বিশ্ব শিক্ষক দিবস

বাংলাদেশের শিক্ষকদের প্রত্যাশা

জাগো নিউজ ডেস্ক
জাগো নিউজ ডেস্ক জাগো নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৩:০০ পিএম, ০৫ অক্টোবর ২০২৩

খুরশীদুজ্জামান আহমেদ

এবারের বিশ্ব শিক্ষক দিবস বরাবরের মতো নয়। একটু অন্যরকম! কারণ এবারই প্রথম রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘শিক্ষক দিবস’ পালিত হতে যাচ্ছে। মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ওসমানী মিলনায়তনের শীর্ষ অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত গৃহিত হয় যে, এবছর থেকে প্রতি বছর ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হবে। এ সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর ৫ অক্টোবরে শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা জারি করেছেন। পাশাপাশি গত ৩ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ দেশের গুণী শিক্ষক সংবর্ধনার লক্ষ্যে কমিটি গঠন করে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, যা অভিনন্দনযোগ্য। কারণ দীর্ঘদিন থেকে এ দেশের পেশাদারী সচেতন শিক্ষক সমাজ তাদের নিজস্ব মান ও মর্যাদার কথা বিবেচনা করে নিজেরাই প্রতি বছর ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালন করে আসছেন। যা ছিল একান্তই শিক্ষককে জাগ্রত করতে ক্ষুদ্র, বিচ্ছিন্ন ও দায়সারা গোছের কর্মসূচি মাত্র। এবছর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী, সাহসী সিদ্ধান্তে সারাদেশে একই সঙ্গে ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক তথা স্থানীয় সমাজ শিক্ষককে সম্মানের আসনে তুলে ধরার সুযোগ পাবেন বলে আমার বিশ্বাস।

১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর ফ্রান্সের প্যারিসে শিক্ষকদের একটি সম্মেলন হয়। ওই সম্মেলনে শিক্ষকদের অধিকার, দায়িত্ব এবং অন্য বিষয় নিয়ে কথা হয়েছিল। সেদিন শিক্ষকদের কথা চিন্তা করে ইউনেস্কো এবং আইএলও কিছু পরামর্শে স্বাক্ষর করে। তারপর ১৯৯৪ সালে ইউনেস্কোর ২৬তম অধিবেশনে ৫ অক্টোবরকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হলে ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতি বছর ৫ অক্টোবর শিক্ষকদের অসামান্য অবদানকে স্বীকৃতি দিতে শিক্ষকদের স্মরণে, শিক্ষকদের অধিকার ও কল্যাণে, শিক্ষকদের সম্মানার্থে বিশ্বব্যাপী শিক্ষক দিবস পালিত হয়ে আসছে।

