৭ সালের ১২ এপ্রিল রাতে মুফতি হান্নানের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলার দায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ফলে বিস্ফোরক আইনের এ মামলা থেকে অব্যাহতি পান হরকাতুল জিহাদের এ শীর্ষ নেতা। অন্য আসামিদের মধ্যে তাজউদ্দিন, জাহাঙ্গীর আলম বদর ও আব্দুল হাই পলাতক। বাকি আসামিরা সবাই কারাগারে।

বিজ্ঞাপন

গত অক্টেবরে আমরা নিয়োগ পেয়েছি। ডিসেম্বরে ছিল অবকাশ। আমরা খুব বেশি সুযোগ পাইনি। রাষ্ট্রীয় দিক নির্দেশনার দিকে তাকিয়ে আছি। আমাদের পাবলিক প্রসিকিউটর স্যার আছেন। তাকে সবসময় ইনফর্ম করি। তিনি যে দিক নির্দেশনা দেবেন সে অনুযায়ী কাজ করবো।- অতিরিক্ত পিপি মাহফুজ হাসান

আসামিপক্ষের আইনজীবী মিজানুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ন্যায়বিচার হলে আমার আসামি আরিফ হাসান সুমন খালাস পাবেন। এজন্য বিনা বিচারে জেল খাটাতে এ মামলার বিচার আটকে রাখা হচ্ছে। একজন আসামির আত্মপক্ষ সমর্থন শুনানির জন্য একটি বা দুটি তারিখই যথেষ্ট। কিন্তু তিন বছরের বেশি সময় ধরে আত্মপক্ষ সমর্থনের তারিখ পেছানো হচ্ছে। আসামিকে কারাগার থেকে আদালতে উপস্থিত করা হচ্ছে না। এ মামলার ন্যায়বিচার হলে আরিফ হাসান সুমন বেকসুর খালাস পাবেন।

জাগোনিউজের খবর পেতে ফলো করুন

এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর মাহফুজ হাসান জাগো নিউজকে বলেন, গত অক্টেবরে আমরা নিয়োগ পেয়েছি। ডিসেম্বরে ছিল অবকাশ। আমরা খুব বেশি সুযোগ পাইনি। রাষ্ট্রীয় দিক নির্দেশনার দিকে তাকিয়ে আছি। আমাদের পাবলিক প্রসিকিউটর স্যার আছেন। তাকে সবসময় ইনফর্ম করি। তিনি যে দিক নির্দেশনা দেবেন সে অনুযায়ী কাজ করবো।

এমআইএন/এমকেআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।