মনি মোহনের আমাজনে চাকরি পাওয়ার গল্প

আনিসুল ইসলাম নাঈম
আনিসুল ইসলাম নাঈম আনিসুল ইসলাম নাঈম , ফিচার লেখক
প্রকাশিত: ০২:৪০ পিএম, ২০ অক্টোবর ২০২২

বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ প্রতিষ্ঠান আমাজনে বর্জ্য-ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ হিসেবে চাকরি পেয়েছেন মনি মোহন। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা খুলনার দাকোপ উপজেলায়। তিনি ২০০৭ সালে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান ডিসিপ্লিন থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর জার্মানির হ্যানোভার বিশ্ববিদ্যালয়ে পানিসম্পদ ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নিয়ে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা সহযোগী হিসেবে যোগ দেন। এরপর আমাজনে চাকরি করার ইচ্ছা থেকেই আবেদন করেন। দুই মাসে চার ধাপ ইন্টারভিউয়ের পর গত ৬ সেপ্টেম্বর তাকে অফার লেটার দেওয়া হয়।

বর্তমানে তিনি জার্মানির কাইজারস্লাউটার্ন শহরে আমাজনের এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি বিভাগে কর্মরত। তার আমাজনে চাকরি পাওয়া, নতুনদের জন্য পরামর্শ ও ভবিষ্যৎ ভাবনা সম্পর্কে কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—

জাগো নিউজ: আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আমাজনে চাকরি পেয়েছেন, আপনার অনুভূতি কেমন?
মনি মোহন: ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জার্মানিতে পানিসম্পদ ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে মাস্টার্স শেষ করি। এরপর থেকে আন্তর্জাতিক বৃহৎ কোনো প্রতিষ্ঠান বা জাতিসংঘের অঙ্গপ্রতিষ্ঠানে চাকরির চেষ্টা করার আগ্রহ তৈরি হয়। দেরিতে হলেও সে ইচ্ছা পূরণ করতে পারায় আমি স্বাভাবিক কারণেই খুব খুশি। এটি অনেকদিনের স্বপ্ন পূরণ হওয়ার মতো।

জাগো নিউজ: আমাজনে চাকরি পাওয়ার জন্য নিজেকে কীভাবে প্রস্তুত করেছেন?
মনি মোহন: ২০১৬ সালের জুনে জার্মানির হ্যানোভার বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্জ্য-ব্যবস্থাপনা বিভাগে গবেষণা সহযোগী (রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট) হিসেবে চাকরি শুরু করি। এরপর থেকেই পরিবেশ-ব্যবস্থাপনা বিষয়ে আন্তর্জাতিক বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর চাকরির বিজ্ঞাপন অনুসরণ করতাম। আবেদনের যোগ্যতা ও অন্যান্য আবশ্যকীয় শর্তসমূহ খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তাম। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান গবেষণা প্রকল্পের কাজের ব্যস্ততা থাকায় কখনও আবেদন করিনি। এজন্য হ্যানোভার বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরির মেয়াদের শেষের দিকে ২০২২ সালের শুরু থেকে বিভিন্ন রকম প্রতিষ্ঠানে চাকরির আবেদনের জন্য সিভি ও কভার লেটার প্রস্তুত করি। এভাবে ৩-৪ মাস সময় নিয়ে ধীরে ধীরে অনলাইনে প্রাপ্ত বিভিন্ন রকম সিভি ও কভার লেটারের ফরম্যাট দেখে শিক্ষাগত যোগ্যতা ও পূর্ববর্তী সব কাজের অভিজ্ঞতা সমন্বয় করে কয়েক সেট সিভি ও কভার লেটার তৈরি করে ফেলি। ২০২২ সালের জুন মাসে আমার গবেষণা প্রকল্প এবং হ্যানোভার বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির মেয়াদ শেষ হয়। তার আগেই আমি বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে চাকরির আবেদন করে ফেলি। আমাজনেও একটা পদে আবেদন করি। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকে সাক্ষাৎকারের ডাক পেলেও আমাজন থেকে প্রথম আবেদন বাতিল হয়ে যায়। এরপর সিভি ও কভার লেটার কিছুটা আপগ্রেড করি। ২য় ধাপে ২০২২ সালের জুলাই মাসে আবারও বেশ কিছু বাছাইকৃত প্রতিষ্ঠানে পরিবেশ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক পদে আবেদন করি। এরমধ্যে আমাজনেও বর্জ্য-ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ পদে একটি আবেদন করি। যদিও আশা করিনি যে সাক্ষাৎকারের ডাক পাবো। তবে ২০-২৫ দিন পর আমাজন থেকে সাক্ষাৎকারের ডাক পাই এবং চার ধাপের সাক্ষাৎকার শেষে সেপ্টেম্বর মাসে নির্বাচিত হই।

