বিসিএস মৎস্য ক্যাডারে সাঈদার প্রথম হওয়ার গল্প

আনিসুল ইসলাম নাঈম
আনিসুল ইসলাম নাঈম আনিসুল ইসলাম নাঈম , ফিচার লেখক
প্রকাশিত: ০২:৫৭ পিএম, ২৪ আগস্ট ২০২২

সাঈদা আক্তার ৪০তম বিসিএসে মৎস্য ক্যাডারে (সুপারিশপ্রাপ্ত) প্রথম হয়েছেন। এটি তার প্রথম বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ। সম্প্রতি তার বিসিএস ক্যাডার হওয়ার গল্প, নতুনদের পরামর্শ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানিয়েছেন জাগো নিউজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—

জাগো নিউজ: প্রথমেই আপনার শিক্ষাজীবন সম্পর্কে বলুন—
সাঈদা আক্তার: ২০০৫ সালে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়ে পঞ্চম শ্রেণি পাস করি। তারপর জামালপুর সদরের জামালপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হই। সেখানে থেকে ৮ম শ্রেণিতে বৃত্তি পাই এবং ২০১১ সালে এসএসসি পাস করি। তারপর সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজ জামালপুরে ভর্তি হই এবং ২০১৩ সালে এইচএসসি পাস করি। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ পাই। আমি ছোট থেকেই ডাক্তার হতে চেয়েছিলাম। তবে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় ৩ নম্বর কম পাওয়ায় সেই স্বপ্ন সত্যি হয়নি। তাই ২০১৩-২০১৪ সেশনে বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিশারিজ বিভাগে ভর্তি হই। অনার্স শেষ করে ফিশারিজ ম্যানেজমেন্টে মাস্টার্স পাস করি। সেখানে ভালো ফলাফলের জন্য মেধাবৃত্তি, বিভিন্ন দেশি-বিদেশি স্কলারশিপ পাই। মাস্টার্সেও জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপে পুরস্কৃত হয়েছিলাম। আল্লাহর রহমতে ৪০তম বিসিএসে প্রথমবারেই নিজ ক্যাডারে প্রথম স্থান অধিকার করে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছি।

জাগো নিউজ: আপনার শৈশবের দিনগুলো কেমন কেটেছে?
সাঈদা আক্তার: আমার জন্মস্থান জামালপুর জেলার মেলান্দহ উপজেলার ফুলকোচাতে। সবুজ শ্যামল নির্মল পরিবেশে আমি বড় হয়েছি। দাদুর সর্বকনিষ্ঠ নাতনি হওয়ায় এবং ভাই-বোনদের মধ্যে সবার ছোট হওয়ায় অপরিসীম স্নেহ-মমতায় বেড়ে উঠতে থাকি। ২০০৫ সালে পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পরে ভাই-বোনের সঙ্গে আরও ভালো পড়াশোনার উদ্দেশে বাবা-মা ছেড়ে জামালপুর সদরে পাড়ি জমাই। আমি বরাবরই উপস্থিত বক্তৃতা, দৌড়, ইসলামিক গান, একক অভিনয়, আবৃত্তি খুব ভালো পারতাম। এ ছাড়া আন্তঃস্কুল প্রতিযোগিতায় অনেকবার পুরস্কৃত হয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে পড়া অবস্থায়ও দৌড় প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পেয়েছি। এ ছাড়া আমি স্কুলে স্কাউটিং করতাম, ক্যাম্পিংয়ে যেতাম।

জাগো নিউজ: পড়াশোনায় কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল কি?
সাঈদা আক্তার: আমি যখন ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে জামালপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হই; সে সময়টা প্রচণ্ড কষ্টে কেটেছে। মাত্র মা-বাবা ছেড়ে আসা, নতুন পারিবেশ, অপরিচিত সহপাঠী আর পড়াশোনার নতুন ধরনে নিজেকে ঠিক মানিয়ে নিতে পারতাম না। নিজেকে বারবার ছুটি গল্পের ফটিক মনে হতো। গ্রামার আর গণিতে খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। মনে হচ্ছিল আমাকে দিয়ে আর পড়াশোনা হবে না। বাড়িতে গেলে আর আসতে চাইতাম না। ভাইয়া-আপু সে সময় প্রচণ্ড মানসিক সাপোর্ট দিয়েছেন। পরে আল্লাহর রহমতে সে অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হই।

জাগো নিউজ: বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন কখন থেকে?
সাঈদা আক্তার: বিসিএসের স্বপ্ন অনেক ছোটবেলা থেকেই দেখেছি। যেহেতু ছোট থেকেই স্বপ্ন ছিল সরকারি ডাক্তার হওয়ার। তখন বিসিএস কি বুঝতাম না। কিন্তু উপজেলার ডাক্তার বা মৎস্য কর্মকর্তাদের দেখে খুব ভালো লাগতো। তাদের মতো হতে চাইতাম। পরে মেডিকেলে চান্স না পেয়ে ফিশারিজে ভর্তি হই। নিজেকে একজন বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন মনেপ্রাণে ধারণ করি। কারণ তখন বুঝতে পারি, ডাক্তার না হয়ে ফিশারিজে থেকেই জনসেবা করা যায়। সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করি।

