বিসিএস একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া: শুভ রায় সুমন
শুভ রায় সুমন ৪৩তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলার গোপীরচক গ্রামে। জকিগঞ্জ কিন্ডার গার্টেনে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার হাতেখড়ি। ক্লাস ফাইভে থাকাকালীন তার বাবা মারা যান। এরপর থেকে বড় ভাই তার পড়াশোনা ও সংসারের হাল ধরেন। তারপর জকিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং সিলেট এমসি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেদার প্রোডাক্টস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ও লেদার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতকোত্তর পাস করেন। এর আগে তিনি ৪১তম বিসিএস তথ্য ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন।
সম্প্রতি জাগো নিউজের সঙ্গে তিনি ৪৩তম বিসিএস জয়, ক্যারিয়ার পরামর্শ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—
জাগো নিউজ: ৪৩তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডার পেয়েছেন, অনুভূতি কেমন?
শুভ রায় সুমন: প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়া আমার জীবনের সবচেয়ে অবিশ্বাস্য ঘটনা। এ অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আশা ছিল ভালো কিছু হবে। তবে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হবো, এমনটা ভাবিনি। তাই রেজাল্ট দেখার পর আশ্চর্য হয়েছিলাম! সবকিছুর জন্য মহান স্রষ্টার কাছে কৃতজ্ঞ। প্রথমেই মাকে ফোন দিয়ে বলি, মা আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে, আমি ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছি। আমার সাথে মা-ও আনন্দে কেঁদে ফেলেন। তবে সেদিন বাবাকে খুব মিস করেছি। বাবা থাকলে হয়তো মুহূর্তটা অন্যরকম হতো।
আরও পড়ুন
• বিসিএসের জন্য ধৈর্য ধরে পরিশ্রম করতে হবে: জাহিদ হাসান
• বিসিএসে সেরা মেধাবীরা আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী: আব্দুস সামাদ
জাগো নিউজ: বিসিএস দেবেন এমন ভাবনা মাথায় এলো কীভাবে?
শুভ রায় সুমন: সত্যি বলতে একটি প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরির আশায় বিসিএস প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করি। পুরোদমে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হয় মাস্টার্স শেষ হওয়ার পর পরই। ৪০তম বিসিএসে প্রথম অংশগ্রহণ করি। ওই বিসিএসে ভাইভায় উত্তীর্ণ হলেও ক্যাডার হতে পারিনি। এই রেজাল্টের পর মানসিকভাবে অনেকটাই ভেঙে পড়ি। তবে ভাইভায় উত্তীর্ণ হওয়ায় একটা আত্মবিশ্বাস পাই যে, চেষ্টা করলে হয়তো ভালো কিছু সম্ভব। পরে নিজের দুর্বলতা খুঁজে বের করে দ্বিগুণ উদ্দীপনায় প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করি। পাওলো কোয়েলহোর দ্য আলকেমিস্ট বইয়ের একটা উক্তি আমাকে প্রচণ্ড ভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। উক্তিটা হচ্ছে, ‘যখন তুমি কোনো কিছু মন থেকে পেতে চাইবে পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তোমাকে তা পাইয়ে দেওয়ার জন্য ফিসফাস শুরু করবে।’
জাগো নিউজ: বিসিএস যাত্রার গল্প শুনতে চাই, প্রস্তুতি কীভাবে নিয়েছেন?
শুভ রায় সুমন: যখন মাস্টার্স শেষ হলো; তখন মাথায় চিন্তা এলো বেশিদিন বেকার থাকা যাবে না। দ্রুত একটা চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে। সেজন্য বিসিএসের পাশাপাশি ব্যাংক ও অন্য সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করি। আসলে বিসিএসের প্রস্তুতি ভালোভাবে নিতে পারলে অন্য চাকরির প্রস্তুতিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে হয়ে যায়। নিয়মিত সায়েন্স লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়াশোনা করেছি। বন্ধু-বান্ধব ও সিনিয়র ভাইদের সঙ্গে চা চক্র-আড্ডার ফাঁকে পড়াশোনার টুকিটাকি বিষয় নিয়েও আলোচনা করতাম। স্ট্রেস কমানো ও ভালো প্রিপারেশন নেওয়ার ক্ষেত্রে এটি খুবই কাজে দিয়েছে। তা ছাড়া লাইব্রেরিতে সব ধরনের পত্রিকার কালেকশন ছিল। তাই বইয়ের পাশাপাশি নিয়মিত পত্রিকায় চোখ বোলাতাম। গুরুত্বপূর্ণ কলাম হলে খাতায় ছোট্ট করে নোট করে রাখতাম। ফলশ্রুতিতে বিসিএসের পাশাপাশি অডিটরসহ দুটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হই। এছাড়া আরও কয়েকটি চাকরির ভাইভায় ডাক পেলেও অংশগ্রহণ করিনি।
জাগো নিউজ: আড়াল থেকে কেউ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন?
