পটুয়াখালীতে বসেই লাখ লাখ ডলার আয় করেন রাসেল
ফ্রিল্যান্সিংয়ের আয় দিয়ে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে নিজের স্বপ্নের বাড়ি নির্মাণ করেছেন রাসেল খন্দকার। এটি এই সময়ের রাসেলের গল্প। একে একে পূরণ করেছেন যত শখ অপূর্ণ ছিল। নিজের স্বপ্নের বন্দরে সাফল্যের নোঙর ফেলতে রাসেলকে পেরিয়ে আসতে হয়েছে নানা চড়াই-উৎরাই। সেই গল্পগুলোই জানাচ্ছেন আবদুর রহমান সালেহ—
কম্পিউটার অপারেটর
দশম শ্রেণি পর্যন্ত একপ্রকার দুশ্চিন্তামুক্তভাবেই জীবন চলছিল। আকস্মিক পারিবারিক কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা রাসেলের জীবনকে ফেলে দিয়েছিল অনিশ্চিত বিপর্যয়ের দিকে। যে কারণে পরিবারের হাল ধরতে রাসেলকে বেছে নিতে হয়েছিল কম্পিউটার অপারেটর পদে চাকরি। পটুয়াখালীর জজকোর্ট এলাকায় একটা সময়ে কম্পিউটার অপারেটর পদে চাকরি করে পরিবারের অভাব ঘোচানোর দায়িত্ব নেন রাসেল। এ চাকরিই পরে রাসেলকে অনলাইন মার্কেটপ্লেসে সমৃদ্ধ হতে ভূমিকা রেখেছে। যে রাসেল অফলাইনে কম্পিউটার কম্পোজ, স্ক্যানিং করে সামান্য আয় করতেন; সেই একই স্কিল অনলাইন মার্কেটপ্লেস ফাইভার ডটকমে কাজে লাগিয়ে হাজার হাজার ডলারও আয় করেছিলেন। হয়েছিলেন ফাইভারের টপ রেটেড ফ্রিল্যান্সার। যে আয় ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় লাখ লাখ ডলারের দিকে।
অফলাইন থেকে অনলাইন
কম্পিউটার অপারেটর পদে চাকরির পর পটুয়াখালীর স্থানীয় একটি পত্রিকায় ‘চিফ কম্পিউটার অপারেটর’ পদেও কিছুদিন চাকরি শেষে রাসেল প্রবেশ করেন অনলাইন মার্কেটপ্লেসে। পত্রপত্রিকা, সাময়িকী, গুগল এবং ইউটিউব থেকে প্রাপ্ত তথ্য পেয়ে তুমুল আশাবাদী ও আগ্রহী হয়ে ওঠা রাসেল পুরোদমে অনলাইন দুনিয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করতে থাকেন। বিশ্বের জনপ্রিয় অনলাইন মার্কেটপ্লেস ফাইভারে প্রথম ৫ ডলার আয় দিয়ে শুরু করে এ ফিচার লেখা পর্যন্ত রাসেল সম্পন্ন করেছেন সর্বমোট ৫৭৫৩টি অর্ডার। যা থেকে তিনি আয় করেছেন ২ লাখ বায়ান্ন হাজার মার্কিন ডলার। বাংলা টাকায় প্রায় আড়াই কোটি। আর্থিক বিপর্যয়ে থাকা পরিবার ততদিনে রাসেলের হাত ধরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে একপ্রকার ঈর্ষণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেই।
আরও পড়ুন: ই-কমার্সে এসক্রো সিস্টেম আসলে কী?
