শিক্ষার সঙ্গে চাকরির বিশাল ব্যবধান : তাহসিন জাকারিয়া


প্রকাশিত: ১০:৪৫ এএম, ২৭ মে ২০১৭

তাহসিন জাকারিয়া একজন সফল মানব সম্পদ কর্মকর্তা এবং উদ্যোক্তা। গত এক দশক ধরে তিনি বিভিন্ন দেশীয় ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের মানব সম্পদ বিভাগে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে এসেছেন। বর্তমানে তিনি জাতিসংঘের একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠানে ন্যাশনাল এইচআর স্পেশ্যালিস্ট হিসেবে কর্মরত আছেন।

প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন (ওডি), পিএমএস, পলিসি তৈরি এবং মানব সম্পদ উন্নয়নের অন্যান্য খুঁটিনাটি বিষয়গুলোতে তার রয়েছে হাতেকলমে কাজ করার অভিজ্ঞতা। পাশাপাশি তিনি খ্যাতনামা এইচআর কনসালটেন্সি ফার্ম ‘স্কীলউইজ’র লিড কনসালটেন্ট এবং এইচআর ফোরাম চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।

মানব সম্পদ বিভাগে ক্যারিয়ার গড়ার খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে জাগো জবসে মূল্যবান মতামত জানিয়েছেন তাহসিন জাকারিয়া । সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন নিয়াজ আহমেদ।

জাগো জবস : একজন মানব সম্পদ বিভাগের প্রধান হিসেবে কাকে সার্ভিস দেওয়াটা আপনি বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন? মালিক পক্ষকে নাকি কর্মজীবীদের?
তাহসিন জাকারিয়া : একজন মানব সম্পদ বিভাগের প্রধান হিসেবে আমি প্রতিষ্ঠানকে সার্ভিস দেওয়াটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। আর প্রতিষ্ঠান যেহেতু মালিকপক্ষ এবং কর্মজীবীদের নিয়েই গড়ে ওঠে। মনে রাখতে হবে, মালিক এবং শ্রমিক একে অপরের প্রতিপক্ষ নন বরং তারা একে অপরের পরিপূরক।

tahsin

জাগো জবস : দেশীয় ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মধ্যে আপনি কীভাবে পার্থক্য করবেন? কীভাবে দেশীয় কোম্পানিগুলোতে বহুজাতিক কোম্পানির নিয়ম ও কালচার গড়ে তোলা সম্ভব বলে আপনি মনে করেন?
তাহসিন জাকারিয়া : আগে দেখতে হবে বহুজাতিক কোম্পানির নিয়ম ও কালচার একটি দেশীয় কোম্পানির উৎপাদন ক্ষমতা ও ধারাবাহিকতায় কতটুকু ভূমিকা রাখছে। বহুজাতিক হলেই যে ভালো হবে তা কিন্তু নয়। আমাদের দেশীয় অনেক কোম্পানিতেও বহুজাতিক কোম্পানির চেয়ে ভালো কালচার ও কর্মপরিবেশ গড়ে উঠেছে। মনে রাখতে হবে, একটি কোম্পানির কালচার কর্মজীবী ও মালিকপক্ষের সামষ্টিক চিন্তা-ভাবনা, বিশ্বাস ও সদিচ্ছার সমষ্টি।

