বিসিএসে আসলে লিখিত পরীক্ষাই মুখ্য: জনি দেব
জনি দেব ৪০তম বিসিএস পরীক্ষায় পুলিশ ক্যাডারে উত্তীর্ণ হন। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল থানার মিরপুর ইউনিয়নের দত্তপাড়া গ্রামে। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলেই পড়াশোনার হাতেখড়ি। তিনি সিলেটের মদন মোহন কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখান থেকে প্রথম শ্রেণিতে মার্কেটিং বিষয়ে বিবিএ এবং এমবিএ পাস করেন। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে দীর্ঘ চার বছর পর স্বপ্নের ক্যাডার পান।
বর্তমানে তিনি ‘সহকারী পুলিশ সুপার’ হিসেবে প্রশিক্ষণরত। তার ক্যাডার হওয়ার গল্প, বাধা-বিপত্তি ও নতুনদের পরামর্শ নিয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন জাগো নিউজকে। সেই গল্প শোনাচ্ছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—
সবকিছুই স্বপ্নের মতো লাগছিল
দীর্ঘ সাড়ে তিন বছর পর প্রকাশিত হয় ৪০তম বিসিএসের সেই কাঙ্ক্ষিত ফলাফল। বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজটের কারণে ৪০তম ছিল প্রথম বিসিএস। সৃষ্টিকর্তার কৃপায় প্রথম পছন্দ পুলিশ ক্যাডার পেয়েছি। ‘সহকারী পুলিশ সুপার’ পদমর্যাদায় ২৯তমে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছি। পুলিশ ক্যাডারে রোল নাম্বারটা দেখার পর কী অবস্থা হয়েছিল, তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। সবকিছুই স্বপ্নের মতো লাগছিল। মাঝে মধ্যে মনে হচ্ছিল, আসলে এই কি সেই দিন; যে দিনের জন্য বিগত ৪ বছরেরও বেশি সময় ধরে কঠোর পরিশ্রম করেছিলাম। এই দিনটার জন্য কত রাত না ঘুমিয়ে থেকেছি তার হিসেব নেই। জেগে থেকে কত স্বপ্নে বিভোর থেকেছি। আসলে এই অনুভূতি লিখে প্রকাশ করার মতো নয়।
স্বপ্ন দেখার শুরু
নিজেকে ইউনিফর্মে দেখতে পাবো, নামের সঙ্গে এএসপি থাকবে—ব্যাপারটার প্রতি শুরুতেই দুর্বল ছিলাম। ডেস্ক জবের বাইরে ফিল্ডে কাজ করার সুযোগ পাবো। ইউনিফর্মের বাইরে থেকে ডিবি, এসবি, সিআইডিতে সিভিল ড্রেসে গোয়েন্দা হিসেবে কাজ করতে পারবো। বিপদে মানুষকে সহায়তা করার সুযোগ থাকবে; অ্যাডভেঞ্চারাস লাইফ। সবকিছুই শুরুতে ভালো মোটিভেশন দিয়েছে নিজেকে।
আরও পড়ুন: ভিন্নধর্মী কাজ দিয়ে মন জয় করেছেন মনি
প্রস্তুতিটা ছিল দীর্ঘদিনের
বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষে পড়াকালীন আমি বিসিএসের জন্য পড়াশোনা শুরু করি। তবে সত্যিকার অর্থে বেসিক স্ট্রং করার প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল তার অনেক আগে থেকেই। রেগুলার পত্রিকা পড়ার ফলে বিভিন্ন ইস্যুতে ফ্রি হ্যান্ড লেখার একটা ভালো অভ্যাস গড়ে উঠেছিল। পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি অল্পবিস্তর গল্প-উপন্যাস পড়া এবং টিউশন আমাকে অনেক এগিয়ে দিয়েছে এই যুদ্ধে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন বিভিন্ন সামাজিক ও শিক্ষামূলক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকায় নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা যেমন বিকশিত হয়েছে; তেমনই কথা বলার একটা দক্ষতা তৈরি হয়েছিল। তবে পুরোদস্তুর বই কিনে পড়া শুরু করি চতুর্থ বর্ষের শেষের দিকে। ভার্সিটির লাইব্রেরিতে বাইরের বই নিয়ে ঢোকা নিষেধ থাকায় অডিটরিয়াম ও ইউনিভার্সিটি সেন্টারের বারান্দায় কয়েকজন বসে নিয়মিত মডেল টেস্ট দিতাম। ‘মাত্র এই কদিন পড়ে প্রিলি, এই কদিন পড়ে রিটেন, একদম প্রিপারেশন ছাড়াই ভাইভা দিয়ে ক্যাডার হয়েছি’—টাইপের প্রস্তুতির ধারে কাছেও ছিলাম না। প্রস্তুতিটা ছিল দীর্ঘদিনের। ধীরে ধীরে এগিয়েছি। এটা আমার দুর্বলতাও হতে পারে। তবে অল্পদিনে কিছুই হয়নি আমার সঙ্গে। যা-ই শিখেছি সময় নিয়ে।