জাগো নিউজ: আমাজনে কী ধরনের চাকরির সুযোগ আছে?
মনি মোহন: আমাজন একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান। এখানে বেশিরভাগ চাকরির সুযোগ থাকে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, প্রোগ্রামিং বা রোবটিক্সের মতো বিষয়গুলোতে। এ ছাড়াও হিউম্যান রিসোর্সেস অ্যান্ড রিক্রুটিং বিভাগ, লজিস্টিকস, প্রকিউরমেন্ট, প্ল্যানিং অ্যান্ড চেইন ম্যানেজমেন্ট, হেলথ অ্যান্ড সেফটি, পরিবেশ ব্যবস্থাপনা ও সাস্টেইনেবিলিটিসহ বেশ কিছু সেক্টরে চাকরির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এখানে যেমন নতুন গ্রাজুয়েটদের অনেক সুযোগ রয়েছে; তেমনই অভিজ্ঞদেরও বেশ কিছু পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।

জাগো নিউজ: একজন নতুন গ্র্যাজুয়েট আমাজনে চাকরির জন্য কীভাবে আবেদন করবেন?
মনি মোহন: আমাজনে বেশি পরিমাণে নতুন গ্র্যাজুয়েট নিয়োগ দিয়ে থাকে। প্রথমত নতুন গ্র্যাজুয়েটরা যেসব বিষয়ে বিশেষ পারদর্শী (নির্দিষ্ট প্রোগ্রাম/সফটওয়্যার/টুলস) সেসব বিষয়কে ফোকাস করে এক সেট স্ট্যান্ডার্ড কভার লেটার এবং সিভি তৈরি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এরপর আবেদনের পূর্বে খুব ভালোভাবে আবেদন করতে ইচ্ছুক পদের আবশ্যকীয় যোগ্যতা ও শর্তসমূহ নিজের সিভিতে উল্লেখিত যোগ্যতার সাথে মিলিয়ে দেখতে হবে। কমপক্ষে ৮০% শর্ত পূরণ হলে আবেদন করা ভালো। তাহলে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাক পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

জাগো নিউজ: আমাজনে চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দেওয়ার প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলুন—
মনি মোহন: আমাকে মোট চারটি ইন্টারভিউ দিতে হয়েছে। প্রথমে একটা টেলিফোন ইন্টারভিউ হয়েছিল। যার মাধ্যমে আমাজন বেসিক স্ক্রিনিং করে থাকে। টেলিফোন স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে আমাজন উল্লেখিত পদের মূল শর্তগুলো আবেদনকারী মোটামুটিভাবে পূরণ করতে পারছে কি না সেটা যাচাই করে। আমার ক্ষেত্রেও প্রথম ধাপে ওই পদের প্রধান শর্তসমূহ যেমন- স্ট্যাডির বিষয়, কত বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা, জার্মান ও ইংরেজি ভাষাজ্ঞানের লেভেল যাচাইসহ কর্মস্থল, বেতন গ্রেড, চাকরি শুরুর সম্ভাব্য সময় নিয়ে আমার কোনো আপত্তি বা প্রতিবন্ধকতা আছে কি না এসব বিষয়ে আলাপ হয়েছিল। এরপর দুটি বিষয়ভিত্তিক ইন্টারভিউ হয়েছিল, যেখানে ওই পদের জন্য প্রয়োজনীয় টেকনিক্যাল ধারণা ও দক্ষতা আমার আছে কি না সেটা যাচাই করেছিল। এ পর্বে কিছু বিষয়ভিত্তিক প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছিল এবং একটি করে সমস্যার সমাধান করতে হয়েছিল। আমার জন্য পরিবেশ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক সমস্যার সমাধান করতে হয়েছিল। শেষে একটি লিডারশিপ প্রিন্সিপাল ভিত্তিক ইন্টারভিউ হয়েছিল। এখানে আমার ম্যানেজমেন্ট ও লিডারশিপ স্কিল যাচাই করেছিল। এটি আমাজনের সিনিয়র পদগুলোর জন্য একটি বিশেষ ইন্টারভিউ। এ ধাপে কিছু ক্রিটিক্যাল ম্যানেজমেন্ট সিচুয়েশন বা অবস্থার বা সমস্যার অবতারণা করা হয় এবং অভিজ্ঞতার আলোকে আমি কীভাবে সেই অবস্থা বা সমস্যার সমাধান করেছিলাম সেটি বলতে হয়েছিল। এ সমস্যার সমাধানগুলো আমাজনের বিশেষ স্টার মেথডে দিতে হয় এবং এখানে খুব ভালো প্রস্তুতি নেওয়া দরকার।

জাগো নিউজ: সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে কত সময় লাগতে পারে?
মনি মোহন: এটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নির্ভর করে আবেদনকারী কোন দেশে অবস্থান করছেন এবং কর্মক্ষেত্র কোন দেশে অবস্থিত। আবেদন করার সময় আমি জার্মানিতে ছিলাম এবং আমার পোস্টিংও জার্মানিতে। এজন্য আমার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে তিন থেকে সাড়ে তিন মাস লেগেছিল। তবে আবেদনকারীর অবস্থান ও কর্মক্ষেত্র ভিন্ন ভিন্ন দেশে হলে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে ছয় মাস বা তার চেয়ে বেশি সময় লাগতে পারে।

