অন্ধের দেশে আয়না বিক্রি


প্রকাশিত: ০৮:২৫ এএম, ১৪ জুন ২০১৬

কিছুদিন আগে সংবাদে দেখছিলাম- এক গৃহকর্মীর গায়ে আগুন লেগেছিল। সে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করছিল এবং অনেকের কাছে সাহায্যও চেয়েছিল। সাহায্য না পেয়ে সে আরো ছোটাছুটি করতে থাকে। এভাবে তার শরীরের ৫৬ শতাংশ পুড়ে যায় এবং সে মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু সে যদি জানতো- কাপড়ে আগুন লাগলে ছোটাছুটি না করে শুয়ে গড়াগড়ি দিতে হবে, তাহলে হয়তো সে তার এই অকালমৃত্যু ঠেকাতে পারতো। সামান্য একটু জ্ঞানের অভাব একজন মানুষের জীবনে মৃত্যু ডেকে আনলো। কিন্তু তবুও কি আমরা সচেতন হতে পেরেছি?
 
কারো মৃত্যু হচ্ছে শারীরিক, কারো মৃত্যু হচ্ছে মানসিক। আমরা অনেকেই অনেক বড় বড় ডিগ্রি নিয়েছি হয়তো। কিন্তু আমরা কি স্বশিক্ষিত হতে পেরেছি? পৃথিবীর অনেক সফল ব্যক্তির জীবনী পড়েছি। কিন্তু কেউ তার জীবনীতে লেখেননি যে, ‘আমার বাবা ধনী ছিলেন। আমার পড়াশোনা করার অনেক সুযোগ ছিলো। পড়ালেখা ছাড়া আমার আর কোনো কাজ ছিল না। আমার বাসায় তিন-চারটা টিচার এসে পড়িয়ে যেত।’

বরং তাদের জীবনী থেকে আমরা যেটা পাই, তা হচ্ছে- তাদের সকলেরই ছিলো জ্ঞান লাভের পিপাসা। তবে তার মানে এই নয় যে স্কুল-কলেজে না গেলেই রবীন্দ্রনাথ হওয়া যাবে বা রুটির দোকানে কাজ করলেই নজরুল হওয়া সম্ভব। বড় মানুষের বড় লক্ষ্য থাকে।

একটি বাচ্চাকে লক্ষ্য করলে দেখবেন, সে যখন খুব ছোট। তার ভিতর কেবলই কৌতূহল- এটা কি? ওটা কি? এটা কেন হল? ওটা কেন হল? হাজার হাজার প্রশ্ন। যতই তার বয়স বাড়ে তার প্রশ্ন করা কমে যায়। ভিতরে কিছুটা ইগো চলে আসে, চলে আসে একটা চাপা অহংকার যা তার জীবনে উন্নতির কোমর ভেঙে দেয়। ফলে যা হয়, সে আজীবন মধ্যবিত্তই থেকে যায়। অথচ যতই আপনি প্রশ্ন করবেন, ততই আপনি জানবেন। শিশুর মত প্রশ্ন করতে শিখুন।

একবার দু’জন বিক্রয়কর্মীকে আফ্রিকায় পাঠানো হল জুতো বিক্রির জন্য। দু’জনই গিয়ে দেখলেন লোকজনের পা খালি। প্রথম বিক্রয়কর্মী কোম্পানির হেড অফিসে ফোন করে জানালেন, ‘এখানকার লোক জুতো পরে না। কাজেই এখানে জুতা বিক্রির চিন্তা করে লাভ নেই।’ দ্বিতীয় বিক্রয়কর্মী জানালেন, ‘এখানে কেউ জুতা পরে না, কাজেই যা বানাবো তা-ই বিক্রি হবে, এই অঞ্চলের জন্য কোম্পানির উৎপাদন দ্বিগুণ করতে হবে।’ সুতরাং সবকিছুর মূলে হচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গি। আপনাকে একটি গ্লাসের অর্ধেকটা পানি দিয়ে দেয়া হল। আপনি কী অর্ধেক গ্লাস পূর্ণ দেখবেন, নাকি অর্ধেক গ্লাস খালি দেখবেন, নাকি অর্ধেক গ্লাস পানি ও অর্ধেক গ্লাস বাতাস দেখবেন। নাকি বলবেন, ‘গ্লাসটি আরো ছোট হওয়া দরকার ছিলো।’ সবই আপনার দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভর করছে।

আমরা সবাই প্রফেশনাল শব্দটার সাথে পরিচিত। এটার অর্থ সমাজে এমন যে, প্রফেশনাল মানেই বুঝি একটু বেশি ভাব, অহংকার, দেয়া-নেয়া টাইপ সম্পর্ক। কিন্তু আসলে কি তাই? প্রফেশনাল ব্যাপারটা হচ্ছে, আপনি কী জানেন তা জানা ও আপনি কি জানেন না তা জানা। অর্থাৎ আপনার সবল ও দুর্বল দিকগুলো সম্পর্কে জানা। এটা একটা আত্মোন্নয়নের প্রক্রিয়া।