যে কাজ করেন রাসেল
অনলাইন দুনিয়ায় প্রবেশের শুরুতে রাসেল তার সদ্য কম্পিউটার অপারেটর পদে থাকা স্কিলের একটা অংশ কাজে লাগিয়ে মার্কেটপ্লেসে ওসিআর কিংবা ডকুমেন্ট কনভার্সন ও এডিটিংয়ের কাজ করেই প্রথম বছরে কয়েক হাজার ডলার আয় করেছিলেন। এরপর প্রতিনিয়ত স্কিল ডেভেলপমেন্টের মাধ্যমে ধারণা পান বিশ্বের জনপ্রিয় বই প্রকাশের প্ল্যাটফর্ম ‘অ্যামাজন কিন্ডেল ডাইরেক্ট পাবলিশিং’ যা কেডিপি নামেই বেশি ব্যবহৃত এবং পরিচিত। রাসেল খন্দকার এই কেডিপি প্ল্যাটফর্মের জন্য বই ফরমেটিং ও লে-আউট ডিজাইন, কভার ডিজাইনসহ বই পাবলিশিং সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ করে দারুণ সফলতা পান। কেডিপি ছাড়াও গ্রাফিক্স ডিজাইন এবং ওয়েবসাইট সংক্রান্ত কাজের অভিজ্ঞতাও বেশ সমৃদ্ধ রাসেলের। যে অভিজ্ঞতা রাসেলের স্বপ্নপূরণের পথে বেশ সহায়ক ভূমিকা রেখেছে এবং প্রতিনিয়ত রেখে যাচ্ছে।
অনলাইনে নেতিবাচক অভিজ্ঞতা
শুরুর দিকে কিছু ক্ষেত্রে ৫ ডলারের একটা কাজ পেতে রাসেল যখন একপ্রকার ঘাম ঝরানো পরিশ্রমের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন, সেই একই কাজ বর্তমানের রাসেল ৫০০ ডলারে করতেও ইচ্ছুক নন বলে জানান। এমনও অভিজ্ঞতা রাসেলের ঝুলিতে রয়েছে, যেখানে বায়ারের ইচ্ছেমতো কাজ করার চূড়ান্ত পর্যায়ে এসেও ক্যান্সেল হয়ে গেছে অর্ডার। পেতে হয়েছে নেগেটিভ রিভিউ। নেগেটিভ রিভিউ মার্কেটপ্লেসে থাকা ফ্রিল্যান্সারদের জন্য অনেকটাই ঝুঁঁকিপূর্ণ। যে ঝুঁকির বাইরে ছিলেন না রাসেলও।
মার্কেটপ্লেসে সফল হতে করণীয়
ফ্রিল্যান্সারদের জন্য ফেসবুক কমিউনিটি ফ্রিল্যান্সারস অব বাংলাদেশের (এফওবি) অ্যাডমিন, টিমএইটএক্সের প্রতিষ্ঠাতা এবং ফাইভারের টপ রেটেড ফ্রিল্যান্সার রাসেল খন্দকারের মতে, বর্তমানে রিসোর্সের পরিমাণ বেশি থাকা সত্ত্বেও নতুনরা পর্যাপ্ত ধৈর্যশীল এবং পরিশ্রমী না হওয়াটা নতুনদের জন্য সফল না হওয়ার একটা কারণ। যদিও আমি নিজেই ফেসবুক, ইউটিউব, গুগলসহ পত্রপত্রিকা, সাময়িকীর সহযোগিতায় নিজেকে এ পর্যায়ে নিয়ে আসতে পেরেছি। কিন্তু এজন্য আমাকে অনেকটা সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে। অনেকটা শ্রমও দিতে হয়েছে এ অঙ্গণে। বর্তমান প্রজন্ম অনেক সময় দিয়ে নিজেকে গড়ে তোলার ব্যাপারে অতটা আগ্রহী মানসিকতা দেখান না। তারা দ্রুততম সময়ের মধ্যে সফল হতে চান। পর্যাপ্ত রিসোর্স বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও স্টেপ বাই স্টেপ গোছানো রিসোর্স খুঁজে পাওয়াটাও অনেক বড় বিষয়। যা না পাওয়ার ফলে অনেকেই সফল হতে চেয়েও হতে পারছেন না কিংবা তুলনামূলক সময় বেশি লাগছে। এই বেশি সময় লাগাটা অনেকের জন্য হতাশারও কারণ। কেউ কেউ আবার ছিটকেও পড়েন। অথচ গোছালো গাইডলাইন পেলে অনেকেই অনেক ভালো করার যোগ্যতা রাখেন, এটাও সত্যি। এ ক্ষেত্রে দক্ষ মেন্টর এবং অভিজ্ঞ ফ্রিল্যান্সাররা ভালো সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারেন নিঃসন্দেহে।
