বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি
যেভাবে নিয়োগ পরীক্ষায় দ্বিতীয় হলেন তারিক
মো. অহিদুজ্জামান তারিক যশোর সদরের চাঁচড়া ইউনিয়নের মাহিদিয়া গ্রামের সন্তান। শৈশবে গ্রামবাংলার জীবনকে পুরোদমে উপভোগ করেছেন। তার বাবা বিডিআরে (বর্তমান বিজিবি) চাকরি করতেন। বাবার চাকরিতে বদলির সুবাদে দেশের বিভিন্ন জায়গায় থাকতেন। একসময় তাদের বাস ছিল রাঙ্গামাটির কাপ্তাইয়ে। সুউচ্চ পাহাড়ের অজানাকে জানতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আর কর্ণফুলী নদীর বয়ে চলা দেখতে দেখতে কেটে গেছে শৈশবের অনেকটা সময়। তিনি বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফ পাবলিক কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা পানি ও পরিবেশ বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের শেষ করেন। পড়াশোনা শেষে সরকারি চাকরি করার ইচ্ছা থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরির পরীক্ষায় বসেন। প্রথম ধাপেই সফলতার দেখা পান। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘সহকারী পরিচালক’ (২০২৩ ব্যাচ) পদে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন।
সম্প্রতি তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি পাওয়ার গল্প ও নতুনদের পরামর্শ নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—
জাগো নিউজ: বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি পেয়েছেন, অনুভূতি কেমন ছিল?
মো. অহিদুজ্জামান তারিক: আসলে বাংলাদেশের বেকারত্বের হারের প্রেক্ষাপটে একটি চাকরি সোনার হরিণের মতো। তবে এই সত্যটি আমি বুঝতে পেরেছি স্নাতকোত্তর শেষ করে। এরপর থেকে সরকারি চাকরির বিভিন্ন সুবিধা বিবেচনা করে প্রথম শ্রেণির একটি চাকরির জন্য জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাই। অবশেষে মহান সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে সফল হই। মুদ্রানীতি প্রণয়ন এবং ব্যাংকিং সেক্টরের রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি একইসঙ্গে সম্মানজনক এবং খ্যাতিসম্পন্ন। চূড়ান্ত ফলাফলে নিজের রোল দেখে অনুভূতিটি ভাষায় প্রকাশ করার মতো ছিল না!
জাগো নিউজ: বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরির স্বপ্ন দেখেছিলের কখন থেকে?
মো. অহিদুজ্জামান তারিক: স্নাতক চতুর্থ বর্ষে থাকতে বন্ধুদের দেখতাম বিভিন্ন চাকরির ধরন এবং সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতে। তখনই জানতে পেরেছি বাংলাদেশ ব্যাংকের অসাধারণ কর্ম পরিবেশ, আর্থিক সুযোগ-সুবিধা এবং বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ সম্পর্কে। তখন থেকেই আসলে বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরির প্রতি একটি আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল।
জাগো নিউজ: বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি পাওয়ার গল্প শুনতে চাই, প্রস্তুতি কীভাবে নিয়েছেন?
মো. অহিদুজ্জামান তারিক: আমার চাকরির প্রস্তুতি শুরু থেকেই বিসিএস কেন্দ্রিক ছিল। একইসঙ্গে ইংরেজি ফ্রি-হ্যান্ড রাইটিং এবং গণিতের পেছনে অনেক সময় দিয়েছি। জানতাম বিসিএস একটি লম্বা যাত্রা, তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার হওয়ার পর থেকে পুরোদমে প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। সরকারি ব্যাংকের বিগত বছরের প্রশ্নব্যাংক কিনে প্রশ্ন সম্পর্কে ধারণা নিতে শুরু করি। বিসিএস প্রিলিমিনারির প্রস্তুতি থাকায় বাংলা, সাধারণ জ্ঞান এবং কম্পিউটারের জন্য আলাদা করে প্রস্তুতি নেওয়ার প্রয়োজন হয়নি। লিখিত পরীক্ষার জন্য সমসাময়িক বিষয়ে পত্রিকা থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নোট করা ছিল, যা আমাকে অনেক সহায়তা করেছে। গণিতের জন্য নবম-দশম শ্রেণির সাধারণ গণিত এবং উচ্চতর গণিত বই দুটি আমাকে যথেষ্ট সহায়তা করেছে। নিয়মিত নোট করার অভ্যাসের কারণে আলহামদুলিল্লাহ আমার লেখার গতি ভালো ছিল, যা আমাকে লিখিত পরীক্ষা নির্দিষ্ট সময়ের ভেতর শেষ করতে সহায়তা করে। মৌখিক পরীক্ষার জন্য আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে থাকা বেসিক কিছু তথ্য, মুদ্রানীতি, রাজস্ব নীতি, বিভিন্ন ব্যাংকিং টার্ম ইত্যাদি বিষয় জানার চেষ্টা করি এবং নিজ স্নাতক বিষয়ের ওপরও পড়াশোনা করে যাই।
জাগো নিউজ: আড়াল থেকে সব সময় কারা অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন?