আমরা সবাই একই রকমের হার্ডওয়্যার নিয়ে জন্মেছি। সবার দিনই চব্বিশ ঘণ্টার। এই ২৪ ঘণ্টা কাজে লাগিয়ে কেউ সফল হচ্ছি, কেউ ব্যর্থ হচ্ছি। স্রষ্টার সব সৃষ্টি আমরা সবাই সমানভাবেই ব্যবহার করছি। সবকিছুর মূলে হচ্ছে নিজেদের ইচ্ছাশক্তি। আমরা কেউই জন্মান্ধ নই। আমাদের চোখের সামনে একটি পট্টি বাঁধা যা আমাদের অন্ধ করে রেখেছে।

আমরা কেউ তো আজীবন বাঁচবো না। মৃত্যুর সময় আমরা কী রেখে যাচ্ছি- যা দ্বারা আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম উপকৃত হবে? জীবনটা হেসে-খেলে কাটানোর জন্য নয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘জন্মের সময় তুমি কেঁদেছিলে, সকলে হেসেছিলো, জীবনে এমন কিছু কর, যাতে মৃত্যুর সময় সকলে কাঁদে, কিন্তু তুমি হাসতে পারো।’

আমাদেরকে জন্মের পর থেকে শেখানো হচ্ছে- ‘পুকুর পাড়ে যেও না, তুমি কিন্তু সাঁতার জানো না।’ তবে আমরা যদি শিখতে পারতাম, ‘চলো আজ পুকুরে নেমে সাঁতার শিখি।’ তাহলে হয়তো আমাদের চিন্তা-ভাবনাগুলো অন্যরকম হতে পারতো। ‘তুমি এটা পারবে না। তোমাকে দিয়ে এটা হবে না। তুমি এটা করবে না। এই পথে যাবে না।’ হাজার হাজার বার না শুনতে শুনতে আমাদের ছেলেমেয়েরা বেড়ে ওঠে। তাদের অন্তরের সেই কৌতুহলী মানুষটাকে গলা চেপে মেরে ফেলা হয়। কিন্তু তাই বলে কি এদেশে প্রতিভা নেই? তাহলে মাশরাফি হলেন কীভাবে? মুস্তাফিজ হলেন কীভাবে? এরা তো ভিনগ্রহের কেউ নন। আমার আপনার মতই মানুষ। পার্থক্য একটাই। এদের অন্তর্চক্ষু অন্ধ নয়। এরা স্বশিক্ষিত।

বইপড়ার প্রতি কোথায় যেন আমাদের অনেক আলসেমি? গদবাধা সিলেবাসের বাইরেও যে পড়তে হয় বা হবে, এরকম যেন আমরা ভাবিই না। দেশের প্রকাশক, লেখক সবাই যেন অনেকটা অন্ধের দেশের আয়না বিক্রির মত সংগ্রাম করে চলেছি। মুখে বলছি আমরা প্রফেশনাল। কিন্তু সেটা অহংকারের প্রফেশনাল, উদারতার নয়। একটা নেতিবাচক বলয় আমাদের ঘিরে রেখেছে। আমরা নিজেদের কৃষ্টি, কালচার, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য সব ভুলে এখন কেবলই পুঁথিগত বিদ্যায় মগ্ন। নতুনদের অনেকে জানেই না তার দাদার নাম কী? তার বাপ-দাদার বসতি কোথায় ছিল? পাশাপাশি মা-বাবারাও আদর দেয়ার নাম করে সন্তানদের করে তুলছেন ইতিহাস বিমুখ। অনেক ক্ষেত্রে তারা জানেই না তাদের শেকড় কোথায় ছিল। কিন্তু আমরা তো এমন ছিলাম না। তাহলে আমরা কেন এমন হয়ে যাচ্ছি? এই অবস্থার কি পরিবর্তন হবে না?

আমার মনে হয়, অবশ্যই হবে। কারণ, আমরা সর্বদা কাজ করে চলেছি সমাজের মানুষের চোখের এই পট্টি সরিয়ে নিতে। খুব ইচ্ছে করে, সবাইকে পরিবর্তন করে দেই। মানুষগুলোকে স্বশিক্ষিত করে তুলতে সাহায্য করি। হয়তো আজ এই যাত্রায় আমরা কয়জন। কিন্তু হাজার মাইলের যাত্রা শুরু হয় প্রথম পদক্ষেপ থেকে। কাজেই আমি বিশ্বাস করি আমরা অন্ধ নই, এই পট্টি সরিয়ে আমরা খুব শীঘ্রই স্বশিক্ষিত হয়ে দেশ ও জাতির উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবো।

লেখক: ট্রেইনার ও প্রফেশনাল সিভি রাইটার এবং সিইও, কর্পোরেট আস্ক। ইমেইল- [email protected]

এসইউ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।