টার্গেট কখনোই শুধু বিসিএস ছিল না: হাবিবুর রহমান
মো. হাবিবুর রহমানের জন্ম চাঁদপুর হলেও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। তিনি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। বাবা ব্যাংকার এবং মা গৃহিণী। তিনি একে উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। উভয় পরীক্ষায় গোল্ডেন এ প্লাস পেয়ে মেধার স্বাক্ষর রাখেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করেন। পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে চাকরির প্রস্তুতিতে নামেন। কিছুদিন বাদেই সাফল্যের দেখা পান। প্রথমে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকে অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। তবে ছয় মাসের মধ্যেই সোনালী ব্যাংক পিএলসিতে সিনিয়র অফিসার হিসেবে চাকরি পান। এরপর স্বপ্নের চাকরি ৪৩তম বিসিএসের প্রশাসন ক্যাডারে নিজের নাম লেখান।
সম্প্রতি জাগো নিউজের সঙ্গে তিনি ৪৩তম বিসিএস জয়, ক্যারিয়ার পরামর্শ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—
জাগো নিউজ: ৪৩তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডার পেয়েছেন, আপনার অনুভূতি কেমন?
মো. হাবিবুর রহমান: এ অনুভূতি আসলে ভাষায় প্রকাশ করার মতো না! ওই সময়টা আজীবন মাথায় গেঁথে থাকবে। এখনো মনে আছে। বাসে বসে ছিলাম, আগে থেকেই জানতাম ওইদিন রেজাল্ট দিতে পারে। বারবার ফেসবুকে বিভিন্ন গ্রুপে স্ক্রল করতে ছিলাম। রেজাল্টের পিডিএফ দেখা মাত্র হাত-পা কাঁপাকাঁপি করতে লাগলো। পিডিএফ ওপেন করে নিজের রোল সার্চ দিতেই বুঝলাম প্রশাসন আসছে। নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না। রোল নাম্বার কয়েকবার করে সার্চ দিতে লাগলাম। বউকে দিয়ে চেক করলাম। আসলে ব্যাপারটা এত বেশি অবিশ্বাস্য ছিল যে, নিজেকে বিশ্বাস করানোটা কঠিন ছিল।
জাগো নিউজ: বিসিএসের স্বপ্ন দেখেছিলেন কখন থেকে?
মো. হাবিবুর রহমান: ভার্সিটি লাইফের শুরু থেকে কখনোই বিসিএস বা চাকরির ব্যাপারে সেভাবে আগ্রহ তৈরি হয়নি। মূলত শুরু হয় অনার্স পরীক্ষার শেষ হওয়ার পর। চতুর্থ বর্ষে পড়াকালীন ভার্সিটির এক বড় ভাইয়ের কাছে প্রথম বিসিএস সম্পর্কে জানা। এরপর ফেসবুকে থাকা বিভিন্ন পেজ ও গ্রুপে ঘাটতে থাকি। বিসিএস ও অন্যান্য সরকারি চাকরি সম্পর্কে ধারণা নিতে থাকি। প্রচুর ভিডিও দেখতাম, ক্যাডার ভাইয়াদের প্রোফাইল ঘাটতাম। ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার পদটাও খুব লোভনীয় ছিল আমার কাছে (যেহেতু বাবা ব্যাংকার)। বিভিন্ন পরীক্ষার রেজাল্ট দিলেই যারা চান্স পেতেন; তাদের বিভিন্ন ভাবে ফলো করতাম, বিভিন্ন প্রশ্ন করতাম। অনার্স শেষ করেই পুরোদমে লেগে গেলাম। আমার টার্গেট কখনোই শুধু বিসিএস ছিল না, শুরুতে যে কোনো একটা প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরি পাওয়াকে মূল বিষয় হিসেবে ধরেছিলাম।
জাগো নিউজ: বিসিএস যাত্রার গল্প শুনতে চাই, প্রস্তুতি কীভাবে নিয়েছেন?