মো. অহিদুজ্জামান তারিক: চাকরির প্রস্তুতির পুরো সময়টাই আমি আমার গ্রামের বাড়িতে কাটিয়েছি। সেখানে মা সর্বক্ষণ আমাকে উৎসাহ জোগাতেন। চাকরির প্রস্তুতির যাত্রাটি অনেক লম্বা এবং কণ্টকাকীর্ণ। এখানে ব্যর্থতা খুবই স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। হতাশা এখানে নিত্যসঙ্গী। এ ছাড়া এলাকায় চলাফেরার সময় এলাকাবাসীর কটু কথা তো আছেই। এসব কিছুই চারদিক থেকে যখন ঘিরে ধরতো তখনই আমার মা এবং বাবা আমাকে নানাভাবে বুঝিয়েছে, মানসিকভাবে শান্ত থাকতে সহায়তা করেছে। আমার বাবা সর্বদা বলেছেন, নিজের ওপর বিশ্বাস রাখতে কখনোই হতাশ না হতে। এ ছাড়া আমার এই যাত্রাই আমার বন্ধুরা, সহধর্মিণী এবং পূর্বের চাকরিস্থলের সহকর্মীরাও আমাকে নানাভাবে অনুপ্রাণিত করেছে।
জাগো নিউজ: বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি পেতে নতুনরা কীভাবে প্রস্তুতি নেবেন?
মো. অহিদুজ্জামান তারিক: বাংলাদেশের প্রাইভেট সেক্টরের অবস্থা তুলনামূলকভাবে উন্নত না হওয়ার কারণে সরকারি চাকরির প্রতি একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। যার জন্য দেখা যায় অনেকে স্নাতক চলাকালীন নিজের বৃদ্ধি এবং নিজ বিষয়ে সম্যক জ্ঞান অর্জনে মনোনিবেশ না করে সরকারি চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিতে দেখা যায়। বিষয়টি একইসঙ্গে দেশের টেকসই উন্নয়নের অন্তরায়। তাই আমি প্রথমেই যারা স্নাতকে অধ্যয়নরত আছেন; তাদের নিজ বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য এবং একইসঙ্গে ইংরেজি বলা এবং লেখাতে মনোনিবেশ করার জন্য পরামর্শ দেবো। স্নাতক শেষ করে এরপর চাকরির জন্য পুরোদমে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করা উচিত বলে মনে করি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক পদের প্রস্তুতির জন্য সর্বপ্রথম ইংরেজি এবং গণিতের ভিত্তি শক্তিশালী করতে হবে। এরপর বিগত সালগুলোর প্রশ্নের ধরন দেখে কী কী পড়া লাগবে; সেগুলোর একটি রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে। অনলাইন হোক আর অফলাইন, নিয়মিত পরীক্ষা দিতে হবে। এটি ছাড়া নিজেকে যাচাই করার আর কোনো উত্তম পন্থা আছে বলে আমার জানা নেই। একইসঙ্গে নবম-দশম শ্রেণির কোনো শিক্ষার্থীকে গণিত কিংবা ইংরেজি পড়ানো যেতে পারে। তাহলে অনেক বিষয়েই নিয়মিত চর্চা থাকবে। যেসব বিষয়ে নিজের দুর্বলতা আছে; সেখানে বেশি করে মনোযোগ দিতে হবে। নিয়মিত পত্রিকা পড়ার কোনো বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে অনলাইনে বাংলা এবং ইংরেজি পত্রিকাগুলোর আন্তর্জাতিক, অর্থনীতি এবং সম্পাদকীয় অংশ পড়া, বোঝা এবং সেখান থেকে গুরুত্বপূর্ণ কোনো লেখা নিজের ভাষায় নোট করাটা একইসঙ্গে ফ্রি-হ্যান্ড রাইটিং এবং ভাষার দক্ষতাকে শক্তিশালী করতে সহায়তা করবে।
জাগো নিউজ: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
মো. অহিদুজ্জামান তারিক: বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আমরা সবাই কমবেশি অবগত। এমতাবস্থায় ব্যাংকিং খাতে সুশাসন আনয়ন করা অত্যন্ত জরুরি। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সেই প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মী হিসেবে তাই প্রতিনিয়ত আমি নিজের জ্ঞানের পরিধি বাড়ানোর জন্য জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, যেন একজন দক্ষ কেন্দ্রীয় ব্যাংকার হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারি এবং দেশের অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারি। এ ছাড়া উচ্চতর দক্ষতা অর্জনের লক্ষ্যে ভবিষ্যতে দেশের বাইরে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের পরিকল্পনা আছে।
এসইউ/এএসএম