প্রথম বিসিএসেই ক্যাডার হন সুদীপ্ত সপ্তর্ষি
ডা. সুদীপ্ত সপ্তর্ষির জন্ম-বেড়ে ওঠা পাবনায়। বাবা জালাল উদ্দিন আহমেদ আইনজীবী, মা বেগম গুলনাহার উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে অবসর নিয়েছেন। সুদীপ্ত পাবনার আরএম একাডেমি থেকে ২০১১ সালে এসএসসি পাস করেন। এরপর পাবনার সরকারি শহীদ বুলবুল কলেজ থেকে এইচএসসি ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। বর্তমানে পাবনা সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত।
সম্প্রতি তার বিসিএস জয়ের গল্প ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাজেদুর আবেদীন শান্ত—
জাগো নিউজ: আপনার ছোটবেলা কেমন কেটেছে?
সুদীপ্ত সপ্তর্ষি: আমার একটি চমৎকার ছেলেবেলা ছিল। আমরা বড় হয়েছি চাচাতো ভাই-বোনদের সঙ্গে এক বাড়ির মধ্যে। বাড়িতে অনেক মানুষ ছিল। বাবা-মা দু’জনই কাজে ব্যস্ত ছিলেন, তবুও কখনো একা লাগেনি। কাজিনরা সবাই আমার চেয়ে বড় হলেও বেশ মিশতাম। খুব বেশি ডানপিটে ছিলাম না, তবে খেলাধুলা খুব পছন্দ করতাম। ক্রিকেট, নানা রকম ইনডোর গেমস আর গল্পের বই নিয়েই আমার ছোটবেলা। বিশেষভাবে ক্রিকেটের পাগল ছিলাম। আমার ধ্যান-জ্ঞান সব ছিল ক্রিকেট।
জাগো নিউজ: পড়াশেনায় কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল?
সুদীপ্ত সপ্তর্ষি: না, এটা একেবারেই ছিল না। আমার বাবা একজন শতভাগ একাডেমিক মানুষ। তিনি পৃথিবীতে একটি জিনিসই মূল্যবান ভাবেন, সেটি হলো পড়াশোনা। আমাদের বাড়িতে সব কিছুর ওপরে পড়াশোনার স্থান ছিল। ধরুন আমি পড়ছি, কেউ টিভি দেখছে বা শব্দ করছে, শুধু যদি বলতাম আমি পড়ছি, অমনি সব চুপ। আমার মায়ের কথা বলতেই হয় এখানে, তিনি শত ব্যস্ততার মধ্যেও আমার পড়াশোনার দিকে নজর দিতে চেষ্টা করতেন। স্কুলে ভর্তি হওয়া, নতুন টিউশনি ঠিক করে দেওয়া, স্যারদের সঙ্গে কথা বলা—সবই তিনি করতেন।
জাগো নিউজ: বিসিএসের স্বপ্ন দেখেছিলেন কখন থেকে?
