জীবনকে সাজাতে হাঁটতে হবে নিরন্তর : ওসমানী


প্রকাশিত: ০৩:২৬ এএম, ২১ এপ্রিল ২০১৬

মাহবুবুল হক ওসমানী পড়াশোনা শুরু করেছেন কড়াপুর পপুলার মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং অমৃত লাল দে কলেজে। সবশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে অনার্স এবং মাস্টার্স দু’পরীক্ষাতেই প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছেন। পড়াশোনা থেকে শুরু করে সব বিষয়েই ওসমানীর চমক শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকানোর আগেই বনে যান সেলিব্রেটি নিউজম্যান, নিউজ ট্রেইনার ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। নিজেকে আরো সমৃদ্ধ করতে পাড়ি জমান বিদেশে। বর্তমানে সস্ত্রীক অবস্থান করছেন কানাডায়। সর্বশেষ যুক্ত ছিলেন ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের (ইউল্যাব) মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগের প্রভাষক এবং চ্যানেল টুয়েন্টিফোরের সিনিয়র সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে।

ওসমানী এ পর্যন্ত সম্মাননা হিসেবে পেয়েছেন ঢাকা ব্যাংক বৃত্তি, মসউদ খান স্বর্ণপদক, আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি স্বর্ণপদক, দিলনাশিন খানম স্মৃতি স্বর্ণপদক, ডীনস অ্যাওয়ার্ড, অধ্যাপক সিতারা পারভীন পুরস্কার ও নভেরা দীপিতা স্মৃতি পুরস্কার।

আলোকিত এ মানুষ ক্যারিয়ারের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেছেন জাগো জবসের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন গোলাম রাব্বী

osmani-pic

জাগো জবস : শুরুতেই আপনার পড়াশোনা নিয়ে যদি বলতেন-
মাহবুবুল হক ওসমানী : এসএসসি ও এইচএসসিতে আমার পড়াশুনার বিষয় ছিল বিজ্ঞান। ডাক্তারি পড়ার ইচ্ছা নিয়ে বরিশাল থেকে রাজধানীতে পা রাখি। মেডিকেল ভর্তি কোচিং করলাম কিন্তু তাতে সফল হতে পারিনি। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিট থেকে চান্স হয়। আশানুরূপ সাবজেক্ট না পাওয়ায় সেবছর আর পড়াশোনা করা হয়নি। পরের বছর আবার পরীক্ষা দিলাম। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় আমার অবস্থান ছিল সতের! এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিও হয়েছিলাম ভেটেরিনারি বিষয়ে। কিন্তু ক্লাস শুরুর আগেই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ায় ভর্তি বাতিল করে চলে গেলাম খুলনায়। ভর্তিও হলাম ফার্মেসি বিভাগে। এবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ক’ ইউনিট থেকে চান্স হয়নি। কোন প্রস্তুতি ছাড়াই ‘ঘ’ ইউনিট থেকে চান্স হল। একরকম না জেনে, না বুঝে অনিচ্ছাকৃতভাবেই বেছে নিতে হল গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগকে!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সুপ্ত বাসনাটি যেন আবারও নাড়া দিয়ে উঠলো। তাই খুলনা থেকে ছুটলাম ঢাকায়। ভর্তি হলাম গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে। এসএসসি এবং এইচএসসিতে ছিল বিজ্ঞান আর স্নাতকে এসে পড়তে হচ্ছে সাংবাদিকতা। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে অনেকটাই হাবুডুবু খেতে হল! ফাইনাল পরীক্ষার ফলাফলে অবস্থান তিনে। সামলে উঠলাম দ্বিতীয় বর্ষে এসে, একবারে প্রথম! এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়ার এই ধারাবাহিকতা বজায় ছিল স্নাতক এবং স্নাতোকোত্তর পর্যন্ত। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৬ ও ৪৮তম সমাবর্তনে রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে গ্রহণ করলাম জীবনের সেরা পুরস্কার ‘স্বর্ণপদক’।

