মানব সম্পদে ক্যারিয়ার গড়তে চাইলে


প্রকাশিত: ০৯:৩১ এএম, ২৫ এপ্রিল ২০১৭

একবার এক ইন্টারভিউতে আমাকে প্রশ্ন করা হলো- ‘এইচ আর প্রফেশনাল হিসেবে আপনার বর্তমান প্রতিষ্ঠানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী ফেস করেছেন?’ আমি ২-৩টা বিষয়ের কথা বললাম যা সঠিক ছিল। এরপর জানতে চাইলেন এর কারণ কী? কেন এমন হলো? আমি কমপক্ষে ৫টি যুক্তিসঙ্গত কারণ বললাম। কিন্তু প্রশ্নকর্তা মানলেনই না। মনে মনে তখন ভাবছি, উনি আমাকে চাকরিটা দিবেন না। সেজন্য সম্ভবত অযথা এমন প্রশ্ন করছেন। যার আসলে লজিক্যাল কোনো উত্তর নাই। অথবা এমন কিছু একটা বলবে যা শুনে মেজাজ খারাপ হয়ে যাবে।

এরপর উনি উত্তরটা দিলেন এবং একবাক্যে স্বীকার করতে হলো। উনি বললেন, ‘আমাদের এইচআর প্রফেশনালদের সমস্যা কি জানেন? এইচআররা বিজনেস বোঝেন না। মালিক আসছে বিজনেস করার জন্য, চ্যারিটি ফার্ম খুলে বসেননি। আপনি আসছেন তার ব্যবসাতে কীভাবে আরো ভ্যালু অ্যাড করা যায় তার জন্য। কীভাবে ব্যবসা বৃদ্ধি করা যায় তার জন্য।’

দেশের বেশিরভাগ লোকাল কোম্পানিতে এইচআর বিভাগের কার্যক্রম সন্তোষজনক নয়। এর অনেক কারণ আছে। ছোট করে বলতে গেলে-
• আমরা যে সরাসরি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তা বোঝাতে পারি না।
• আমাদের কাজগুলো কীভাবে সরাসরি ব্যবসাকে প্রভাবিত করে তার সন্তোষজনক ব্যাখ্যা আমরা দিতে পারি না।
• আমরা মালিকপক্ষকে বুঝতে ভুল করি বা তাদের ইচ্ছা কি তা বুঝতে পারি না।
• যেখানে মালিকপক্ষকে শিক্ষিত করা দরকার; সেখানে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারি না।
• মালিকপক্ষের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে অনেক ক্ষেত্রে।
• লং টার্ম স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যান করতে ব্যর্থ হই। যেখানে স্পষ্ট করে শর্ট টার্ম এবং লং টার্ম বেনিফিট কি তা দেখাতে পারি না।
এগুলো বলার উদ্দেশ্য হলো- যারা নতুন আসছে; তারা এই বিষয়গুলো মাথায় রেখে কাজ শুরু করলে সাফল্য আসতে বাধ্য।

এইচআরে ক্যারিয়ার শুরু করার আগে বেশকিছু বিষয় মাথায় রেখে শুরু করা ভালো। যেমন ইন্টারভিউ বোর্ডে কিছু কমন প্রশ্নের মধ্যে একটি হলো- আপনি কেন এইচআরে ক্যারিয়ার শুরু করতে চান। এখানে অনেক উত্তর আমি পেয়েছি, যা প্রমাণ করে যে চাকরিপ্রার্থী আসলে-
• অন্য ট্র্যাকে কনফিডেন্স পায়নি।
• বড় ভাইরা বলেছেন তাই।
• ভার্সিটিতে অন্য বিভাগে পড়ার সুযোগ ছিলো না।
• অনেকে মনে করে এইচআরে কাজ করা মানে ম্যানেজমেন্ট থেকে পাওয়ার পাওয়া।
• কেউ অঙ্ক করতে ভয় পায়, মনে করে এইচআরে ক্যালকুলেশনের কাজ কম তাই।
এমন অনেক উত্তর পেয়েছি যা সময়ভেদে হাস্যকর, বিরক্তিকর, কষ্টদায়ক, হতাশার, উৎসাহদায়ক এবং আনন্দেরও। এখন প্রশ্ন হলো- কীভাবে বুঝবো যে, আমার জন্য এইচআর ইজ বেস্ট। এরজন্য দুটি কাজ করতে হবে–

প্রথমত এটা জানা জরুরি যে, ইন্ডাস্ট্রিভেদে প্রতিষ্ঠানগুলোতে সাধারণত কী কী বিভাগ থাকে, সেসব বিভাগে কী ধরনের কাজ হয়, কীভাবে কাজ হয়, এসব কাজের জন্য কী ধরনের নলেজ-স্কিল-অ্যাটিচ্যুড-শিক্ষা লাগে। দ্বিতীয়ত নিজেকে আবিষ্কার করা যে, আমার মধ্যে কী কী স্ট্রেন্থ এবং উইকনেস আছে। যখন আপনি এ দুটি বিষয় জানবেন তখন সুন্দরভাবে সিংক করতে পারবেন। বুঝতে পারবেন আপনার কোন ট্র্যাকে শুরু করা উচিত। যার মানুষের সঙ্গে মিশতে সমস্যা বা ব্যক্তি হিসেবে ইন্ট্রোভার্ট টাইপ, যার পিপল ডেভেলপমেন্টে তেমন আগ্রহ নেই, যার অনেক ইগো, যার ধৈর্যশক্তি কম, যার মানুষ চিনতে ভুল হয়, পেট পাতলা টাইপ মানুষ (পেটে কথা থাকে না) তার আসলে এইচআরে আসা উচিত নয়।