জাগো জবস : বর্তমানে বিদেশ থেকে প্রায় দুই লাখ লোক এদেশে এসে কাজ করছে। ৩শ’টির বেশি কোম্পানিতে কাজ করছে এবং নিয়ে যাচ্ছে প্রায় ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের বেতন। অথচ আমাদের দেশের লাখো যুবক বেকার। তাহলে কি আমাদের দক্ষ মানব সম্পদ নেই?
তাহসিন জাকারিয়া : হ্যাঁ এবং না। এটা নির্ভর করছে আমরা কোন স্তরের কর্মীর কথা বলছি এবং কোন ধরনের কাজগুলোতে বিদেশি কর্মীদের আধিক্য দেখতে পাচ্ছি সেটার ওপর। বিশ্বায়নের এই যুগে অনেক কারণেই একটি কোম্পানি বা একটি রাষ্ট্র তার জব মার্কেট বিদেশি কর্মীদের জন্য খুলে রাখতে বাধ্য হয়। আমরাও এর ব্যতিক্রম নই। তবে আমাদের নজর দিতে হবে যাতে আমাদের দেশের কর্মীরাও যথাযথ দক্ষতা ও যোগ্যতা অর্জন করে বাইরের দেশগুলোতে নিজেদের চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে। এছাড়া আমাদের নিজেদের সাবলীল উপস্থাপনায় কিছু ঘাটতি আছে। আমরা কি কাজ করি, সেটা আমাদের সিভিতে সাবলীলভাবে তুলে ধরতে পারি না। তবে এখন অবশ্য দেশের অনেক প্রফেশনাল রাইটাররা এটা নিয়ে কাজ করছে। আমি তাদের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই।

জাগো জবস : দেশে বেকার সমস্যার কারণ কী- উদ্যোক্তার অভাব, যোগ্যতার অভাব, না কি চাকরির অভাব?
তাহসিন জাকারিয়া : আমার মনে হয়, এত মোটা দাগে এরকম একটি জটিল বিষয়ে আমরা সরাসরি সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি না। আমরা দক্ষ মানবশক্তির অভাবে এদেশ থেকে যেমন একসময় অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চলে যেতে দেখেছি, আবার চাকরির অভাবে দক্ষ ব্যক্তিদের দেশের বাইরে চলে যেতেও দেখেছি। দক্ষ ব্যক্তি বলতে যা বোঝায় তা ঠিক করবে বাজার। বাজারে দক্ষতার কাটতি ও কদর দু’টোই আছে। অভাব যা আছে তা সমন্বয়ের। বিশেষ করে, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে আমাদের চাকরির বাজারের রয়েছে বিশাল ব্যবধান।

জাগো জবস : জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে আপনি কোন কোন বিষয়ে বিশেষ নজর দেন?
তাহসিন জাকারিয়া : মানব সম্পদ বিভাগের কর্মী হিসেবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে গিয়ে সেখানকার সমস্যাগুলো আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। পেয়েছি এমন কিছু সহকর্মী যাদের ছিল অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলার মতো তীব্র মানসিকতা। আজকের দিনে প্রত্যেক কর্মীকেই তার নিজ নিজ ক্ষেত্রে একজন উদ্যোক্তার মত চিন্তা-ভাবনা নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। আমি শুধু কর্মীই খুঁজি না, আমি কর্মীর মাঝে একজন উদ্যোক্তাকেও খুঁজি।

tahsin

জাগো জবস : ‘সুপারিশ ছাড়া চাকরি হয় না’- নতুনদের অনেকেরই এই ধারণা। আপনার দৃষ্টিকোণ থেকে এটাকে কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন?
তাহসিন জাকারিয়া : একজন মানব সম্পদ বিভাগের পরামর্শক হিসেবে যখন আমাদের রিক্রুটমেন্ট, সিলেকশন এবং পে রোল নিয়ে কাজ করতে হয়; তখন আমরা একজন কর্মীর অতীতের অর্জনসমূহ বিশ্লেষণ করি ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনাগুলো সেটার সঙ্গে যুক্ত করে সিদ্ধান্তে উপনীত হই। সে ক্ষেত্রে কখনোই কারো সুপারিশকে প্রাধান্য দেই না।