যাদের অনুপ্রেরণা পেয়েছি
দীর্ঘ এ জার্নিতে যে কজন মানুষকে খুব কাছে পেয়েছি, তাদের ধন্যবাদ দেবো না। শুধু কৃতজ্ঞতাই প্রকাশ করতে পারি। আজীবন আমার বাবা-মা ও আমার শিক্ষকদের কাছে কৃতজ্ঞ, যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে আজকের এই আমি। যে বন্ধুদের সুখে-দুঃখে পাশে পেয়েছি এবং দীর্ঘসময় পড়াশোনা করেছি, সবার কাছেই কৃতজ্ঞ। সবচেয়ে বেশি যার কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ; সেই মানুষটা হলো আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু, সহপাঠী এবং বর্তমানে আমার স্ত্রী। একসঙ্গে ভার্সিটিতে পড়াশোনা করেছি, ঘুরে বেরিয়েছি, এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিস করেছি এবং ভালো একাডেমিক রেজাল্ট করেছি। পাশাপাশি চাকরির প্রস্তুতিও নিয়েছি।
আরও পড়ুন: প্রস্তুতির পাশাপাশি নিয়মিত মডেল টেস্ট দিতে হবে: মুহিব
নতুনরা যা করবেন
নতুনদের জন্য অনেক অনেক শুভ কামনা। এখন কম্পিটিশন অনেক বেশি। এ কারণে বেসিকটা ভালো করে পাকাপোক্ত করা আবশ্যক। এরই মধ্যে অনেকে ভালো দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, তা অনুসরণ করবেন। বাজারে অনেক বইয়ের ভিড়ে হতাশ না হয়ে একটি বিষয়ের জন্য যে কোনো একটি বই কিনে ভালো করে পড়া শুরু করা উচিত। একবার শেষ করার পর রিভিশন বাধ্যতামূলক। জব সলিউশন থেকে বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নোত্তর চর্চা করতে পারেন। তাহলে বিসিএস ছাড়াও অন্য পরীক্ষায় সহায়তা হবে। পাশাপাশি একটি মডেল টেস্ট থেকে ঘড়ি ধরে নিয়মিত টেস্ট দেবেন।
লিখিত পরীক্ষাই মুখ্য
বিসিএসে আসলে লিখিত পরীক্ষাই মুখ্য। রিটেনে যত বেশি মার্ক পাবেন; ক্যাডার হওয়ার দৌড়ে তত এগিয়ে থাকবেন। শুরুতে সিলেবাসটা ভালো করে দেখবেন। বিগত বছরের প্রশ্নগুলো ভালো করে সলভ করেন। এ পর্যায়ে প্রতিটি বিষয়ের প্রতিটি চ্যাপ্টার ধরে ধরে বিস্তারিত পড়তে থাকেন। প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত নোট করে রাখেন। রিটেনে অল্প সময়ে প্রচুর লিখতে হবে। সুতরাং বাসায় বসে ঘড়ি ধরে লিখিত পরীক্ষা দেবেন। প্রতিদিন একটি পত্রিকা পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। দুনিয়ার যে কোনো বিষয়ে কলম চালানোর অভিজ্ঞতা তৈরি হয়ে যাবে।
আরও পড়ুন: ভাইভা বোর্ডে ফার্স্ট ইম্প্রেশন বেশ গুরুত্বপূর্ণ
ভাইভায় যা জানতে হবে
নিজের জেলা সম্পর্কে, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু নিয়ে খুঁটিনাটি এবং প্রথম ৩টি ক্যাডার সম্পর্কে জেনে যাবেন। এ ছাড়া দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা ও চলমান ইস্যুগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিজের সাবজেক্টের বেসিক একটি ধারণা নিয়ে যাবেন। তবে সবচেয়ে যেটা বেশি জরুরি; সেটা হলো ভাইভা বোর্ডে আত্মবিশ্বাস ধরে রাখা। কোনো প্রশ্নের উত্তর না জানলে সুন্দর করে ‘স্যার আমার প্রশ্নের উত্তরটি জানা নেই’ কথাটি বলা। যা জানেন তা সুন্দর করে গুছিয়ে বলবেন। ভাইভায় ড্রেসআপ, কথা বলার ভঙ্গি, নিজের পার্সোনালিটি, ইতিবাচক মানসিকতা—এসব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বইয়ের ভাষায় না বলে নিজের ভাষায় বলাই উত্তম। একটি প্রশ্নের উত্তর এমনভাবে দেবেন, যাতে পরের প্রশ্নটি এখান থেকেই করেন। সব প্রশ্নের উত্তর না পারলে ঘাবড়ে যাবেন না।
এসইউ/জিকেএস