আরও পড়ুন: আমার জীবনমুখী শিক্ষার গুরু

প্রতি বছর বিশ্ব শিক্ষক দিবসের একটি প্রতিপাদ্য বিষয় থাকে। ২০২৩ সালের প্রতিপাদ্য হলো ‘The teachers we need for the education we want: The global imperative to reverse the teacher shortage.’ অর্থাৎ ‘কাঙ্ক্ষিত শিক্ষার জন্য শিক্ষক: শিক্ষক স্বল্পতা পূরণ বৈশ্বিক অপরিহার্যতা।’ বর্তমানে বিশ্বজুড়ে শিক্ষকতা পেশা সংকটের মুখে পড়েছে। বার্নআউট বা মানসিকভাবে ক্লান্তি ও অনুপ্রেরণার অভাব বোধ করার কারণে অনেক শিক্ষক তাদের এ মহান পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যুক্ত হচ্ছেন। নতুন শিক্ষকদের পাইপলাইন ছোট হচ্ছে। ২০২২ সালের ‘গ্যালাপ পোল’ শীর্ষক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বার্নআউটের জন্য শিক্ষকতা ছিল শীর্ষ পেশা। ৪৪% নারী শিক্ষকরা পুরুষ শিক্ষকদের তুলনায় বেশি বার্নআউটের কথা জানিয়েছেন। ৫৫% নারী শিক্ষক বলেছেন যে, তারা শিক্ষকতা পেশায় মানসিকভাবে ক্লান্তি বোধ করছেন। বছরের পর বছর মহামারির মধ্যেও শিক্ষায় আরও বেশি কাজ করতে হয়েছে। এছাড়া বাড়িতে কাগজপত্র গ্রেড করা, পারিবারিক ঝামেলা শেষ করে শ্রেণির কাজ সম্পন্ন করা, হতাশ অভিভাবকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীর জন্য পরামর্শ প্রস্তুত করা, সব মিলে শিক্ষকরা মানসিক চাপ অনুভব করছেন। শিক্ষকদের প্রতি ভালোবাসার অভাব, আস্থার অভাব, অবিরাম কাজ এবং শিক্ষার্থীদের আচরণের সমস্যাগুলোর সঙ্গে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয়। যখন স্কুলগুলো শিক্ষকদের হারাচ্ছে, তখন তাদের ফিরিয়ে আনতে এবং তাদের শিক্ষার্থীর ওপর প্রভাব ফেলবে এমন শিক্ষকদের ধরে রাখার জন্য কার্যকরী কর্মপন্থা গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবী বলে আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউনেস্কো ও আইএলও মনে করে। যদিও এই বার্নআউট প্রতিরোধযোগ্য এবং শিক্ষকদের প্রতি স্বহৃদয়ে যত্নবান হলে তাদের কাজকে আরও টেকসই করে তুলবে। তারা কাজে প্রাণ পাবেন, শিক্ষাব্যবস্থা অত্যন্ত শক্তিশালী হবে। শিক্ষকরা শুধু পাঠ্যবই সম্পর্কেই শিক্ষা দেন না বরং তারা পাঠ্যবইসহ জীবন চলার ক্ষেত্রে নানা ধরনের জ্ঞান ও পরামর্শ দিয়ে থাকেন। শিক্ষার্থীকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করেন।

বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষায় এ পর্যন্ত যত উন্নতি ও অগ্রগতি হয়েছে, সেটার প্রায় সবই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই হয়েছে একথা অনস্বীকার্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষকদের জাতীয়করণ করেছিলেন। পরে তারই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালে ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেন। ২০১৪ সালের ৯ মার্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদা দেন ও সহকারী শিক্ষকদের বেতনস্কেল এক ধাপ উন্নিত করেন। তারপরেও আমাদের প্রত্যাশা প্রাথমিক শিক্ষকদের আরও বেশি সম্মানিত করা প্রয়োজন।

আরও পড়ুন: বিশ্ব শিক্ষক দিবস আজ

বাংলাদেশের মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছে নানা অসন্তষ্টি, এখানে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের সম্মানিতে বড় বৈষম্য আছে। তাই এ পর্যায়ের শিক্ষার প্রতি সুদৃষ্টি দেওয়া অতীব জরুরি। দেশের বেসরকারি শিক্ষকসমাজ আর্থিক পরাধীনতার মধ্যে আবদ্ধ। শিক্ষকদের অবস্থা খুবই নাজুক, এ দেশের প্রায় ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে ২৬ হাজার বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায়। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ। অনেক এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানেরও সব শিক্ষক এমপিওভুক্ত নন। তাদের অবস্থা আরও করুণ। যেসব শিক্ষক এমপিওভুক্ত হয়েছেন, তাদের অধিকাংশ চাকরির শুরু থেকেও এমপিওভুক্ত হননি। অথচ এমপিওভুক্তির তারিখ থেকে শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরির অভিজ্ঞতা হিসাব করা হয়। বছরের পর বছর বেতন না পাওয়া অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক শিক্ষা দেওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। তাই মেধাবী শিক্ষিত সমাজ বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হতে খুব আগ্রহী হলেও শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হতে অনীহা প্রকাশ করেন।

