সহকারী শিক্ষকদের দশম গ্রেড কেন জরুরি?
সোহাইল মিয়া
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ‘সহকারী শিক্ষক’দের বেতন নিছক কোনো দাবি নয়, এটি তাদের ন্যায্য অধিকার। এখনই তাদের দশম গ্রেড বাস্তবায়ন জরুরি। পৃথিবীর প্রায় সব উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে শিক্ষকতা একটি মর্যাদাসম্পন্ন ও সম্মানজনক পেশা। সব দেশেই সব জায়গাতে শিক্ষকের কদর ও মূল্যায়ন বেশি। শিক্ষকদের রাষ্ট্রীয় সম্মানের পাশাপাশি তাদের বেতনও উচ্চতর স্কেলে দেওয়া হয়। শিক্ষকেরা আর্থিক সুবিধা ছাড়াও রাষ্ট্র থেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। সে হিসেবে উন্নত দেশের তুলনায় আমাদের দেশের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা একেবারেই নগণ্য।
আমাদের দেশের শিক্ষকদের মর্যাদা ও বেতন একজন সরকারি অফিসের কেরানির চেয়েও কম। বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন গ্রেড ও মর্যাদা এখনো সেভাবে রাষ্ট্র দিতে পারেনি। এজন্যই শিক্ষকেরা এখনো সমাজে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হতে পারেননি। সব শ্রেণি-পেশার মানুষ সুন্দরভাবে চলতে পারলেও একজন প্রাথমিকের শিক্ষককে অনেক কষ্ট করে দিন পার করতে হয়। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের সমাজে শিক্ষক ও তার পরিবার পারিপার্শ্বিকভাবে হেয় বা অবমূল্যায়িত হবে। রাষ্ট্রকে সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে, একজন শিক্ষক যেন তার পরিবার-পরিজন নিয়ে সুন্দরভাবে সমাজে চলতে পারে।
একজন শিক্ষক যদি মাসের বেতনের টাকায় ঠিকমত চলতে না পারেন, তবে তিনি শিক্ষার্থীদের ঠিকমতো শিক্ষা দিতে পারবেন না। দেশে প্রায় ৩ লাখেরও বেশি প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক রয়েছেন। যাদের মধ্যে অধিকাংশই স্নাতক-স্নাতকোত্তর শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন। কিন্তু তাদের দীর্ঘদিনের বেতন বৈষম্য রয়েই গেছে। দাবি ছিল, তাদের ১০ম গ্রেডে বেতন পাওয়ার। অথচ সেটা হয়নি। এর আগে ১১তম গ্রেডে বেতন স্কেল দেওয়ার আশ্বাসও দেওয়া হয়েছিল সহকারী শিক্ষকদের! অথচ সেই আশ্বাস ছিল ফিকে। পাশাপাশি কিছু শিক্ষক নেতার লোভ-লালসাও এক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে!
বেতন বৈষম্য নিরসনের পাশাপাশি শিক্ষক হিসেবেই তারা দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা পাওয়ার দাবি রাখেন। তাছাড়া মানুন কিংবা না মানুন বিদ্যালয়ে ক্লাস ও অন্য কাজ-কর্মে সহকারী শিক্ষকরাই অনেক বেশি শ্রম দিয়ে থাকেন। এমনিতে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও প্রধান শিক্ষক পদে প্রমোশন হয় না অনেক সহকারী শিক্ষকের। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে অবসরে যান। নব্বই দশকের গোড়ার দিকে এদেশে প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করা হয়। বাড়ানো হয় নানা সুযোগ-সুবিধা। ভিত্তি যেমন দুর্বল বা সুদৃঢ় না হলে ভবনের কাঠামো নড়বড়ে হতে পারে; তেমনই জীবনের শুরুতেই প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন সঠিকভাবে না হলে পুরো শিক্ষাজীবনও সুদৃঢ় হবে না। এজন্য প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব সর্বাধিক।
আরও পড়ুন
প্রাথমিক শিক্ষকদের দাবি ১০ম গ্রেড প্রদান করা। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৩ বছর পার হয়ে গেল, বিগত সরকার এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। কিন্তু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্তরে স্নাতক-স্নাতকোত্তর শিক্ষকদের ১৩তম গ্রেডে তৃতীয় শ্রেণির মর্যাদায় রেখে দেওয়া হয়েছে। চরম একটা গ্রেড-বৈষম্যের শিকার হয়ে আছেন প্রাথমিক শিক্ষকেরা। প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড নিছক কোনো দাবি নয়, এটি ন্যায্য অধিকার।
প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের নিয়োগের জন্য যোগ্যতা, স্নাতক সমমান (২য় বিভাগ) বেতন গ্রেড ১৩তম। পাশাপাশি হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষকদের নিয়োগের যোগ্যতা স্নাতক সমমান, বেতন গ্রেড ১০ম। পুলিশের উপপরিদর্শকের নিয়োগের যোগ্যতা স্নাতক বা সমমান, বেতন গ্রেড ১০ম। হাসপাতালের নার্সদের নিয়োগের যোগ্যতা বিএসসি ইন নার্সিং, বেতন গ্রেড ১০ম। উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার নিয়োগের যোগ্যতা ৪ বছর মেয়াদি কৃষি ডিপ্লোমা, বেতন গ্রেড ১০ম। ইউনিয়ন পরিষদ সচিবের নিয়োগের যোগ্যতা স্নাতক, বেতন গ্রেড ১০ম।
বিগত দিনে শিক্ষকদের এই দাবি নিয়ে মানববন্ধন, আন্দোলনসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তর ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সাথে আলোচনা করলে ফলপ্রসূ বা সুর্নিদিষ্ট কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ পাচ্ছে। এত কিছুর পরও প্রাথমিক সহকারী শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য কোনোভাবেই দূর হচ্ছে না। মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বেতন বৈষম্য একটি বড় বিষয়। শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য নিরসনে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। উচ্চতর তথা ১০তম গ্রেডে বেতন নির্ধারণ করার দাবি অবিলম্বে মেনে নিয়ে তা বাস্তবায়নে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানাই। আর কত উপযুক্ত সম্মানি থেকে শিক্ষকদের বঞ্চিত করবেন। রাষ্ট্রকে শিক্ষকদের কল্যাণে দশম গ্রেড দিয়ে ন্যায্য দাবি পূরণ করতে হবে।
শিক্ষকতা শুধু পেশা নয়; একজন শিক্ষককে দীর্ঘদিনের চর্চার মাধ্যমে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার আলোকে শ্রেণিতে পাঠদান করতে হয়। একজন দায়িত্বশীল শিক্ষকই শিক্ষার্থী, সমাজ ও দেশকে পরিবর্তন করতে পারেন। শিক্ষক তাঁর সততা, নিষ্ঠা ও প্রজ্ঞা দিয়ে বদলে দিতে পারেন বিদ্যালয়ের সবকিছু। শিক্ষক সমাজের গুরু, পথনির্দেশক, আলোকিত ব্যক্তি। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি করতে হলে সবার আগে শিক্ষকদের ন্যায্য দাবি যৌক্তিকভাবে পূরণ করতে হবে। দশম গ্রেড বাস্তবায়ন করা হলে সহকারী শিক্ষকদের সঠিক মূল্যায়ন করা হবে; শিক্ষকদের মর্যাদা অক্ষুণ্ন থাকবে।
লেখক: প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক।
এসইউ/এমএস