বিসিএস জয়

লক্ষ্য অর্জনে অদম্য হতে হবে: নাজমুল হোসেন

ইসমাম হোসাইন
ইসমাম হোসাইন ইসমাম হোসাইন , ফিচার লেখক
প্রকাশিত: ০৫:২৫ পিএম, ০৪ জুন ২০২৪

মো. নাজমুল হোসেন ৪৩তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে (মেধাক্রম ৬৯তম) সুপারিশপ্রাপ্ত হন। তার শৈশবের শুরুটা কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার কুড়েরপাড়ে। প্রয়োজনের তাগিদে ১৯৯৯ সালের শেষদিকে বাবা-মায়ের সঙ্গে চলে আসেন ঢাকার মিরপুরে। সেখানেই বড় হয়েছেন। তিনি রোটারী স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঢাকা থেকে এসএসসি এবং আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ ঢাকা থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ করেছেন আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রোটার‌্যাক্ট ক্লাব অব ঢাকা নর্থের সঙ্গে। তিনি এ ক্লাবের সাবেক সভাপতি। এ ছাড়া ছিলেন উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সাংস্কৃতিক ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।

বর্তমানে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে বেপজাতে ‘সহকারী মহাপরিদর্শক’ হিসেবে কর্মরত। সম্প্রতি তার বিসিএস জয়ের গল্প ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন জাগো নিউজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইসমাম হোসাইন

জাগো নিউজ: ৪৩তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডার পেয়েছেন, অনুভূতি কেমন?
মো. নাজমুল হোসেন: কিছু অনুভূতি কখনো ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, হয়তো আমিও পারবো না। রেজাল্ট শোনার পর প্রায় আধা ঘণ্টা কেঁদেছি। নামাজে দাঁড়িয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছি। মহান আল্লাহ আমার পরিশ্রমকে কবুল করেছেন। সত্যি বলতে, আমি অনেক বেশি ভাগ্যবান। কেননা ২৭ বছর বয়সে সরকারি চাকরির প্রস্তুতি শুরুর পর প্রথম বিসিএসে প্রথম পছন্দ প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছি। আমার স্ত্রী, বাবা-মা, ২ বোন, শাশুড়ি ও কাছের বন্ধুরা; যারা এ পথচলায় পাশে ছিল তাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা।

জাগো নিউজ: বিসিএসের স্বপ্ন দেখেছিলেন কখন থেকে?
মো. নাজমুল হোসেন: অনার্সে পড়ার সময়ই জীবনের লক্ষ্য ঠিক করেছিলাম একজন গবেষক হবো। বিদেশে যাবো পিএইচডি করতে। লক্ষ্য পূরণে আরও একধাপ এগিয়ে যাই যখন মাস্টার্স শেষ হওয়ার আগেই আমি আইসিডিডিআর,বিতে ‘গবেষণা সহকারী’ হিসেবে মাইক্রোবায়োলজি ল্যাবে যোগদান করি। সময়টা তখন ২০২০ সাল, করোনা মহামারি চলছে। কেন জানি মনে হলো, বিদেশে গিয়ে মরে ভূত হয়ে থাকলে কেউ আমার খোঁজও পাবে না। তাই মাস্টার্স শেষে দেড় বছর চাকরি করার পর বয়স যখন ২৭, একদিন হুট করেই সিদ্ধান্ত নিই দেশ ছেড়ে যাবো না। যদি দেশেই থাকি, তবে মাথা উঁচু করেই থাকতে চাই। তাই লক্ষ্য নির্ধারণ করলাম বিসিএসকে। বন্ধুদের উৎসাহে ৪৩তম বিসিএসে আগেই আবেদন করা ছিল। প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ঠিক ৬ মাস আগে হুট করে একদিন চাকরিটা ছেড়ে দিই। এভাবেই আমার বিসিএস যাত্রা শুরু।

