পাহাড়ের বুকে মনি পাহাড়ীর সফলতার গল্প
মনি পাহাড়ী। ঢাকার নাট্যাঙ্গনে একটি সুপরিচিত নাম। ঢাকার গতি থিয়েটারের সভাপতি। তার ভালোবাসার জায়গা থিয়েটার। তবে সাংস্কৃতিক চর্চার পাশাপাশি বর্তমানে আলোচনায় এসেছেন অনলাইন বিজনেস গ্রুপ ‘ফ্লাইং ট্রেড’ নিয়ে। এ দু’য়ের মাঝখানে রয়েছে বেশ কিছু জানা-অজানা গল্প। আজ শুনবো তার প্রত্যাবর্তন ও গতিময়তার গল্প-
রাঙ্গামাটি বাড়ি তার। ১৯৯০ সালে প্রথম মঞ্চনাটকে অভিনয় করেন। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে মঞ্চে ৩০ বছর পূর্ণ হল। এইচএসসি শেষ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে ভর্তি হন। অভিনয় বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। সেখানেও একাডেমিক থিয়েটারে নিয়মিত নাট্যচর্চা করতেন। এরপর আরণ্যক নাট্যদলের সাথে যুক্ত হন ২০০৩ সালে। ৯ বছর কাজ করার পর গঠন করেন গতি থিয়েটার। চলতি বছর মে মাসে গতি থিয়েটারের ১২ বছর পূর্ণ হবে।
এ বিষয়ে মনি পাহাড়ী বলেন, ‘গতির ১২ বছর আর মঞ্চে আমার ৩০ বছর পূর্ণ হওয়া নিয়ে তিন দিনব্যাপী উৎসব করার পরিকল্পনা আছে। সেটা রাঙ্গামাটিতেই করার ইচ্ছা আছে। কেননা আমার মঞ্চভ্রমণ শুরু এখান থেকেই। সে উৎসবে গতির নতুন মঞ্চনাটক ‘অন্তর্জাল’র প্রিমিয়ার হবে। পাশাপাশি গতির পরিবেশনায় থাকবে পথনাটক, গান ও নানা আয়োজন। উৎসবে জাতীয় পর্যায়ের থিয়েটার ও সাংস্কৃতিক অঙ্গণের ব্যক্তিবর্গ ও সাংবাদিকরা উপস্থিত থাকবেন।’
গতি ২০০৯ সালে যাত্রা শুরু করে। এরই মধ্যে তারা বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটারের সহযোগী সদস্য পদ ও বাংলাদেশ পথনাটক পরিষদের সদস্য পদ লাভ করে। বিগত কয়েক বছর ধরে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাথেও সম্পৃক্ত। বেশ কয়েকবার সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অনুদানও পেয়েছে।
থিয়েটারের পাশাপাশি মনি পাহাড়ী নিয়মিত বাচিক শিল্পী হিসেবে কাজ করছেন মঞ্চ ও রেডিওতে। তিনি বাংলাদেশ বেতার ঢাকার তালিকাভুক্ত শিল্পী। বিবিসি মিডিয়া অ্যাকশনের ভয়েস আর্টিস্ট হিসেবেও চুক্তিভিত্তিক কাজ করেছেন। ডাবিং শিল্পী হিসেবেও তার সুনাম আছে।
টেলিভিশন নাটকে নাট্যকার ও নির্দেশক মামুনুর রশীদের সাথে সহকারী পরিচালক হিসেবে বেশ কিছু কাজ করেন মনি পাহাড়ী। পাশাপাশি বিটিভিতে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নাটকে অভিনয় করেন। এসময় সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। কিন্তু সেখানে নিয়মিত হননি। তিনি টেলিভিশন চাকরিতে যুক্ত হন ২০১২ সালে। এসএ টিভির অনুষ্ঠান বিভাগে কাজ করেন। অনুষ্ঠানের ব্যতিক্রমী কনসেপ্টের জন্য অল্প সময়েই আলাদা অবস্থান তৈরি করে নেন।
টেলিভিশনে যুক্ত হওয়ার আগে জনপ্রিয় বাংলা চলচ্চিত্র ‘মনপুরা’য় সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। ভবিষ্যতে চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বপ্ন আছে তার। তার আরেকটি কাজের জায়গা হলো মানবাধিকার সংস্থা। ফ্রিল্যান্স কনসালটেন্ট ও প্রশিক্ষক হিসেবে আন্তর্জাতিক, জাতীয় ও স্থানীয় বিভিন্ন সংস্থার সাথে কাজ করেছেন। দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ছুটে বেরিয়েছেন কাজ নিয়ে।