জাগো নিউজ: আন্তর্জাতিক এসব প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশিদের সুযোগ কেমন?
মনি মোহন: আমার জানামতে আন্তর্জাতিক সব বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো বেশ আগে থেকেই ধর্ম, বর্ণ ও লিঙ্গ বৈষম্য নিরসনের জোর চেষ্টা করছে। যা বর্তমানে আরও বেশি করে প্র্যাকটিস করছে। শুধু বিষয়ভিত্তিক ধারণা ও দক্ষতা ভালো থাকলে এখন যে কেউ যে কোনো স্থান থেকে সুযোগ পাচ্ছেন। এজন্য যারা বেশি পরিশ্রম করতে পারবেন, তাদের ভালো সুযোগ রয়েছে। বিগত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যায়, অনেক বাংলাদেশি দেশে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে এসব বড় বড় প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত সুযোগ পাচ্ছেন।

জাগো নিউজ: যেসব তরুণ আমাজনে চাকরি করতে আগ্রহী, তাদের জন্য আপনার কী পরামর্শ থাকবে?
মনি মোহন: প্রথমত কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ে (যেমন কোনো নির্দিষ্ট প্রোগ্রাম/সফটওয়্যার/টুলস) বিশেষ পারদর্শিতা বা দক্ষতা অর্জনের চেষ্টা করা। এরপর একটু সময় নিয়ে স্ট্যান্ডার্ড মানের একটি সিভি ও কভার লেটার তৈরি করা। যেটি আবার প্রতিটি পদে আবেদন করার পূর্বে ওই পদের প্রয়োজনীয় যোগ্যতার সঙ্গে সামঞ্জস্য করার জন্য কিছু পরিমার্জন ও পরিবর্ধন করা খুবই জরুরি। এ ছাড়া সাক্ষাৎকারের জন্য নির্বাচিত হলে ওই পদের জন্য উল্লেখিত বিষয়ে পরিষ্কার ধারণার জন্য কিছু পড়াশোনা করলে সুবিধা হয়। এ ছাড়া প্রতিটি বড় বড় প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব সাক্ষাৎকার পদ্ধতি রয়েছে, যেটি সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা না থাকলে প্রয়োজনীয় দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও সাক্ষাৎকারে ভালো করা সম্ভব হয় না। সবশেষে একবার বা দুইবার ব্যর্থ হলেও ভেঙে না পড়ে পুনরায় চেষ্টা করা। মনে রাখতে হবে বড় বড় প্রতিষ্ঠানে অনেকেই কয়েকবারের চেষ্টায় সফল হয়েছিল। সুতরাং আগ্রহী তরুণ শিক্ষার্থীরা বিষয়গুলো মেন্টেইন করলে ভালো ফল পাবে বলে বিশ্বাস করি।

জাগো নিউজ: চাকরি নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
মনি মোহন: বিগত ৬-৭ বছর যাবত বিভিন্ন উৎস থেকে সৃষ্ট সব ধরনের বর্জ্যের কম্পোজিশন বের করা (ল্যাব অ্যানালাইসিস করে) এবং বর্জ্য থেকে শক্তি ও রিসোর্সেস উৎপন্ন করার সবচেয়ে ইফিসিয়েন্ট পদ্ধতিগুলো নির্বাচন করার জন্য হ্যানোভার বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করেছি। এখন আমাজনে সেই থিয়রেটিক্যাল ধারণা ও দক্ষতাকে বাস্তবায়নের একটা দারুণ প্ল্যাটফর্ম পেয়েছি। এ ছাড়াও আমাজনে আরও অনেক অ্যাডভান্সড ও উচ্চাভিলাষী বর্জ্য-ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি প্রয়োগ করার পরিকল্পনা রয়েছে। এখান থেকে অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের কোনো একটি শহর বা সিটি কর্পোরেশনের জন্য ইফিসিয়েন্ট বর্জ্য-ব্যবস্থাপনার (বর্জ্য থেকে শক্তি/রিসোর্স উৎপাদন) একটি মডেল প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চাই। যা পরে রেপ্লিকেট করা যাবে। এ ক্ষেত্রে হ্যানোভার বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্জ্য-ব্যবস্থাপনা বিভাগে এখনো যে এফিলিয়েশন আছে, সেটিকে কাজে লাগাতে পারব। এ কাজে প্রথমেই দেশের যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের যারা বর্জ্য-ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করেন, যৌথভাবে একটি ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি করে নিতে চাই (যা কয়েকটি মাস্টার্স থিসিসের আওতায় করা সম্ভব)। ইতোমধ্যে পরিচিত কয়েকজনের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছি, যা আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। এ বিষয়ে আমি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা কামনা করছি। পাশাপাশি আগ্রহীদের আমার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার অনুরোধ করছি।

এসইউ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।