jagonews24

জাগো নিউজ: বিসিএস যাত্রার গল্প শুনতে চাই, পাশাপাশি প্রস্তুতি কীভাবে নিয়েছেন?
সাঈদা আক্তার: ২০১৬ সালে আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩য় বর্ষের ছাত্রী; তখন থেকেই ভালোভাবে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করি। একটি স্থানীয় বিসিএস কোচিংয়ে ভর্তি হই; বিসিএস নিয়ে ধারণা পেতে ও সিলেবাস কাভার করতে। সপ্তাহে ৫ দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস করতাম। শুক্রবার ও শনিবার বিসিএসের পড়াশোনা চলত। এ জন্য ভার্সিটিতেও আমার সিজিপিএ ৩.৯৮ ছিল। পরে স্নাতক শেষে ৪০তম প্রিলি পাসের পর ঢাকার ফার্মগেটে বিসিএস লিখিত পরীক্ষার জন্য একটি কোচিংয়ে ভর্তি হই। সে সময় আমি ঢাকায় আমার ভাইয়ার বাসায় থেকে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। অনেকে মনে করেন, বিসিএস নিয়ে ব্যস্ত থাকলে একাডেমিক পড়া ভালো হয় না, এটা ভুল ধারণা। আর আমি প্রতিদিন পত্রিকা পড়তাম, ভার্সিটির হলে থাকার সময়ও অনেক পেপার নেওয়া হতো।

জাগো নিউজ: পর্দার আড়াল থেকে কারা অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে?
সাঈদা আক্তার: পুরো বিসিএস জার্নিটাতে আমার পরিবার আমার পাশে ছিল। বিশেষ করে আমার ভাবি আমাকে প্রচণ্ড মানসিক সাহস জুগিয়েছেন। পাশাপাশি আমার ভাইয়া, আম্মা, আব্বা, আপা, দুলাভাইও সার্বক্ষণিক অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। আমার ভাইবার সময় আমার স্বামী আমাকে সার্বক্ষণিক মানসিক সাপোর্ট ও বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।

জাগো নিউজ: নতুনরা বিসিএস প্রস্তুতি কীভাবে শুরু করবেন?
সাঈদা আক্তার: নতুনদের ক্ষেত্রে আমি বলতে চাই, অবশ্যই নিজের মাইন্ডসেটটাকে সম্পূর্ণরূপে বিসিএস কেন্দ্রীক করতে হবে। কারণ বিসিএস হচ্ছে ধৈর্য ও অধ্যবসায়ের আরেক নাম। আমরা এর ফল ভোগ করতে চাই, কিন্তু কষ্ট করতে চাই না। এরকম করা যাবে না। প্রতিনিয়ত লেগে থাকতে হবে, অনুশীলন করতে হবে। আর প্রথমে বিগত বছরের প্রশ্নগুলো দেখে একটি ধারণা নিতে হবে প্রশ্নের প্যাটার্ন সম্পর্কে। নিজের দুর্বল দিকগুলোর প্রতি যত্নশীল হতে হবে। আর মানসিকভাবে অন্য কোনো অ্যাটাচমেন্টে না জড়ানোই ভালো।

জাগো নিউজ: বিসিএস লিখিত প্রস্তুতি নিয়ে আপনার পরামর্শ কী?
সাঈদা আক্তার: যেহেতু বিসিএস লিখিত পরীক্ষার সিলেবাস মহাসাগরের মতো। তাই প্রিলির প্রস্তুতির সময়ই কিছুটা লিখিতের সঙ্গে সামঞ্জস্য করে পড়া ভালো। ইংরেজি, গণিত আর বিজ্ঞান হচ্ছে লিখিত পরীক্ষার ট্রাম্পকার্ড। এ তিনটিতে ভালো করতে পারলে কাঙ্ক্ষিত ক্যাডার পাওয়া অনেকটা সহজ হয়। আর অবশ্যই পত্রিকা পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। প্রতিদিন কমপক্ষে এক ঘণ্টা করে একটি ইংরেজি ও একটি বাংলা পত্রিকা পড়তে হবে। বিগত সালের প্রশ্ন সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নিয়ে ভালোভাবে আয়ত্ত করতে হবে। নিজ সাবজেক্টের পরীক্ষার প্রতি যত্নবান হতে হবে। স্নাতকে পঠিত বিষয়গুলো ভালোভাবে রিভিশন দিতে হবে।

জাগো নিউজ: বিসিএস যাত্রায় সোশ্যাল মিডিয়া থেকে কেমন সাহায্য পেয়েছেন?
সাঈদা আক্তার: বিভিন্ন বিসিএস রিলেটেড গ্রুপে যুক্ত থেকে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে বিভিন্নভাবে সাহায্য পেয়েছি। অনলাইন পত্রিকাগুলো থেকেও সাহায্য পেয়েছি। তবে লিখিত পরীক্ষার রুটিন দেওয়ার পরবর্তী ২২ দিন সম্পূর্ণরূপে স্মার্ট ফোন থেকে দূরে ছিলাম। আর সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সতর্কতার সঙ্গে তথ্য গ্রহণ করেছি। যাচাই-বাছাই করে, ঢালাওভাবে নয়।

জাগো নিউজ: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
সাঈদা আক্তার: বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘মাছ হবে দেশের দ্বিতীয় প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা আয়কারী উৎস। তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে নিজেকে নিয়োজিত করতে চাই। বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদ উন্নয়নে কাজ করতে চাই। পাশাপাশি দেশি-বিদেশি উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে নিজের অর্জিত জ্ঞানকে দেশ ও জাতির কাজে লাগাতে চাই।

এসইউ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।