osmani-pic         
জাগো জবস : আপনার কাজ শুরুর অভিজ্ঞতাটা শুনতে চাই-
মাহবুবুল হক ওসমানী : তখন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের পড়াশোনার ধরনটা বেশির ভাগই ছিল সংবাদপত্র কেন্দ্রিক। কিন্তু আমার মধ্যে নতুন কিছু জানার আগ্রহ কাজ করতো। তাই দ্বিতীয় বর্ষে সংবাদ উপস্থাপনা বিষয়ক একটি কোর্সে ভর্তি হই। সেখানে ব্রডকাস্ট মিডিয়ার অনেক স্বনামধন্য ব্যক্তি ক্লাস নিতেন। সেসব খ্যাতিমান সংবাদকর্মীদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতে পেরেছিলাম। যেহেতু দ্বিতীয় বর্ষে পড়তাম তাই তখনো ঠিক পেশাগতভাবে তৈরি ছিলাম না। এই কোর্স শেষ করে একটি আবৃত্তি কর্মশালায় ভর্তি হলাম। সেখানে উচ্চারণ, কথা বলার নানা প্রকরণ রপ্ত করলাম। এরপর ভর্তি হই রেডিও জকি প্রশিক্ষণের কর্মশালায়। সেখান থেকে এফএম রেডিও সম্পর্কে একটা ধারণা জন্মে। আগ্রহ জাগে রেডিওতে কাজ করার। আরজে প্রশিক্ষণ শেষ করার কিছুদিনের মধ্যেই নতুন একটি স্টেশন কর্মী নিয়োগের জন্য বিজ্ঞাপন দেয়। আমি অনেকটা না বুঝেই সম্ভবত ৬টি বিভিন্ন পদের জন্য আবেদন করি! তবে ডাক আসলো আউট ডোর ব্রডকাস্টারের জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবল তৃতীয় বর্ষে উঠেছি আর তখনই এমন একটি সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইনি। তাইতো একাধারে চাকরি আর পড়াশোনা দু’টোই সমানতালে করেছিলাম।

জাগো জবস : রেডিও থেকে টিভিতে আসার গল্পটা-
মাহবুবুল হক ওসমানী : একটি রেডিওতে প্রায় দু’বছর কাজ করার পর ডাক আসে সময় টেলিভিশন থেকে। সালটা ২০১০; ফ্রেশারদের পাশাপাশি বয়সে তরুণ কিন্তু চৌকষ কিছু সংবাদকর্মী খুঁজছিলেন তারা। সিএসবি টিভির সাবেক কিছু সংবাদকর্মীও তখন এবিসি রেডিওতে কাজ করতেন। তাদের সাথেই মূলত সময় টেলিভিশনে জয়েন করা।

osmani-pic

জাগো জবস : কার অনুপ্রেরণায় মিডিয়ায় কাজ করতে শুরু করলেন?
মাহবুবুল হক ওসমানী : আমি কখনোই চাইনি সাংবাদিক হতে। এই পেশায় কাজ করতে বেশ ভয় হত তখন! ভেবেছিলাম যেহেতু গণযোগাযোগ পড়ছি, তাই কোন এনজিও বা সরকারি কিংবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তথ্য কর্মকর্তা হিসেবে ৯টা-৫টা কাজ করবো। কিন্তু বছর যেতেই ব্রডকাস্ট মিডিয়ার প্রতি একটা আগ্রহ অনুভব করি। ততদিনে চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করার বিষয়টি মাথায় ঢুকতে শুরু করেছে। মিডিয়ার অনেক কর্মীর সাথে পরিচয় হয়। কাজের ধরন সম্পর্কে জানতে পারি। এরপরই এই পেশাকে ভালোবেসে ফেলি।   

জাগো জবস : রেডিও-টিভির পাশাপাশি আর কী কী করতেন?
মাহবুবুল হক ওসমানী : পাশাপাশি শিক্ষকতা করেছি। গণমাধ্যম নিয়ে বেশ কয়েকটি গবেষণাকর্ম শেষ করেছি।

জাগো জবস : রিপোর্টার থেকে প্রেজেন্টার হওয়ার অভিজ্ঞতা-
মাহবুবুল হক ওসমানী : রিপোর্টার থেকে প্রেজেন্টার হবো- এটা কখনও ভাবিনি। কিন্তু সেই সুযোগটি তৈরি করে দেয় সময় টেলিভিশন। তাই এই প্রতিষ্ঠানের কাছে কৃতজ্ঞতা আমার সবসময়। মাস্টার্সের রেজাল্টের পর শিক্ষকতা পেশায় নিয়োগ পাই ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে। এরপর রিপোর্টিং ছাড়লেও সময় টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ কেবল সংবাদ উপস্থাপনের সুযোগ করে দেয়। একটা সময় সংবাদ উপস্থাপনার জন্য ডাক পাই চ্যানেল টুয়েন্টি ফোর থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর পাশাপাশি সংবাদ ও টক শো উপস্থাপনা সমানভাবে করেছি।

osmani-pic

জাগো জবস : বর্তমান সময়ে ভক্তদের কমিউনিকেশন কেমন উপভোগ করছেন?
মাহবুবুল হক ওসমানী : দু’টো একবারেই ভিন্ন। গণমাধ্যমে কাজ করে আমি নিজেকে চিনতে শিখেছি। আমার অন্ধকার মনের দরজাটা খুলে দিয়ে আমাকে আলোকিত করেছে এই গণমাধ্যম। সৃষ্টিজগত, মানুষে মানুষে যোগাযোগ, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল এইসব কিছু সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা পেয়েছি। সম্প্রতি আমি কানাডাতে মাইগ্রেট করেছি। তবে বাংলাদেশে থাকাকালে আমাকে নিয়ে ফ্যানদের আগ্রহকে আমি বেশ গুরুত্ব দিয়েই দেখতাম। চেষ্টা করতাম সুপরামর্শ দিতে।