সুদীপ্ত সপ্তর্ষি: আমার এ পয়েন্টটি মনে হয় কোনো ক্যাডারের সঙ্গেই মিলবে না। আমার বড় বোন ৩৪তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারের একজন সদস্য। ছোটবেলা থেকে সরকারি চাকরির প্রতি সেরকম টান ছিল না। ইনফ্যাক্ট তখন বিসিএস বা সরকারি চাকরির এরকম ক্রেজও ছিল না। ২০১৬ সালে আমার বোন সিভিল সার্ভিসে যোগ দেওয়ার পর আমার সরকারি চাকরির প্রতি আরও মন উঠে যায়। ভাবতাম বেসরকারি খাতে কাজ করব, স্বাধীনভাবে কাজ করব। এ জন্য ৪০তম এবং ৪১তম বিসিএসের ফর্মও তুলিনি, তোলার সুযোগ থাকার পরও। এরপর ইন্টার্নশিপ শেষে মুখোমুখি হলাম কঠিন বাস্তবতার। দেখলাম আমাদের দেশের বেসরকারি খাতের অবস্থা, যেখানে সম্মান, অর্থ, স্বাধীনতা—সব কিছুরই বড় অভাব। এ সময়ে হঠাৎ ৪২তম বিসিএসের ঘোষণা দেওয়া হয়, যেটি ডাক্তারদের জন্য হবে বিশেষ। আমি সুযোগটি গ্রহণ করি। বলতে গেলে, ওই সময়েই মন স্থির করি বিসিএস দেওয়ার জন্য।
জাগো নিউজ: বিসিএস যাত্রার গল্প শুনতে চাই—
সুদীপ্ত সপ্তর্ষি: ৪২তম বিসিএসের ঘোষণা আসার পর মনে মনে প্রস্তুত হতে থাকি। এটি ২০২০ সালের নভেম্বরের দিকে। প্রিলিমিনারির ২০০ নাম্বারের অর্ধেক ছিল মেডিকেল সায়েন্সের এবং বাকি অর্ধেক বাংলা, ইংরেজি ইত্যাদি। তখন এফসিপিএসের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তার জন্যই মেডিকেল সায়েন্স পড়তে হচ্ছিল। তাই সিদ্ধান্ত নিই এফসিপিএস পরীক্ষা পর্যন্ত মেডিকেল সায়েন্সই পড়ব, পরীক্ষার পর সাধারণ জ্ঞান পড়ব। সেই মতে এফসিপিএস দেই জানুয়ারিতে এবং সেই সময়েই প্রিলিমিনারির তারিখ ঘোষণা করা হয়। আমার হাতে দেড় মাস সময় ছিল সাধারণ জ্ঞান পড়ার জন্য।
কোনো সন্দেহ নেই, এ সময়ে বিসিএসের প্রস্তুতি নেওয়া অসম্ভব। এ জন্য আমি ঠিক করি, যে বিষয়গুলো ভালো পারি, সেগুলোতেই পারফেক্ট পরীক্ষা দেব, সাথে মেডিকেল সায়েন্স অংশ তো থাকবেই। সেই মোতাবেক শুরু করি আমার দক্ষতার জায়গাগুলো—ইংরেজি গ্রামার, গণিত, বাংলা ব্যাকরণ এবং বাংলাদেশ বিষয়াবলি নিয়ে। ছোটখাটো গণিত করায় আমার সহজাত দক্ষতা আছে কিছুটা। লেখালেখি করায় বাংলা-ইংরেজির জ্ঞান মোটামুটি ছিল। এগুলোই আরও ভালো করার চেষ্টা করতে থাকি। আন্তর্জাতিক বিষয়াবলির সিলেবাস অনেক বড়, সেটা পড়তে গেলে আমার কোনো কিছুই শেষ হতো না। এ জন্য আন্তর্জাতিক সংগঠন, চুক্তি টাইপ কিছু খুব গুরুত্বপূর্ণ টপিক পড়ি। বাকিগুলো ছেড়ে দেই। ওই দেড়মাস এক রকম অমানসিক পরিশ্রম করি। এখনো মনে আছে, হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে বসে পড়তাম, রোগী এলে বই উল্টে রোগী দেখে আবার পড়তাম।
জাগো নিউজ: কততম বিসিএসের কোন ক্যাডারে আছেন?