আরও পড়ুন: পাইলট হওয়ার স্বপ্ন আপনার, ব্যবস্থাপনায় ইউএস-বাংলা
কমিউনিটির উন্নয়ন নিয়ে ভাবনা
একটি সংগ্রামমুখর সময় পেরিয়ে এ সময়ের রাসেল যখন বাংলাদেশের লাখ লাখ সম্ভাবনাময় ফ্রিল্যান্সারের জন্য প্রেরণা হিসেবে উচ্চারিত, সেই রাসেলও চান তার কমিউনিটির উন্নয়নসহ নিজের এলাকার আগ্রহীদের জন্যও ভালো কিছুর ভূমিকা রাখতে। অগোছালো রিসোর্সের অভাব পূরণে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে সঠিক গাইডলাইন নিশ্চিত করতে বিভিন্ন অনলাইন-অফলাইন সেমিনারসহ যখন যা সময়োপযোগী, সেই পদক্ষেপগুলোই নিতে চান রাসেল। যার সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে নতুন যারা এ অঙ্গণে নিজেদের মেলে ধরতে চান, তারা যেন সঠিক পথ খুঁজে পান। রাসেল হতে চান সেই পথের সঠিক গাইডলাইনধারীদের একজন।
আরও ইচ্ছা আছে
একটি সফল ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ার গড়তে দীর্ঘ বছর, দীর্ঘ সময় দিতে হয় ফ্রিল্যান্সারদের। যে কারণে বদ্ধ ঘরে ব্যাপক সময় কাটাতে হয় সব ফ্রিল্যান্সারকেই। রাসেলও এর ব্যতিক্রম নন। বদ্ধ ঘরে অনেকটা সময় থাকতে থাকতে একটু অবসর পেলেই বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়েন রাসেল। ঘুরে বেড়িয়েছেন বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য স্থান কক্সবাজার, সাজেক, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবানসহ দেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান। তাছাড়া ভারতেও গিয়েছেন একাধিকবার। রাসেলের নিকট ভবিষ্যতের ইচ্ছা পুরো পরিবার নিয়ে হজ করার। পাশাপাশি প্রতি বছরই ন্যূনতম দুটি করে নতুন দেশ ভ্রমণের।
রাসেলের পরিবার
উপকূলীয় জেলা সাগরকন্যা খ্যাত পটুয়াখালী সদরের ৮ নাম্বার ওয়ার্ডের যুব সংসদ সড়ক (কলাতলা বাজার) সংলগ্ন এলাকার ১ম লেনের বাসিন্দা রাসেল খন্দকার। স্ত্রী এবং ১৮ মাস বয়সী মেয়ে আলিশাকে নিয়ে তার পরিবার। রাসেল খন্দকারের শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছে পটুয়াখালী উত্তর কালিকাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। ২০০৮ সালে পটুয়াখালী সরকারি জুবিলি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ২০১০ সালে আবদুল করিম মৃধা কলেজ থেকে এইচএসসি এবং সরকারি পটুয়াখালী কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।
আরও পড়ুন: গ্রোথ মার্কেটিংয়ে অপার সম্ভাবনা আছে: মেহজাবিন বাঁধন
সংকটে থাকা পরিবারকে সর্বোচ্চ সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাওয়া রাসেল খন্দকারের গল্প বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সিং কমিউনিটির জন্য উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত। এ দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে আরও অনেকেই এগিয়ে যাবেন সমৃদ্ধ আগামীর পথে, এমনটাই প্রত্যাশা।
লেখক: উদ্যোক্তা ও ফিচার লেখক।
এসইউ/এএসএম