শুভ রায় সুমন: স্বপ্ন দেখা যতটা সহজ, বাস্তবায়ন করা ততটাই কঠিন। বিসিএস যাত্রায় আমার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা ছিল আমার মা। মানসিক ও আর্থিক সহযোগিতা করেছেন আমার বড়দাসহ ভাই-বোনেরা। আমি বেকার থাকার সময়ও পরিবার থেকে নিরবচ্ছিন্ন সমর্থন পেয়েছি, যেটা আমাকে ভালো কিছু করতে প্রচণ্ড উদ্দীপনা জুগিয়েছে। তা ছাড়া শিক্ষকদের অবদান ছিল অতুলনীয়। বিশেষ করে দিলীপ স্যার (বর্তমানে এমসি কলেজের সহকারী অধ্যাপক), যার কথা না বললেই নয়। শিক্ষক হিসেবে আমার জীবনে স্যারের অবদান সবচেয়ে বেশি।
আরও পড়ুন
• ইংরেজি ও গণিতে ভালোভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে: রণজিৎ
• বিসিএসে নিজের দুর্বলতার দিকে ফোকাস দিন: সৈকত
জাগো নিউজ: নতুনরা বিসিএসের জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নেবেন?
শুভ রায় সুমন: আসলে বিসিএস একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। এখানে মেধাবী ও পরিশ্রমী হওয়ার পাশাপাশি ধৈর্যশীল হতে হবে। প্রিলির জন্য শুরুতে সিলেবাস ও প্রশ্নব্যাংক অ্যানালাইসিস করেছিলাম। এতে প্রশ্নের ধরন সম্পর্কে এবং কোন টপিক থেকে নিয়মিত প্রশ্ন হয়, সেগুলো সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। একই বিষয়ের ক্ষেত্রে তিনটি প্রকাশনীর বই পড়ার চেয়ে একটি প্রকাশনীর বই তিনবার পড়া উত্তম। প্রিলির আগে যেন ৩-৪ বার সম্পূর্ণ সিলেবাস শেষ করা যায়, এরকম একটি টার্গেট রাখলে ভালো। যত বেশি রিভিশন দেওয়া যাবে; তত বেশি নেগেটিভ মার্কিং এড়ানো সম্ভব। রিটেন অনেকটাই ক্যাডার নির্ধারণের জায়গা। সময় কম, লেখা বেশি। তাই এই জায়গায় কৌশলী ও বিচক্ষণ হওয়ার বিকল্প নেই। বেশি পেজ লিখলে বেশি মার্কস নয় বরং প্রাসঙ্গিক লেখাই বেশি মার্কসের সহায়ক। লেখার ক্ষেত্রে চমৎকার উপস্থাপনা, শব্দ চয়ন, বানান শুদ্ধি, কাটাকাটি এড়িয়ে খাতাকে আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে। যথাসম্ভব অল্প কথায় প্রাসঙ্গিক লেখার চেষ্টা করতে হবে। ভাইভা খুবই অনিশ্চিত। অনেকটা ভাগ্যের খেলা। নিজ সম্পর্কে, নিজের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, পঠিত সাবজেক্ট, ১ম তিনটি ক্যাডার চয়েজ, মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, সরকারের উন্নয়ন, অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, সাম্প্রতিক আলোচিত ইস্যু; এগুলো সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নিয়ে ভাইভায় যেতে হবে। এগুলো থেকে প্রশ্ন করলে যেন সুস্পষ্ট উত্তর করতে পারেন। যথাসম্ভব পজিটিভ অ্যাপ্রোচ ও হাসিমুখে উত্তর দেওয়া ভালো। এমন কিছু বলবেন না যাতে আফসোস করা লাগে। ভাইভা বোর্ডে বেফাঁস কিছু বলার চেয়ে সরি স্যার বলাই শ্রেয়। যাদের দ্রুত চাকরির দরকার, তারা অবশ্যই বিসিএসের পাশাপাশি ব্যাংকের প্রস্তুতি নিতে পারেন। আমি এভাবেই আমার কৌশল ঠিক করেছিলাম এবং দুই জায়গাতেই সফল হয়েছি। তবে সফলতা একেক জনের কাছে একেকভাবে আসে। আমার মতো করে আপনি সফল না-ও হতে পারেন। সেলফ স্ট্যাডি করে নিজের কৌশল নিজে ঠিক করে নেবেন।
জাগো নিউজ: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
শুভ রায় সুমন: ভবিষ্যতে দক্ষ প্রশাসক হওয়ার পাশাপাশি প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী হিসেবে যেন মা, মাটি আর মানুষের সেবায় নিজেকে নিবেদিত করতে পারি। পাশাপাশি স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে যেন অবদান রাখতে পারি; আপাতত এটাই ইচ্ছা।
এসইউ/এএসএম