জাগো জবস : মৌখিক পরীক্ষার সময় প্রার্থীদের কী কী সমস্যা আপানার চোখে পড়ে?
তাহসিন জাকারিয়া : পারফরমেন্স ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম এবং কেপিআই কনসালটেন্ট হিসেবে আমি দেখেছি, কোম্পানিতে অনেক মানুষ অসন্তুষ্টি নিয়ে কাজ করেন। অনেকে আছেন নিজের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির ব্যাপারে মনযোগী না হয়েই বেতন বৃদ্ধির অজুহাতে কর্মস্থলে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করেন। এ ধরনের প্রার্থীরা ইন্টারভিউ দিতে এসে প্রায়ই ঘাবড়ে যান এবং আগের কোম্পানিগুলোর বাজে অভিজ্ঞতা শেয়ারের অন্তরালে নিজের দুর্বলতাগুলোকে তুলে ধরেন।

জাগো জবস : কর্মজীবনে প্রবেশের আগে কীভাবে নিজেকে আমরা প্রস্তুত করতে পারি?
তাহসিন জাকারিয়া : আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। সেজন্য পড়াশোনার পাশাপাশি পাঠ্যক্রম বহির্ভূত বিভিন্ন সামাজিক ও খণ্ডকালীন কর্মকাণ্ডে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে হবে। আর স্বপ্ন দেখা কখনোই বন্ধ করা যাবে না। স্বপ্নটা সফল করার জন্য যা করা দরকার (জ্ঞানার্জন, দক্ষতার উন্নয়ন কিংবা অভ্যাসের পরিবর্তন); তা সময় শেষ হওয়ার আগেই শেষ করতে হবে।

tahsin

জাগো জবস : মানব সম্পদ বিভাগে কাজ করার আনন্দ ও চ্যালেঞ্জটা কোথায়?
তাহসিন জাকারিয়া : মানব সম্পদ বিভাগে কাজ করার সবচেয়ে বড় পুরস্কার হলো- আপনার সিদ্ধান্ত ও কাজের প্রতিফলন পুরো প্রতিষ্ঠানের উপরে কী প্রভাব ফেলছে তা সরাসরি দেখতে পাবেন। এইচআরের যে পর্যায়েই আপনি চাকরি করেন না কেন, আপনার কর্ম ও দক্ষতার প্রভাব পড়বে প্রতিষ্ঠানের সব পর্যায়ে। সর্বোপরি ওই প্রতিষ্ঠানের মানব সম্পদের উপরে। এটি একইসঙ্গে যেমন আনন্দের বিষয়, সেইসঙ্গে চ্যালেঞ্জও বটে।

জাগো জবস : দক্ষ মানব সম্পদ প্রফেশনাল হতে হলে কীভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে?
তাহসিন জাকারিয়া : পেশাগত ও ব্যক্তিগত দু’পর্যায়েই মানব সম্পদ উন্নয়নে আমি কাজ করছি। পেশাগতভাবে জাতিসংঘের একজন কনসালটেন্ট হিসেবে বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থায় মানব সম্পদ উন্নয়নে আমাকে সাপোর্ট দিতে হয়। এছাড়াও আমরা ‘স্কীলউইজ’ থেকে মানব সম্পদ উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন ধরনের ট্রেনিং ও সার্টিফিকেশন প্রোগ্রাম আয়োজন করে থাকি। দেশে দক্ষ মানব সম্পদ প্রফেশনাল তৈরি করার জন্য স্কীলউইজ প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে এইচআরের সর্বোচ্চ প্রফেশনাল সার্টিফিকেশন এসপিএইচআরআইয়ের (SPHRi) এক্সাম প্রিপারেশন কোর্স চালু করেছে। এছাড়াও এইচআরের উপরে দক্ষতা বাড়াতে হলে লেবার ল’ ভালোভাবে জানতে হবে। এইচআরের উপরে ছোটোখাটো ট্রেনিং অথবা শর্ট কোর্স আপনার জ্ঞান পিপাসা আরো বাড়িয়ে দেবে।

জাগো জবস : জাগো নিউজের পক্ষ থেকে আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা।
তাহসিন জাকারিয়া : জাগো নিউজ এবং আপনাকেও ধন্যবাদ।

এসইউ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।