তন্বীর বিসিএস জয়
ভাইভা বোর্ডে ফার্স্ট ইম্প্রেশন বেশ গুরুত্বপূর্ণ
ফারজানা রহমান তন্বী ৪১তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। তিনি ১৯৯৫ সালের ২৮ জানুয়ারি নরসিংদীর শিবপুর উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মরহুম আলহাজ ইঞ্জিনিয়ার হাফিজুর রহমান সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন। সাত বোনের মধ্যে তন্বী সবার ছোট। তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে একটি বহুজাতিক উন্নয়ন সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত। পাশাপাশি টেলিভিশন উপস্থাপিকা হিসেবেও এগিয়ে চলেছেন।
সম্প্রতি জাগো নিউজের সঙ্গে তিনি বিসিএস জয়, ক্যারিয়ার পরামর্শ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাজেদুর আবেদীন শান্ত—
জাগো নিউজ: বিসিএসে সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার অনুভূতি কেমন?
ফারজানা রহমান তন্বী: কবিগুরুর ভাষায় বার বারই মনে হচ্ছে, ‘আমি পাইলাম ইহাকে পাইলাম’। মহান আল্লাহ তাআলার প্রতি লাখো-কোটি শুকরিয়া। আমাদের মোট জনসংখ্যার ০.০১২% (প্রায়) বিসিএস প্রশাসনে আছেন। তাদের একজন হতে পেরে সত্যি অসম্ভব ভালো লাগছে। যদিও অনেকেই বলেন, দিনশেষে এটি একটি চাকরি। তবে আমার কাছে বিসিএস একটি আবেগ, আমার বাবার স্বপ্ন, অনেক রাত না ঘুমোতে দেওয়ার একটি অনুষঙ্গ। চারদিকের আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করার এক অদম্য স্পৃহা। আমি বলবো, বিসিএস আমার প্রথম প্রেম। তাই সব মিলে এ অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।
আরও পড়ুন: প্রথম বিসিএসেই কৃষি ক্যাডার পেলেন লিখন
জাগো নিউজ: পড়াশোনায় কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল?
ফারজানা রহমান তন্বী: পারিবারিকভাবে আমি বেশ প্রিভিলেজড। বাবা মরহুম আলহাজ ইঞ্জিনিয়ার হাফিজুর রহমান ও মা মোকারিমা খানম এলজিইডিতে কর্মরত ছিলেন। আল্লাহর রহমতে পড়াশোনায় কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল না। তবে আমি ছোটবেলা থেকে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশ বেতারের নিয়মিত শিল্পী ছিলাম। তাই পড়াশোনার সময় অপেক্ষাকৃত কম পেতাম।
জাগো নিউজ: বিসিএস জয়ে কার অনুপ্রেরণা সবচেয়ে বেশি ছিল?
ফারজানা রহমান তন্বী: অবশ্যই আমার বাবার অনুপ্রেরণা। তবে সবচেয়ে খারাপ লাগার ব্যাপার হলো, আমার বাবা এ সফলতা দেখে যেতে পারলেন না। ২০২১ সালের ১ আগস্ট ৪১তমের প্রিলিমিনারির ফল প্রকাশ হয়। সেদিনই আমি আমার বাবাকে হারাই। অন্যদিকে আম্মুও ভীষণ অসুস্থ। সেই কঠিন সময়ে আমার বাসা নরসিংদী থেকে আমি না বলেই ঢাকা চলে আসি। অবচেতন মনে বার বার মনে হতো, আব্বু প্রিলির রেজাল্ট শুনে গেছে, আমাকে এ বিসিএসেই ক্যাডার হতে হবে। আমি আব্বুকে কথা দিয়েছিলাম। এ তাড়না আমাকে ভীষণ আলোড়িত করতো। এ সুদীর্ঘ পথে ক্লান্ত মনের খোরাকের কাজ করতো। পাশাপাশি আমার মা, পরিবার, জীবনসঙ্গী সবার সমর্থন ছিল। তবে চাকরি, উপস্থাপনা সবকিছুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে দিনের কতক্ষণ কীসে ব্যয় করবো, সে হিসেবটা কষতে হয়েছিল আমাকেই।
জাগো নিউজ: বিসিএসের স্বপ্ন দেখেছিলেন কবে থেকে?
