প্রথম বিসিএসেই কৃষি ক্যাডার পেলেন লিখন
শেখ নাইমুর রশিদ লিখন ৪১তম বিসিএসে কৃষি ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার খলশি গ্রামে। তিনি ডুমুরিয়া এনজিসি অ্যান্ড এনসিকে মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ডুমুরিয়া কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষি অনুষদে স্নাতক এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্যানতত্ত্ব বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
সম্প্রতি জাগো নিউজের সঙ্গে তিনি বিসিএস জয়, ক্যারিয়ার পরামর্শ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন। সেই গল্প শোনাচ্ছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—
প্রথম বিসিএসেই ক্যাডার পেয়ে আনন্দিত
প্রথমেই মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। বিসিএস নামক তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরীক্ষায় প্রায় ৪ বছরের অপেক্ষা শেষে চূড়ান্ত সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছি। এর চেয়ে সুন্দর অনুভূতি আর কী হতে পারে! প্রথম বিসিএস যেহেতু আবেগটা একটু বেশিই ছিল। আমার শ্রদ্ধেয় পিতা-মাতা, বোন ও বোন জামাই, আত্মীয়-স্বজন, শিক্ষক, বন্ধু-বান্ধব ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের প্রতিও ভালোবাসা জানাচ্ছি। পাশাপাশি বিসিএসের এ দীর্ঘ যাত্রায় অংশ নেওয়া সব সহযোদ্ধাদের জন্যও শুভ কামনা।
নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়তে পারিনি
খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার খলশি গ্রামের আলো-বাতাস গায়ে মেখে বড় হয়েছি। মফস্বলের স্কুল-কলেজেই পড়াশোনা করেছি। নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়তে পারিনি। আমার কাছে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মর্যাদা সমান। আমি বিশ্বাস করেছি, যোগ্যতা ও বিশ্বাস থাকলে যে কোনো জায়গা থেকেই ভালো করা সম্ভব। গ্রামের স্কুল থেকেই পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছি। এসএসসি ও এইচএসসিতে এপ্লাস পেয়েছি। আমার প্রাণের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ যেভাবে আমাকে সুশিক্ষিত ও স্বশিক্ষিত করেছে, তা আমার জীবনের পথচলাকে বহুলাংশে সাফল্যমণ্ডিত করেছে।
আরও পড়ুন: বাবার মৃত্যুতেও হাল ছাড়েননি নাসিম
স্নাতকে থাকাকালীন চাকরির প্রস্তুতি নিইনি
আমি একাডেমিক পড়াশোনায় গুরুত্ব দেওয়াকে যুক্তিযুক্ত মনে করেছি। একটা ভালো সিজিপিএ সারাজীবনের জন্য গুড লেটার অব রিকমেন্ডেশন। অনেকে স্নাতকে থাকাকালীন একাডেমিক না পড়ে চাকরির প্রস্তুতি বা কোচিং করে থাকেন। যা একাডেমিক ফেইলারের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। সময়ের কাজ সময়ে করাটাই সঠিক মনে করি। স্নাতকে থাকাকালীন কালচারাল অ্যাক্টিভিটিস, বিতর্ক, বক্তৃতা, কুইজে অংশ নেওয়া অভিজ্ঞতার ঝুলিকে সমৃদ্ধ করে। বিসিএসসহ সরকারি চাকরির কোনো না কোনো পর্যায়ে সাহায্য করে। এ সময়ে নিয়মিত পত্রিকা, গল্প-উপন্যাস পড়েছি