এইচআরে অনেকগুলো উইং আছে যেমন রিক্রুটমেন্ট, ট্রেনিং, কম্পেন্সেশন, অপারেশন্স ইত্যাদি। এদেশে সবগুলো উইংয়ে এক্সপার্ট এমন এইচআর প্রোফেশনাল খুব কম। আবার আপনি সব না জানলে কখনো এইচআর হেডও হতে পারবেন না। আপনার আগ্রহ আর নিজের যোগ্যতা বিবেচনা করে আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আপনার শুরুটা যেখান থেকেই হোক না কেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাকি উইংগুলোর এক্সপোজার বাড়াতে হবে। কতগুলো বেসিক বিষয় আছে এইচআরে; যেসব বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা থাকতেই হবে-
১. এইচআর বিভাগের মূল কাজটা কি একটি প্রতিষ্ঠানে তা জানতেই হবে।
২. লেবার ল’ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে।
৩. কিছু টার্ম আছে যেগুলো সম্পর্কে আপনার দক্ষতা বা জ্ঞান থাকতে হবে।
যেমন- কেপিআই/কেআরএ, পারফরমেন্স ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম এবং এর প্রকারভেদ, ট্রেনিংয়ের বিভিন্ন টাইপ, ট্রেনিং বাজেট, ক্যালেন্ডার, ট্রেনিং ইভ্যালুয়েশন, আরওআই, কম্পিটেন্সি ফ্রেমওয়ার্ক, জব ডেস্ক্রিপশন, জব ইভ্যালুয়েশন, ট্যালেন্ট মানেজমেন্ট, এইচআর বিজনেস পার্টনার মডেল, এসেসমেন্ট সেন্টার, সাইকোমেট্রিক টেস্ট, ব্যালেন্স স্কোর কার্ড, ৩৬০ ডিগ্রি ইভ্যালুয়েশন, এইচআর অ্যাকাউন্টিং, কমপ্লায়েন্স, গ্রিভেন্স ম্যানেজমেন্ট, ডিসিপ্লিনারি ইস্যুজ, ডাব্লিউপিপিএফ, প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুয়িটি ইত্যাদি।

আপনার যদি অভিজ্ঞতা না থাকে তাহলে প্রশ্নকর্তা আপনার জ্ঞ্যানের ব্যাপ্তি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবেন। আপনার কন্সেপ্ট ক্লিয়ার কিনা এবং আপনার শেখার আগ্রহ কতখানি। তাই উল্লেখিত বিষয়গুলো সম্পর্কে ভালো জ্ঞান থাকাটা অনেক জরুরি। এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো যে, আপনার সিদ্ধান্ত নিতে হবে- আপনি কি জেনেরালিস্ট হবেন না স্পেসিফিক কোনো উইংয়ে যাবেন। যেমন আপনি পুরোদস্তুর ট্রেনিং নিয়ে কাজ করতে পারেন বা ট্যালেন্ট ম্যানেজমেন্ট নিয়ে কাজ করতে পারেন বা শুধু কম্পেন্সেশন অ্যান্ড বেনেফিট স্পেশালিস্ট হতে পারেন। সবগুলোরই অ্যাডভান্টেজ এবং ডিজঅ্যাডভান্টেজ আছে। তবে আপনি যদি হেড অব এইচআর হতে চান তবে আপনাকে সবকিছু সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে।

বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র প্ল্যাটফর্ম ‘বোল্ড’ বাংলাদেশ অরগানাইজেশন ফর লার্নিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সংসদ সদস্য জুনায়েদ আহমেদ পলক একটা কথা বলেছিলেন আমাদের, ‘বর্তমান সরকারের ৪টি টপ প্রাইওরিটির মধ্যে দ্বিতীয়টিই হল পিপল ডেভেলপমেন্ট।’ সুতরাং একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সামনের দিনগুলোতে মানব সম্পদ উন্নয়ন নিয়ে সরকারি এবং বেসরকারিভাবে অনেক কাজ হবে।

উঠতি এইচআর প্রফেশনালদের জন্য সুযোগ যেমন রয়েছে আগের চেয়ে অনেক বেশি; তেমনিভাবে চ্যালেঞ্জও যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। তবে শেষ কথা একটাই- এইচআর যদি বিজনেস না বুঝে কাজ করে তাহলে এইচআরে ভালো প্রতিষ্ঠানে কাজ করাটা এককথায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।

লেখক : ডেপুটি ম্যানেজার (এইচআর), সুপার স্টার গ্রুপ

এসইউ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।