জাগো নিউজ: বিসিএস যাত্রার গল্প শুনতে চাই, প্রস্তুতি কীভাবে নিয়েছেন?
মো. নাজমুল হোসেন: আমার মায়ের ফুফাতো ভাই অধ্যাপক ডা. আজিজুল হোসেন একবার বলেছিলেন, ‘ভাগ্নে যদি সরকারি চাকরি করতে চাস, ৬টা মাস দরজা বন্ধ করে পড়তে হবে। তাহলে দেখবি চাকরি তোর পেছনে দৌড়াবে, চাকরির পেছনে তোকে ছুটতে হবে না।’ তার এ কথা আমাকে ভীষণ অনুপ্রাণিত করেছিল। ২০২১ সালের এপ্রিলে চাকরি ছাড়ার পর অক্টোবর পর্যন্ত মোট ৬ মাস সুযোগ পেয়েছিলাম ৪৩তম বিসিএসের প্রিলি প্রস্তুতি নেওয়ার। মোটামুটিভাবে নিজেকে গৃহবন্দি করে ফেললাম। এমনকি ফেসবুক থেকেও নিজেকে যথাসম্ভব বিরত রাখলাম। আমার বন্ধু নাঈমের সঙ্গে গ্রুপ স্ট্যাডি করতাম আমার বাসায়, সকাল ৭টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। প্রতিদিন গড়ে ৭-৮ ঘণ্টা পড়তাম। দিনে ৩-৪টি বিষয় নিয়ে আলোচনা করতাম। সপ্তাহভিত্তিক ছোট ছোট পরিকল্পনা করতাম। প্রিলির যখন এক মাস বাকি; তখন শুধু রিভিশন দেওয়ার চেষ্টা করেছি। প্রচুর মডেল টেস্ট সলভ করতাম। পড়তাম আর ভুলতাম আবার পড়তাম। কখনোই এই ভুলে যাওয়া নিয়ে টেনশন করিনি। কারণ টেনশন করলে প্রোডাক্টিভিটি কমে যায়। ২০২১ সালের ২৯ অক্টোবর ৪৩তম বিসিএস প্রিলি পরীক্ষা দিই। ৪৩তম প্রিলি ছিল চাকরি জীবনের প্রথম প্রিলি পাস করার মাইলফলক।

লিখিত প্রস্তুতির জন্য আমি লাইব্রেরিতে পড়া শুরু করলাম। যদিও আমি ৪৩তমের প্রার্থী ছিলাম। বাজারে তখনো নতুন বই আসেনি। আমি ৪১তম বিসিএসের পুরাতন বই কিনেই পড়া শুরু করে দিই। পেপার পড়তাম, বিষয়ভিত্তিক বই পড়তাম, আর প্রচুর নোট করতাম। আর কোনো কনফিউশন থাকলে চায়ের আড্ডায় সেগুলো আলোচনা করতাম। লাইব্রেরিতে সবচেয়ে বেশি সহোযোগিতা পেয়েছি সাত্তার ভাইয়ের কাছ থেকে। সব সময় পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেছেন সরোজ ভাই (শিক্ষা ক্যাডার ৪০তম), সিউল ভাই (কাস্টমস ক্যাডার ৪০তম) আর বন্ধু শরীফ (ট্যাক্স ক্যাডার ৪১তম)।

আরও পড়ুন

ভাইভা প্রস্তুতি নিয়েছি চাকরিরত অবস্থায়। দিনের বেলা কাজের ফাঁকে ইউটিউবে প্রচুর নিউজ দেখতাম, পত্রিকা পড়তাম। অফিস থেকে ফিরে ভাইভার জন্য পড়তে বসতাম। এ সময় শুধু রিডিং পড়তাম। কারণ আমি যথাসম্ভব বেশি বেশি পড়তে চাইতাম। যাতে আশেপাশের সবকিছু সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা নিতে পারি। ডায়েরিতে নোট নিতাম, যাতে ভাইভার আগমুহূর্তে একবার দেখে যেতে পারি। চাকরির পুরো প্রস্তুতি নিজে নিজে নিয়েছি। শুধু লিখিত পরীক্ষার সময় একটা কোচিংয়ে পরীক্ষা দিয়েছি। ভাইভার সময় অন্য একটি কোচিংয়ে মক ভাইভায় অংশ নিয়েছিলাম।