জাগো জবস : আপনার প্রফেশনে আয় ও সুযোগ-সুবিধা কেমন?
মাহবুবুল হক ওসমানী : সংবাদ উপস্থাপনার কথা যদি বলেন, তবে বলবো- এই প্রফেশনে টাকা-পয়সার চেয়েও বড় প্রাপ্তি হলো সম্মান। আর হ্যাঁ, সুযোগ-সুবিধা আসলে নির্ভর করে প্রতিষ্ঠান আর কাজের মানের ওপর। ভালো সংবাদ উপস্থাপক হতে পারলে দর্শকপ্রিয়তা পাবে ওই চ্যানেল। আর তখন সেই চ্যানেলের রোজগার ভালো হবে। আর তার ভাগ কর্মীরাও পাবে।

osmani-pic 

জাগো জবস : যারা রেডিও-টিভিতে কাজ করতে চান, তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
মাহবুবুল হক ওসমানী : প্রাতিষ্ঠানিক সনদ থাকলে ভালো; তাহলে আগে থেকেই মোটামুটি একটা ধারণা থাকবে। আর তখন কাজ করতে গিয়ে প্রারম্ভিক প্রতিকূলতা খুব দ্রুত কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। গণমাধ্যমে কাজ করতে আসার আগে যতটা সম্ভব সদালাপী, উপস্থিত বুদ্ধি সম্পন্ন এবং সমসাময়িক বিষয়ে সম্যক ধারণা নিয়ে আসতে পারলে পেশার জন্য তা খুবই উপকারী।

জাগো জবস : ক্যারিয়ার নিয়ে আপনার পরিকল্পনা-
মাহবুবুল হক ওসমানী : মাত্র কিছুদিন হল দেশ ছেড়ে টরেন্টো এলাম। এখানেও আমার আগের পেশার সাথে সামঞ্জস্য রেখে কিছু করতে চাই। বাংলা ভাষার কয়েকটি টেলিভিশন এখানে তাদের কার্যক্রম চালু করতে যাচ্ছে। ইচ্ছে আছে তাদের সাথে কাজ করার। এছাড়া আরেকটি মাস্টার্স শেষ করার পর পিএইচডি করতে চাই।

জাগো জবস : সফলতা বলতে আপনি কী বোঝেন?
মাহবুবুল হক ওসমানী : সফলতা আসলে আপেক্ষিক। একেক জনের কাছে সফলতার মানে একেক রকম। কেউ তার অনুর্বর জমিতে ফসল ফলিয়েও সফল হতে পারেন। তবে আপনি যে প্রেক্ষিতেই সফল হতে চান না কেন, সেটি পরিশ্রম, সততা, অধ্যবসায় আর কাজের প্রতি নিষ্ঠা ছাড়া সম্ভব নয়।

osmani-pic

জাগো জবস : ক্যারিয়ারে সফলতা নিয়ে আপনার কোনো পরামর্শ-
মাহবুবুল হক ওসমানী : নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে। এই আমারও জীবনের প্রায় ১৮ বছর কেটেছে গ্রামের কোমল শ্যামলিমায় মেঠোপথে হেঁটে। হাঁটতে হাঁটতে সেই পথ রাজধানী ঢাকা হয়ে এসে মিলেছে এই সুদূর কানাডায়। এরপর কী হবে জানি না, তবে চলতি পথে থামলে চলবে না, জীবনকে সাজাতে হলে হাঁটতে হবে নিরন্তর! এই হাঁটার পথে কাঁটা পেলে, সেটিকে সযত্নে পরিষ্কার করে এগুতে হবে! তখন হাঁটতে হাঁটতেই পেয়ে যাবেন কাঙ্ক্ষিত পথের দেখা!    

জাগো জবস : দেশে আসা কিংবা নিজের ক্যারিয়ারে ফেরার ইচ্ছা আছে?
মাহবুবুল হক ওসমানী : দেশে না ফিরলেও সবার সঙ্গে যোগাযোগটা নিয়মিতই থাকবে। আর এখানেও গণমাধ্যমের সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়ার ইচ্ছা আছে। পিএইচডি শেষ করে এখানকার কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে চাই। পাশাপাশি গবেষণাও চালিয়ে যেতে চাই। ভিডিও এডিটিং এবং ফটোগ্রাফি নিয়ে কিছু পরিকল্পনা আছে।   

জাগো জবস : আপনার মূল্যবান সময় দেয়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
মাহবুবুল হক ওসমানী : আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।

এসইউ/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।