২০১৬ সালে নাগরিক টেলিভিশনের সাথে যুক্ত হন। প্রত্যাশা ছিল ভিন্ন কিছু করার। কিন্তু সে সময়ে ঢাকায় অবস্থান করাটা কঠিন হয়ে পড়ছিল মেয়ের কথা ভেবে। তার স্বামী আশিক সুমন একজন থিয়েটার কর্মী ও সংগীতশিল্পী। ঢাকার বাইরে তারও নিয়মিত কাজ থাকে। মেয়েকে দেখার কেউ থাকে না বলে তারা সিদ্ধান্ত নেন রাঙ্গামাটি ফিরে যাওয়ার।
মনি পাহাড়ী বলেন, ‘প্রথম প্রথম ভীষণ মন খারাপ হতো। থিয়েটার, টেলিভিশন চাকরি, ভয়েস অ্যাক্টিং খুব মিস করতাম। কিন্তু থেমে থাকাটা চলবে না ভেবে নতুনভাবে কাজ শুরু করলাম। এখন নিয়মিত ঢাকা আর রাঙ্গামাটিতে সমান্তরালভাবে মঞ্চ ও পথনাটক করছি। এখানেও প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মশালা পরিচালনা করছি আমি আর আশিক। বিভিন্ন প্রশিক্ষণে পাহাড়ে নতুন নতুন নাট্যকর্মী তৈরি হচ্ছে। সময়টা ডিজিটাল। ফেসবুকের মাধ্যমেও আমরা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছি। সাড়াও বেশ ভালো।’
করোনার প্রথম দিকে ‘ফেসবুক লাইভ চ্যারিটি শো’ করে রাঙ্গামাটির ৩৫১টি পরিবারকে সহযোগিতা করেছেন মনি-আশিক দম্পতি। মনি পাহাড়ী বলেন, ‘এ কাজে দেশ-বিদেশের মানুষের অংশগ্রহণ প্রমাণ করে দিয়েছে কাজটাই বড় কথা। কোন জায়গা থেকে করা হচ্ছে, সেটা মুখ্য নয়। ভাবনাটি আমাদের গতিময়তা বাড়িয়ে দিলো।’
২০২০ সালের আগস্টের শেষে হঠাৎ করে মনি পাহাড়ী শুরু করেন অনলাইন বিজনেস। তিনি বলেন, ‘বিজনেস করবো কখনো ভাবিনি। একটা বিশেষ সঙ্কটে মনে হলো- সামাজিক মর্যাদার পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবেও শক্ত অবস্থানের প্রয়োজন আছে। সে জায়গা থেকে ‘ফ্লাইং ট্রেড’র চলাটা শুরু। সব সময়ই লক্ষ্য করেছি পাহাড়ের রং রূপ ভীষণ বর্ণিল। এখানকার নানা সৃষ্টিতে তার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। সে কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জাতিসত্তার ঐতিহ্যবাহী নানা কিছু নিয়ে ফ্লাইং ট্রেড।’
ফ্লাইং ট্রেডের বিশেষত্ব সহজেই চোখে পড়ার মতো। এ গ্রুপে প্রোডাক্টকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যে, বর্ণনা গুণে সেগুলো জীবন্ত হয়ে ওঠে। সাহিত্য রসের অবতারণা ভিন্নমাত্রা দিয়েছে গ্রুপকে। এখানে মূল্যসহ সব কিছু সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা থাকে। ঐতিহ্যের পাশাপাশি শিশু বান্ধব গ্রুপ হিসেবেও দাঁড়িয়ে যাচ্ছে বিজনেস গ্রুপটি।
বিভিন্ন অঙ্গনে কাজ করায় মনি পাহাড়ীর নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে দেশব্যাপী। যেখানেই কাজ করেছেন; সেখানেই ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে। এ উদ্যোগের সাথে সব অঙ্গনের মানুষ নিজেকে জড়িয়ে নিচ্ছেন পরম নির্ভরতা ও বিশ্বাসে। সেইসাথে ফ্লাইং ট্রেড টিমের সাথে যুক্ত হয়েছেন কয়েক জন মেধাবী ও চৌকস ব্যক্তি। সততা, ব্যক্তিত্ব, মেধা, শ্রম, শিল্পরুচি সব কিছুর ছাপ পাওয়া যায় ফ্লাইং ট্রেডে। বিজনেস ও শিল্পের মেলবন্ধনের অনন্য উদাহরণ হয়ে উঠেছে গ্রুপটি।
কখনো থেমে না গিয়ে চলতে থাকলে পথটা নিজে থেকেই ধরা দেয় বলে মনে করেন মনি পাহাড়ী। তার এ প্রত্যাবর্তন ও সাফল্য অনেকের জন্য অনুপ্রেরণা কারণ হবে নিশ্চয়ই।
এসইউ/এমকেএইচ