এবং স্কিল ডেভেলপের চেষ্টা করেছি। স্নাতকে থাকাকালীন চাকরির পড়াশোনা না করলেও এ সময়ই জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা অত্যন্ত জরুরি। আমি ২০১৮-২০১৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্ক ট্যুর, কান্ট্রি ট্যুর ও কৃষি সম্প্রসারণ ট্যুরে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাই। এ সময় বিভিন্ন সরকারি অফিস পরিদর্শন করি এবং ক্যাডার সার্ভিসের লোকদের কার্যক্রম সম্পর্কে ধারণা পাই। মানুষকে সেবা দেওয়ার ও মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ দারুণভাবে আকৃষ্ট করে। তখন থেকেই নিজেকে এ জায়গায় ভাবতে শুরু করেছিলাম এবং অবশেষে সফল হয়েছি।
প্রিলিমিনারির জন্য চাই কংক্রিট প্রিপারেশন
২০১৯ সালের মার্চে বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি শুরু করি। এক্ষেত্রে ধীরে চলো নীতি ও Slow and steady wins the race নীতি ফলো করি। যা পড়তাম, অনেক সময় নিয়ে পড়েছি, বিস্তারিত পড়েছি এবং বুঝে বুঝে পড়ে ব্রেনে গেথে নিয়ে পড়েছি। যেন আর সহজে না ভুলি। টুকটাক নোটও করেছি। রুটিন করে প্রতিদিন যেটুকু প্রয়োজন; সেটুকু পড়েছি, সময় ধরে নয়। এভাবে পূর্ণাঙ্গ কোর্স শেষ করতে আমার এক বছর লেগে যায়। অথচ এই এক বছরের প্রস্তুতিতেই আমি ৪১তম বিসিএসসহ পরে ৪৩, ৪৪ ও ৪৫তম বিসিএস প্রিলিমিনারিতেও উত্তীর্ণ হই। আমার মনে পড়ে ৪৩, ৪৪ ও ৪৫তম বিসিএস প্রিলিমিনারির জন্য আমি ১৫-২০ দিনের বেশি পড়িনি। তাই বেসিক নলেজ ডেভেলপ করে একটা কংক্রিট প্রিপারেশন নিতে পারলে পরে আর পেছনে তাকাতে হয় না।
লিখিতে ভালো করতে ফ্রি হ্যান্ড রাইটিং
বিসিএস লিখিত পরীক্ষাই ক্যাডার প্রাপ্তিতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে। লিখিত পরীক্ষায় ভালো করতে হলে ফ্রি হ্যান্ড রাইটিংয়ের দক্ষতা থাকতে হবে। এখানে মুখস্থ বিদ্যা প্রয়োগের সুযোগ কম। এখন প্রিলিমিনারির পর লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার সময়ের ব্যবধান খুব কম। এর মধ্যে পূর্ণাঙ্গ সিলেবাস শেষ করা অত্যন্ত কঠিন। প্রিলিমিনারি যত বিস্তারিত পড়বেন, লিখিতের পড়া তত কমে আসবে। লিখিত পরীক্ষায় চার বা তিন ঘণ্টার মধ্যে সবকিছু লিখে শেষ করে আসাও অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। কোচিংয়ে বা নিজে নিজে সময় ধরে দ্রুত লেখার অভ্যাস ও পরীক্ষা দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। বিসিএস লিখিত পরীক্ষা মানেই সাধারণ জ্ঞানের ফুলঝুড়ি। এটিই আমার স্ট্রং সাইট ছিল। বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিকে ৩০০ মার্ক, বাংলা ও ইংরেজি রচনায় ৯০ মার্কসহ অন্য বিষয় মিলিয়ে আরও ৫০-৬০ মার্ক প্রশ্ন থাকে। সাধারণ জ্ঞান প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল, তাই আপডেট থাকা জরুরি। নিয়মিত গণিত, মানসিক দক্ষতা ও ইংরেজি অনুশীলন চালিয়ে যেতে হবে। বিজ্ঞানে সলিড মার্ক থাকে। নিজ টেকনিক্যাল বিষয়েও ভালো করবেন যদি একাডেমিকে মনোযোগী থাকেন ও সিলেবাস বিশ্লেষণ করে সুন্দর প্রস্তুতি নেন। প্রতিটি বিষয়েই এক্সপার্ট না হলেও মোটামুটি দক্ষ হতে হবে।