সুদীপ্ত সপ্তর্ষি: ৪২তম বিসিএসের স্বাস্থ্য ক্যাডারে আছি।
জাগো নিউজ: বিসিএসের প্রস্তুতি কেমন নিতে হয়? ভাইভার ধরন সম্পর্কে যদি বলতেন—
সুদীপ্ত সপ্তর্ষি: এ ক্ষেত্রে আমার পরামর্শ একটাই—কৌশলে পড়তে হবে। বিসিএসের পড়াশোনা খুবই ব্যাপক। এর আগাগোড়া সিলেবাস পড়া সম্ভব নয়। নিজের শক্তি এবং দুর্বলতা জানতে হবে। সেই মোতাবেক পড়তে হবে। বাংলা ব্যাকরণ, গণিত, ইংরেজি গ্রামার এবং শব্দভান্ডারে দক্ষতার কোনো বিকল্প নেই। এগুলো কম সময়ে অর্জন করাও সম্ভব নয়। কাজেই যারা বিসিএস দিতে চান এবং এ টপিকগুলোয় তেমন দক্ষ নন; তাদের উচিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরই ক্রমে এগুলোতে দক্ষ হওয়ার চেষ্টা করা। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির বাচ্চাদের পড়াতে পারেন। ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব জাতীয় কোনো সংগঠনে যুক্ত হতে পারেন। অবশ্যই প্রচুর বই পড়তে হবে। পিডিএফেও অনেক বই পড়ে ফেলা সম্ভব। পড়ার সময় সেগুলোকে ভালোবাসতে হবে। বিরক্ত নিয়ে পড়লে শুধু সময় নষ্ট হবে।
ভাইভার জন্য জ্ঞানের পাশাপাশি স্মার্টনেস, শান্ত থাকা প্রয়োজন। হঠাৎ করে ভাইভা দিতে গেলে আসলে সেটা সম্ভব নয়। মক ভাইভা দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে, যদি ভাইভা বোর্ড ফেস করার অভিজ্ঞতা না থাকে। নিজের সাবজেক্ট, অঞ্চল, নাম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এ ধরনের ব্যাপারগুলো সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে হবে। সাম্প্রতিক বিষয়গুলো, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানতে হবে। বিসিএসের ভাইভায় যে কোনো টপিক থেকেই প্রশ্ন আসতে পারে। আমি মেডিকেলের ছাত্র হলেও ফেস করেছি বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন লেখকের সাহিত্যকর্ম নিয়ে জটিল কিছু প্রশ্ন। কাজেই অনেক কিছু পড়ে গেলেও অজানা প্রশ্ন অবশ্যই সামনে পড়বে। তাতে ভড়কে যাওয়া যাবে না, স্মার্টলি ফেস করতে হবে। একটি বিষয় মনে রাখা দরকার, বিসিএসের ভাইভা কারোরই পারফেক্ট হয় না। তবুও হাজার হাজার মানুষ ক্যাডার হচ্ছেন।
জাগো নিউজ: কারো কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন কি?
সুদীপ্ত সপ্তর্ষি: আমার স্পেসিফিক কোনো অনুপ্রেরণাদানকারী নেই। তবে সব সফল মানুষই আমাকে অনুপ্রেরণা দেন। বিশেষত আমাদের মেডিকেল সেক্টরের অনেক অগ্রজের সাফল্য আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে।
জাগো নিউজ: আপনার পেশা নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
সুদীপ্ত সপ্তর্ষি: আমার ভবিষ্যৎ নিকট আর দূর। নিকট ভবিষ্যতে অবশ্যই একজন ভালো চিকিৎসক হওয়া, সফল সার্জন হওয়া। আমি বক্ষব্যাধি সার্জন হিসেবে এমএস কোর্সে আছি, সেখানে সফল হতে চাই। আর দূর ভবিষ্যতের পরিকল্পনা নিয়ে এখনো নিশ্চিত নই। এ দেশের মানুষের দারিদ্র্য, অসহায়ত্ব, অশিক্ষা আমাকে পীড়া দেয়। তাদের জন্য যদি কিছু করতে পারি, যা এ দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারবে। তাহলে নিজের জীবনকে সার্থক মনে করব।
জাগো নিউজ: করোনা দুর্যোগে আপনার ভূমিকা কী ছিল?
সুদীপ্ত সপ্তর্ষি: ২০২০ সালের মার্চে যখন প্রথম লকডাউন দেওয়া হয়; তখন আমার ইন্টার্নশিপ শেষ হয়। এরপর লকডাউনে আটকে পড়ি। লকডাউন শেষে কয়েকটি হাসপাতালে স্বল্প সময়ের জন্য ডিউটি করি। সে সময়ে প্রথম করোনা রোগী দেখতে হয়। এরপর সেপ্টেম্বরে পাবনার কমিউনিটি হাসপাতালে যোগ দেই। সেখানে এক বছরের বেশি সময় কাজ করি। এর মধ্যে ছিল ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের জন্য সেকেন্ড ওয়েভের কঠিনতম দিনগুলো। তখন প্রতিদিনই অনেক করোনা রোগী দেখতে হয়েছে। আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি তখন।
এসইউ/এমএস