চাকরিতে বয়স বাড়ানোর দাবিতে খোলাচিঠি
সরকারি চাকরিতে বয়সসীমা ৩৫ করার দাবিতে আন্দোলন করে আসছে চাকরি প্রত্যাশীরা। তারই ধারাবাহিকতায় যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য খোলাচিঠি পাঠিয়েছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীবৃন্দ। জাগো জবসের পক্ষ থেকে চিঠিটি হুবহু তুলে ধরা হলো।
হে মহান আইন প্রণয়নকারীগণ
চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩০ বছর; এ গণ্ডি, এ দেয়াল, এ সীমানা প্রাচীর অবরুদ্ধ করে রেখেছে বাংলাদেশের লক্ষ-কোটি ছাত্র সমাজকে। তারা নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। উচ্চ শিক্ষিত বেকার যুব সমাজ যখন উপেক্ষিত, লাঞ্ছিত, দিশেহারা। ঠিক এমন সময় বর্তমান মহামান্য রাষ্ট্রপতি স্পীকার থাকা অবস্থায় ২০১২ সালের ৩১ জানুয়ারি মহান জাতীয় সংসদে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ বছর করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে যুব সমাজ আশার আলো দেখে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ২১তম বৈঠকে ৩২ বছর করার সুপারিশ করেন। নবম জাতীয় সংসদের ১৪তম অধিবেশনে ৩৫ বছরের প্রস্তাবটি প্রথম প্রস্তাব হিসেবে গৃহীত হয়। সেই সাথে বাংলাদেশের সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী এ দাবি বাস্তবায়নের জন্য পাঁচ বছর ধরে অকাট্য যুক্তি তুলে ধরে অহিংস পদ্ধতিতে আন্দোলন করে আসছে।
চাকরির বয়স বৃদ্ধির যৌক্তিকতা বা অকাট্য দলিল
গড় আয়ু যখন ৪৫ ছিল তখন চাকরিতে প্রবেশের বয়স ছিল ২৭। যখন ৫০ ছাড়ালো তখন প্রবেশের বয়স ৩০ হলো। বর্তমানে গড় আয়ু ৭১ হলে চাকরিতে প্রবেশের বয়স এখন কত হওয়া উচিত?
এসএসসি ও এইচএসসি রেজাল্ট ও ভর্তি সংক্রান্ত ব্যাপারে ১ বছর চলে যায়। অনার্স ভর্তি রেজাল্ট, মাস্টার্স ভর্তি রেজাল্ট সংক্রান্ত ব্যাপারে ২ বছর চলে যায়। আর অনার্সের পরিধি ১ বছর বাড়ানো হয়েছে। সে দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে ১+২+১=৪ বছর তো আমরা এমনিতেই পাই। এটা তো করুণা, দান বা অনুগ্রহ নয়, এটা ছাত্র সমাজের ন্যায্য অধিকার।
২২ লাখ চাকরিজীবীর বেতন তুলনামূলক হারে বাড়িয়ে পাশাপাশি ২২ লাখ শিক্ষিত বেকার যুবকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করলে এবং অবসরের বয়স ২ বছর না বাড়িয়ে সুযোগ করে দিলে কী এমন ক্ষতি হত?
উন্নত বিশ্বে তাদের জনগণকে জনশক্তিতে রূপান্তরের ক্ষেত্রে বয়সের সীমা রেখাকে প্রাধান্য দেয়নি। অনেক দেশে অবসরের সীমা থাকলেও প্রবেশের কোন সীমা নেই। যেমন- ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ৪০ অন্যান্য প্রদেশে ৩৮-৪০, শ্রীলঙ্কায় ৪৫, ইন্দোনেশিয়ায় ৪৫, ইতালিতে ৩৫, ফ্রান্সে ৪০, যুক্তরাষ্ট্রে ৫৯, কানাডাতে ৫৯, সুইডেনে ৪৭, কাতারে ৩৫, নরওয়েতে ৩৫, এঙ্গোলাতে ৪৫, তাইওয়ানে ৩৫ আর আমাদের দেশে বয়সের সীমারেখা দিয়ে বন্দী করে রাখা হয়েছে লক্ষ-কোটি ছাত্র সমাজকে।
শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে ১৫ বছরের পূর্বকথা
জন্মনিবন্ধন ব্যাধতামূলক না হওয়ায় ১৪ বছরে এসএসসি পাস করা সম্ভব হত। পূর্বে অনার্স কোর্স ছিল ৩ বছর এবং ডিগ্রি কোর্স ছিল ২ বছর। ফলে ১৮ কিংবা ১৯ বছর বয়সে স্নাতক পাস করা যেত। ফলশ্রুতিতে ১৮ কিংবা ১৯ বছর বয়সে বিসিএসসহ পিএসসি’র অন্যান্য চাকরিতেও আবেদন করা যেত।
বর্তমান অবস্থা
প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার সার্টিফিকেটে বয়স লিপিবদ্ধ থাকার ফলে ১৬ বছরের পূর্বে কোনো ভাবেই এসএসসি পরীক্ষা দেয়া যায় না। ৩ বছরের অনার্স কোর্স ৪ বছর, ২ বছরের ডিগ্রি কোর্স ৩ বছর, ৩ বছরের ডিগ্রি কোর্সের সাথে ২ বছরের মাস্টার্স ছাড়া আবেদন করা যায় না।
আইন পদ্ধতি ও সংশোধন
৬ বছর বয়সে স্কুলে ভর্তির বিধান নির্দিষ্ট হওয়ার ফলে ১৬ বছর ৩ মাস বয়সে এসএসসি পরীক্ষা দিতে হয়। নন পিএসসি’র ক্ষেত্রে যে প্রজ্ঞাপন তাতে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ১৮ বছর। কিন্তু ১৮ বছর বয়সে ৪ বছর মেয়াদী অনার্স কীভাবে শেষ হয়? ২ বছর মেয়াদী ডিগ্রিও এখন নেই। এই অযৌক্তিক আইন কীভাবে এখনো বলবৎ থাকে। তাই ছাত্র সমাজ দ্রুত এই অকার্যকর আইন বাতিলের দাবি করছে।
১৬ বছর ২ মাসে এসএসসি, ১৮ বছর ৪ মাসে এইচএসসি ও ১৮ বছর ১০ মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিলে ১৯ বছর বয়সে প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু করলে ২৩ বছরের পূর্বে কখনো অনার্স শেষ করা সম্ভব নয়। তাহলে কোন যুক্তিতে চাকরির আবেদনের শুরুর বয়স ২১ থাকবে? কেন এই অকার্যকর আইন এখনো প্রয়োগ করে ছাত্র সমাজকে চরমভাবে ঠকানো হচ্ছে?