ফারজানা রহমান তন্বী: একদম ছোটবেলায়। মা-বাবা ছিলের সরকারি চাকরিজীবী। তাই জন্ম, বেড়ে ওঠা উপজেলা পরিষদ কোয়ার্টারে। শৈশবে যতদূর বুঝতাম, বিভিন্ন দিবসের অনুষ্ঠানে ইউএনও স্যারের কার্যাবলি, সেবামূলক কাজ, বোর্ড পরীক্ষায় উপস্থিতি, সর্বোপরি তিনি যে সম্মান পেতেন; সবকিছুই আমার ভীষণ ভালো লাগতো। আমার লক্ষ্যই ছিল বিসিএস ক্যাডার হবো। এইচএসসির পর আমি ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার কোচিং করিনি, ফরমও তুলিনি। আমার চিন্তায় অটল ছিলাম, ইচ্ছায় আন্তরিক ছিলাম।
আরও পড়ুন: মানুষের কটু কথা অনেক কষ্ট দিয়েছে: মামুন
জাগো নিউজ: আপনার বিসিএস জয়ের গল্প শুনতে চাই—
ফারজানা রহমান তন্বী: আমার প্রস্তুতি কিছুটা ভিন্ন। আমার কিন্তু এ একটিই বিসিএস, ৪১তম। এর আগে পরে আর কিছু নেই। আমি বিশ্বাস করি, এটি একটি জীবনব্যাপী প্রস্তুতির ফসল। তবে নির্দিষ্টভাবে ২০১৫-২০১৬ সাল থেকে আমি এ সম্পর্কিত পড়া শুরু করি। তখন আমরা কয়েকজন বন্ধু একসঙ্গে পড়তাম। তারপর নিজে পড়া শুরু করলাম। আমি প্রিলিমিনারির জন্য কোনো কোচিংয়ে ক্লাস করিনি, পরীক্ষা দিয়েছি। ব্যক্তিজীবনে আমি বেশ পরিপাটি, পড়াশোনাতেও। আমি কোনোদিন মুখস্থ করিনি কিছু। বুঝে বুঝে পড়েছি। শুধু এমসিকিউর মতো নয়, আমি বিস্তারিত পড়তাম, যেন প্রশ্ন অন্যভাবে এলেই বুঝতে পারি। প্রচুর নোট করতাম। কিছু বিষয় থেকে প্রতিবার অবশ্যই প্রশ্ন আসে, সেগুলো বেশ ভালো করে আয়ত্ত করেছিলাম। আমার লিখিতের খাতা ছিল বেশ পরিপাটি। একদম প্রথম থেকে শেষ অবধি লেখা একই রকম। কারণ আমি জানতাম ফুল আন্সার করতেই হবে। তাই সময় ভাগ করে নিয়েছিলাম। তাই খুব ভালো পারি যে প্রশ্নটা; সেটা মনের মতো লিখতে গিয়ে যদি আরেকটা প্রশ্নের উত্তরই করতে না পারি, সেটা কোনো ভালো ফল বয়ে আনবে না। এটি মাথায় থাকতে হবে।
জাগো নিউজ: বিসিএস ভাইভা সম্পর্কে যদি বলতেন—
ফারজানা রহমান তন্বী: ভাইভার প্রস্তুতি আমি বেশ গুছিয়ে নিয়েছিলাম। এ সময়টাতে নিয়মিত পেপার পড়তাম। এটি গুছিয়ে কথা বলতে সাহায্য করে। আমাকে এক স্যার বলেছিলেন, খবর পড়ার মতো করে কথা বলবেন। এখানে যারা যাচ্ছেন সবাই অনেক জানেন। আমি তখনই ঠিক করে নিয়েছিলাম আমাকে পার্থক্য সৃষ্টি করতে হবে। যে কোনো টপিক পড়ে নিজের মতো বলার চেষ্টা করতাম। আমি অনেক নোট করতাম। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলো স্টিকিপেপারে লিখে চোখে পড়বে এমন কোথাও রাখতাম। পড়ার টেবিলের পাশের জানালায় এখনো অনেক ক্ষুদেবার্তা লেখা কাগজ চোখে পড়ে। আমি প্রতিটি প্রশ্নের সম্পূরক প্রশ্ন কী হতে পারে, সেভাবে ভেবে নিজের মতো কিছু ফরমেট সাজিয়েছিলাম। সেসব কাজে লেগেছে। বোর্ডে ফার্স্ট ইম্প্রেশন বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আমার গণমাধ্যমে কাজ করাটাও বেশ ভালোভাবে গ্রহণ করলেন। কথা বলার মুন্সিয়ানা কাজে লাগিয়েছি শতভাগ। আমাকে করা প্রশ্নের ৯০% উত্তর করতে পেরেছিলাম। যে কয়টি পারিনি; সেগুলো অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে ফেস করেছি। এই এক বিসিএসই আমাকে সাফল্য এনে দিয়েছে।
আরও পড়ুন: হতাশ হয়েছি বহুবার কিন্তু হাল ছাড়িনি: আনিসুর রহমান
জাগো নিউজ: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
ফারজানা রহমান তন্বী: আমি যেখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত হবো; সেখানে সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবো। নারী ও শিশুদের জন্য কিছু করার চেষ্টা করবো। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার চেষ্টা করবো।
এসইউ/জেআইএম