উচ্চ মাধ্যমিকের প্রভাষকদের পদোন্নতির বিষয়টি অত্যন্ত জটিল ও অমানবিক। পূর্বে সৌভাগ্যবান কলেজ শিক্ষকরা পদোন্নতি পেয়ে সহকারী অধ্যাপক হতেন। বর্তমানে বেসরকারি শিক্ষকদের এমপিও নীতিমালা-২০১৮ অনুযায়ী উচ্চমাধ্যমিক কলেজের শিক্ষকেরা পদোন্নতি পেয়ে হবেন জ্যেষ্ঠ প্রভাষক। পদোন্নতির জটিল নিয়মে অনেক শিক্ষককেই প্রভাষক পদ থেকেই অবসর নিতে হয়। সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি আরও সহজ করে সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পদ সৃষ্টি করা দরকার।

প্রতিষ্ঠানের প্রধান (অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক, সুপার) থেকে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী সবার বাড়ি ভাড়া মাত্র ১০০০ টাকা, যা দুর্ভাগ্যজনক। সরকারি চাকরিজীবীরা অবসর জীবনেও উৎসব বোনাস পান। অন্যদিকে চাকরিতে থাকাকালীনই কেবল বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা মূল বেতন স্কেলের ২৫ শতাংশ বোনাস পান, বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা ভাতা থেকেও বঞ্চিত, যা মাত্র ৫০০ টাকা। লাগামহীন দ্রব্যমূল্যের বর্তমান যুগে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পরিবার-পরিজন নিয়ে স্বাভাবিক জীবন পরিচালনা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

আরও পড়ুন: প্রিয় শিক্ষককে যেসব গ্যাজেট উপহার দিতে পারেন

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবিতে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির (বিটিএ) সভাপতি বজলুর রহমান মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক শেখ কাওছার আহমেদের নেতৃত্বে টানা ২২ দিনের আন্দোলন উত্তাল হলে ৩০ আগস্ট রাতে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ার ও শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর সঙ্গে আলোচনা করে আন্দোলন স্থগিত হয়। শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী এরপর গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, ‘জাতীয়করণ সংক্রান্ত বিষয়ে দুটি কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাতে শিক্ষকদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হবে। সরকারি-বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের বৈষম্য দূর ও আর্থিক বিষয়টি নির্ধারণ করার পর প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।’ বাংলাদেশের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক বৈষম্য দূর করতে নিশ্চয়ই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হস্তক্ষেপ নেবেন বলে শিক্ষকসমাজ বিশ্বাস করে।

বর্তমানে আমরা ২০৪১ সালের স্বপ্ন দেখছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০২২ সালের ১২ ডিসেম্বর ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবসে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ অর্জিত হওয়ায় নতুন ভাবে আমাদের ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’র পথে এগিয়ে যেতে নির্দেশ দেন। তাই আমাদের শিক্ষা হতে হবে স্মার্ট, অর্থনীতি হবে স্মার্ট, আমাদের গভর্নেন্স হবে স্মার্ট, আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য হবে স্মার্ট। এসব কিছুর মধ্যদিয়ে আমরা নিশ্চয়ই একটি স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরি করতে পারবো! শিক্ষাকে স্মার্ট করতে প্রয়োজন শিক্ষা প্রশাসন, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে এগিয়ে চলা। ২০২৩ সালের বিশ্ব শিক্ষক দিবসে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সবাইকে ২০৪১ সালের স্বপ্ন বাস্তবায়নে অগ্রসৈনিক হওয়ার বিনীত আহ্বান জানাই। চলুন প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে সবাই মিলে অনুস্মরণীয় ও অনুকরণীয় রাষ্ট্রে পরিণত করি।

লেখক: প্রধান শিক্ষক, কালীগঞ্জ করিম উদ্দিন পাবলিক পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়।

এসইউ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।