মো. হাবিবুর রহমান: যাত্রার একদম শুরুতে ঘাটাঘাটি করেছি প্রচুর। বিসিএসের সিলেবাস প্রিন্ট করে নিয়ে কয়েকদিন শুধু সিলেবাসটাই দেখেছি। কী কী আসে। মনে হয় পুরো সিলেবাসটাই মুখস্থ করে ফেলেছিলাম। এরপর বড় ভাইয়ার পরামর্শে বিগত বছরে প্রশ্ন সমাধান করতে শুরু করি। ফলিত গণিতে পড়ার কারণে এবং টিউশনি করার অভিজ্ঞতা থাকার কারণে গাণিতিক যুক্তি, মানসিক দক্ষতা, ইংরেজি গ্রামার অংশের প্রশ্ন সমাধানে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। বেশ কিছু প্রশ্ন সমাধান করার পর বুঝলাম বাংলা ও সাধারণ জ্ঞান অংশ খুব ভাবাচ্ছে। বাংলা ব্যাকরণের জন্য নবম ও দশম শ্রেণির বই মুখস্থ করে ফেললাম। আর সাধারণ জ্ঞান অংশের জন্য শুধু বই থেকে না পড়ে, এর পেছনে থাকা বিভিন্ন কারণ সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করতাম। নিজেকে প্রশ্ন করতাম এই প্রশ্নটা বিসিএসে কেন এলো। এরকম আর কী কী প্রশ্ন আসতে পারে, এগুলো নিয়ে ঘাটাঘাটি করতাম। প্রচুর পত্রিকা পড়তে শুরু করলাম। সারাদিনে যখনই একটু সময় পেতাম পত্রিকায় চোখ বোলাতাম। রিটেন অংশে যেটা আমার অনেক বেশি উপকারে এসেছিল।
জাগো নিউজ: পর্দার আড়াল থেকে কেউ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন?
মো. হাবিবুর রহমান: অনুপ্রেরণা আসলে খুবই কঠিন একটা টার্ম। একক ভাবে কারো কথা আসলে বলার সুযোগ নেই। তবে বাবা, মা, বউকে আলাদা ভাবে ক্রেডিট দিতেই হয়। আমার প্রতি তাদের বিশ্বাস, আমার নিজের কনফিডেন্স বাড়াতে খুব বড় ভূমিকা রেখেছেন। এমনকি অনেক ব্যাপারে তারা আমাকে নিয়ে আমার থেকেও বেশি কনফিডেন্ট ছিলেন। মনে পড়ে করোনার পর বেশ কিছু সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিয়েও যখন প্রিলিমিনারিই পাস করতে পারছিলাম না; তখনো বাবা-মাকে বিন্দুমাত্র কোনো টেনশন করতে দেখিনি। একবারও বলতে শুনিনি, এখনো হচ্ছে না কেন।
জাগো নিউজ: নতুনরা বিসিএসের জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নেবেন?
মো. হাবিবুর রহমান: সত্য কথা বলতে, বিসিএস প্রস্তুতি শুরুর আগে প্রথম মনস্থির করতে হবে যে, আমি ওই জায়গায় নিজেকে দেখতে চাই। যেভাবে হোক ওই জায়গায় যাবোই। এটুকু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেকে অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে (সস্তা মোটিভেশনাল) দুই-একদিন খুব পড়াশোনা করেন। খুব মানে অনেক। মনে হয় সব পড়ে ফেলবেন, প্রতি সাবজেক্টে তিন-চারটা বই পড়বে। দিন শেষে দেখা যায়, দু’একদিন পর আর পড়তেই বসা হয় না। ধীরে ধীরে অনেকদিন বইয়ের সাথে কোনো সম্পর্কই থাকে না। এটার অন্যতম কারণ হলো, প্রবল ইচ্ছাশক্তি না থাকা। বিসিএস জার্নিটা অনেক বড় একটা জার্নি। এখানে ধৈর্য ধরে লেগে থাকাটাও একটা পরীক্ষা। নতুনদের জন্য সবথেকে বড় হচ্ছে—কী পড়বো, কতটুকু পড়বো এবং কোন বই পড়বো। এতসব খোঁজাখুঁজির মাঝখান থেকে পড়াশোনা করতেই যেন ভুলে না যাই। নিয়মিত পড়াশোনা করার কোনো বিকল্প নেই। সবথেকে ভালো উপায় হলো, একটা টার্গেট সেট করে সেই অনুযায়ী প্রতিদিনই কিছু না কিছু পড়া। পড়াশোনার মধ্যে থাকলে নিজেই বুঝতে পারবেন কোথায় দুর্বলতা আছে।
জাগো নিউজ: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
মো. হাবিবুর রহমান: আমি বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের একজন হিসেবে গেজেটেড হয়েছি। তাই আপাতত এর বাইরে কোনো পরিকল্পনা নেই। আল্লাহ হয়তো খুব ভালোবাসেন আমাকে, না হলে এত বড় একটা সুযোগ করে দিতেন না। এই ক্যাডারের বড় সুবিধা হলো, খুব কাছ থেকে মানুষের সেবা করা যায়। নিজের দায়িত্ববোধ ও বিবেকের মধ্য থেকে নিজের কাজটুকু করে যেতে চাই। নতুন বাংলাদেশে নতুন প্রশাসক হিসেবে নিজেকে তৈরি করতে চাই।
এসইউ/জেআইএম