আরও পড়ুন: হতাশ হয়েছি বহুবার কিন্তু হাল ছাড়িনি: আনিসুর রহমান
এক বছর ধরে ভাইভা প্রস্তুতি নিয়েছি
লিখিত পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরপরই আমি ভাইভার জন্য প্রস্তুতি শুরু করেছিলাম। এসময় নিয়মিত পত্রিকা পড়েছি, বঙ্গবন্ধুর লেখা চারটি বই, প্রধানমন্ত্রীর লেখা শেখ মুজিব আমার পিতা বইটি পড়েছি। এ ছাড়া শেষ সময় কোচিংয়ে কয়েকটি মক ভাইভা আমার জড়তা কাটাতে সাহায্য করেছিল। অনেকেই মনে করেন, ভাইভার জন্য হয়তো কিছু পড়া লাগে না। এটি সম্পূর্ণ ভুল। ভাইভা বোর্ডে আপনার প্রিলিমিনারি-লিখিতের জ্ঞান, একাডেমিক জ্ঞান ও জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা যাচাই করা হয়। ভাইভার জন্য পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতিই হয়তো আমার প্রথম বিসিএসেই ক্যাডার প্রাপ্তিতে সহায়তা করেছে।
প্রস্তুতিতে প্রযুক্তির ব্যবহার
কাজটি স্নাতকে থাকাকালীন বা পরেও করতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়া ও ইউটিউব আমাদের জীবনের অনুষঙ্গ। আমি ফেসবুকের চাকরি সংক্রান্ত সব গ্রুপেই যুক্ত হয়েছিলাম এবং ফলো দিয়ে রাখতাম। আমার হোমপেজ তাই শিক্ষা সংক্রান্ত কনটেন্টে ঠাঁসা ছিল। এটি যে কত উপকারী, তা এখন বুঝতে পারছি। অবসরে ইউটিউব দেখতাম। সেখানেও একই কাজ করেছি। টেলিভিশনের নিউজ ভিত্তিক, সাধারণ জ্ঞান ভিত্তিক ও পড়াশোনা ভিত্তিক চ্যানেলগুলো সাব্সক্রাইব করে রাখতাম এবং তাদের ভিডিও দেখতাম। এখান থেকে অর্জিত জ্ঞান বই থেকে অর্জিত জ্ঞানের চেয়ে বেশি কাজ করেছে।
সফলতার মূলমন্ত্র ধৈর্য
ধৈর্য রাখুন। পড়াশোনা হবেই। বিসিএস লং রেস। দুদিন ধুমধাম পড়ে সফলতা পাওয়া যায় না। ধৈর্য নিয়ে পড়তে থাকুন, যতদিন প্রয়োজন। ধৈর্যের সঙ্গে প্রয়োজন পরিশ্রম, কৌশল ও মেধা। ভালো থাকতে হলে ও সফলতা পেতে নিজেকে অন্যের সঙ্গে তুলনা করা বন্ধ করে দিন। তুলনা করতে গেলেই দেখবেন সব সময় আপনার ওপরে কেউ না কেউ আছেন। এসব ভাবতে গেলেই হতাশায় ভুগবেন, আত্মবিশ্বাস হারাবেন। তাই তুলনা বন্ধ করে নিজের কাজটি ভালোভাবে করুন। আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী আপনি নিজে। হিংসা বিদ্বেষ পরিহার করুন। মানুষের সফলতায় অনুপ্রাণিত হোন, ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিন। আলো আসবেই।
আরও পড়ুন: বিসিএসে প্রথম পছন্দের ক্যাডারই পেয়েছেন মনির
সততা ও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন
সিভিল সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। যদিও প্রথম পছন্দ বিসিএস প্রশাসন ছিল। ৪৩, ৪৪ ও ৪৫তম বিসিএসে চেষ্টা করবো, তবে না পেলেও আমার কোনো আক্ষেপ নেই। আমার একটাই লক্ষ্য—সততা, নিষ্ঠা ও কর্মদক্ষতার সঙ্গে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের দায়িত্ব পালন করবো। দেশ ও দশের ভাগ্য উন্নয়নে কাজ করা কৃষকদের সহচর্যে কৃষি ক্যাডারে আমার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ঝুলি আরও সমৃদ্ধ হবে আশা করছি।
এসইউ/জিকেএস