জাগো নিউজ: আড়াল থেকে কেউ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন?
মো. নাজমুল হোসেন: আমি একদম বেকার থাকা অবস্থায় বিয়ে করি। আমার অনুপ্রেরণার একটা বিশাল অংশ আমি আমার স্ত্রীর কাছ থেকে পেয়েছি। নিজে হাতখরচ বাঁচিয়ে আমাকে সাপোর্ট করেছে বেকার জীবনের দিনগুলোতে।
বাবা-মা সেই ছোট্টবেলা থেকে উৎসাহ দিয়ে গেছেন। বাবা একজন গার্মেন্টসের কর্মচারী, মা বাসায় সেলাইয়ের কাজ করেন। সংসারে অভাব ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী। কিন্তু বাবা-মা কখনো কিছু চাপিয়ে দেননি। এই দু’জনের দোয়া আর ভালোবাসা আমার লক্ষ্য পূরণের পাথেয় হিসেবে কাজ করেছে। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মামুন ভাই (অডিট ক্যাডার ৩৮তম), প্রাক্তন সহকর্মী নাইম ভাই (বিবি এডি), সাবিত ভাই, বন্ধু হাবিব, ইব্রাহিম ও স্বাধীন সব সময় উৎসাহ দিয়েছে।

জাগো নিউজ: নতুনরা বিসিএসের জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নেবেন?
মো. নাজমুল হোসেন: আমি বিসিএসের প্রস্তুতির জন্য প্রথমেই চাকরিকে ত্যাগ করি এবং একাগ্রচিত্তে নিজের সর্বোচ্চ পরিশ্রমটুকু করতে চেয়েছি। সুতরাং সর্বপ্রথম আপনাকে আপনার লক্ষ্য অর্জনে অদম্য হতে হবে। আপনাকে দক্ষ হতে হবে চিন্তা, চেতনায়, মানসিকতায়। বিসিএস একটি দীর্ঘ যাত্রা। এই বন্ধুর পথ অতিক্রমের জন্য প্রয়োজন অধ্যবসায়, প্রতিদিনের চর্চা, আত্মবিশ্বাস আর পরিশ্রম করার মানসিকতা। সিলেবাস নিয়ে ছোট্ট ছোট্ট পরিকল্পনা করুন আর আস্তে আস্তে তা বাস্তবায়ন করুন। সিলেবাস অনুযায়ী পড়ার আগে, সিলেবাস থেকে বাদ দেওয়া জানতে হবে। কারণ প্রিলি পরীক্ষায় তো আপনাকে ২০০ তে ২০০ পেতে হয় না। নিজের দুর্বল জায়গাগুলো নিয়ে কাজ করুন। মনে রাখবেন, চাকরির পরীক্ষায় দুর্বলতার কোনো স্থান নেই।

বিসিএসে পড়ার কোনো বিকল্প নেই। নিয়মিত পড়তে হবেই আপনাকে। তবে একই বিষয়ের জন্য একাধিক বই পড়ার চেয়ে একই বই বারবার পড়া উত্তম। তাছাড়া অন্যের নোটখাতা কপি করার চেয়ে নিজে নোট করার চেষ্টা করতে হবে। আরেকটি বিষয়, আপনি যতই জানেন; তা সঠিকভাবে খাতায় এবং ভাইভা বোর্ডে উপস্থাপন করতেও হবে। পড়তে থাকবেন, ভুলতে থাকবেন; তখন আবার পড়তে থাকবেন। কখনো হতাশ হবেন, পড়া ভুলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক মেনে নিন। এতে চাপ কমবে।

জাগো নিউজ: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
মো. নাজমুল হোসেন: ভবিষ্যতে একজন ভালো প্রশাসক হতে চাই। অবশ্যই একজন সৎ মানুষ হিসেবে দেশের ও দেশের মানুষের জন্য সর্বদা কাজ করে যেতে চাই। নিজেকে নিয়ে যেতে চাই মানুষের কাছে। এ ছাড়া মনের সুপ্ত ইচ্ছা আছে, পিএইচডি করবো। সুযোগ হলে পড়াতেও চাই শিক্ষার্থীদের।

এসইউ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।