১৬ বছর এখন নির্দিষ্ট (এসএসসি’র ক্ষেত্রে)। নন পিএসসি’র ক্ষেত্রে ১৮ বছর- এই চলমান আইনটি এখন অকার্যকর। ক্যাডারের ক্ষেত্রে ২১ বছরের আইনটিও গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে ২৩ হচ্ছে আবেদনের শুরু, যদি তাই হয়, পূর্বের ন্যায় যদি আমাদের (১৮-৩০) ১২ বছর সময় দেওয়া হয় তাহলে সহজ হিসাব ২৩ এর সাথে আমাদের সুযোগ ১২ বছর যোগ করলে ২৩+১২= ৩৫ বছর। এই অকার্যকর আইনগুলো সংশোধন করলেই তো চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ বছর এমনিতেই হয়ে যায়, এর জন্য তো কোনো আন্দোলনের প্রয়োজন হয় না।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমরা বৈষম্যের শিকার
বাংলাদেশ পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে সরকারি চাকরিতে ৫৫% কোটার মাধ্যমে নিয়োগ হয়। আমরা সাধারণ শিক্ষার্থী; আমাদের কোন কোটা নেই। কোটাধারীরা চাকরিতেও কোটা পায়, আবার বয়সও তাদের শিথিলযোগ্য। উল্লেখ্য যে, মুক্তিযোদ্ধা, উপজাতি, জুডিশিয়াল ও ডাক্তার ৩২ বছর পর্যন্ত চাকরিতে আবেদন করতে পারে। নার্স ৩৬ এবং বিভাগীয় প্রার্থীরা ৪০ বছর পর্যন্ত চাকরিতে আবেদন করতে পারে। আমরা এখন এই বৈষম্যের সমতা চাই।
সেশন জটের ভয়াবহ নিখুঁত চিত্র
বাংলাদেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সেশন জট মুক্ত নয়। ছাত্র ও শিক্ষক অনুপাতে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরী কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী ৮৭% শিক্ষার্থী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অধ্যয়নরত। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলেও সত্য যে, সেই সর্ববৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়টিও সেশন জট মুক্ত নয়। তার জ্বলন্ত প্রমাণ স্বরূপ গত ৫ বছরের চিত্র তুলে ধরা হলো-
২০০৮ সালের মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষায় সেশন জট ছিল- ২ বছর ১১ মাস ১৮ দিন। ২০০৯ সালের মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষায় সেশন জট ছিল- ৩ বছর ১ মাস ০৬ দিন। ২০১০ সালের মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষায় সেশন জট ছিল- ৩ বছর ১২ দিন। ২০১১ সালের মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষায় সেশন জট ছিল- ২ বছর ১১ মাস ১০ দিন। ২০১২ সালের মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষায় সেশন জট ছিল- ২ বছর ১১ মাস ২৭ দিন। ওই পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, গত ৫ বছরে প্রতি শিক্ষাবর্ষে গড় সেশন জট ছিল ৩ বছর ২ দিন।
উল্লেখ্য যে, ২০১৩ সালের মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষার ফরম ফিলআপ এখনো চলমান। যদিও বর্তমানে ২০১৬ সাল চলছে; তবে প্রশ্ন রয়ে যায়- ২০১৩, ২০১৪, ২০১৫ এবং ২০১৬ সালের মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা কবে অনুষ্ঠিত হবে? বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরী কমিশনের সর্বশেষ রিপোর্টে বলা হয়েছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯৬% শিক্ষার্থী সেশন জটে আক্রান্ত এবং ৪% শিক্ষার্থী সেশন জট মুক্ত।
১. প্রশ্ন হচ্ছে উপর্যুক্ত তথ্য অনুযায়ী কি বলা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশন জট আছে?
২. যদি সেশন জট থাকে তাহলে এর দায়ভার কে নেবে, শিক্ষার্থী না রাষ্ট্র?
৩. কল্যাণকর রাষ্ট্র যদি ব্যক্তির যেকোনো ক্ষতিপূরণ দেয়, তাহলে সময় নষ্টের ক্ষতিপূরণ কেন দেবে না?
আমরা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় সংসদ সদস্যগণের সদয়দৃষ্টি আকর্ষণপূর্বক বিষয়টি মহান জাতীয় সংসদে উপস্থাপনের মাধ্যমে কার্যকর করার জন্য বিনীত অনুরোধ করছি।
নিবেদক, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীবৃন্দ।
এসইউ