বড় ভাইয়ের উৎসাহে বিসিএসের স্বপ্ন দেখেন জাকির
মো. জাকির হোসেন ৩৪তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে বর্তমানে প্রশাসন ক্যাডারে কর্মরত। তিনি চাঁদপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মরহুম মো. তাজুল ইসলাম, মা ফিরোজা ইসলাম। চান্দ্রা ইমাম আলী উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি, ঢাকা কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
সম্প্রতি তার বিসিএস জয়, ভবিষ্যৎ স্বপ্ন ও সফলতার গল্প শুনিয়েছেন জাগো নিউজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো. সাঈদ মাহাদী সেকেন্দার—
ছোটবেলা কেমন কেটেছে?
মো. জাকির হোসেন: ছোটবেলা ছিল একদিকে দুরন্তপনায় ভরা, অন্যদিকে কঠোর পারিবারিক অনুশাসন। ক্লাস থ্রি পর্যন্ত বড় আপা খুব যত্ন করে রাখতেন। নিয়মিত মক্তবে নিয়ে যেতেন, নাশতা খাওয়াতেন, গোসল করিয়ে স্কুলে পাঠাতেন। স্কুল থেকে আসার পর ভাত খাওয়াতেন। খেলতে মাঠে চলে যেতাম। মাগরিবের নামাজের আগেই খুঁজে ঘরে নিয়ে আসতেন। হাত-পা ধুইয়ে পড়ার টেবিলে বসাতেন। রাতের খাবার শেষে আবার পড়া। এরপর ঘুম। আপা অনেকটা তার সন্তানের মতোই আগলে রাখতেন। বড় ভাইয়া পড়াতেন মাঝেমধ্যে। মেজ ভাইয়ের সাথে সুযোগ পেলেই খেলতে যেতাম। পুকুরে সাঁতার কাটতাম ইচ্ছেমতো। বৃষ্টির দিনে হা-ডু-ডু, ফুটবল খেলতাম। অন্য সময় লুডু, দাড়িয়াবান্দা, ব্যাডমিন্টন, কানামাছি, ক্রিকেট খেলতাম। কোনটাই খুব যে পারতাম ঠিক তা না। তবে হা-ডু-ডু আর দাড়িয়াবান্দায় দখল ছিল ভালো। কারণ দুইটাই ট্রিকি খেলা। এটা ভালোই পারতাম। বাড়ির এবং এলাকার সহপাঠী এবং বন্ধুরা মিলে প্রায়ই ভুড়িভোজের আয়োজন করতাম। মায়ের কাছে রান্নার সামগ্রী চাইলে মা না করতেন না। বাবাকে খুব ভয় পেতাম। পড়ালেখার ব্যাপারে বাবা ছিলেন খুব কঠোর। সন্ধ্যার পর পড়ার টেবিলে নেই, এটা বাবার কাছে ছিল অচিন্ত্যনীয়। ছোটবেলা থেকেই নির্বাচনে মিছিলে যেতাম। বাবাই বলতো যাও। পড়াশোনার পাশাপাশি এটাও শিখতে হবে। মা চেষ্টা করতেন সব সময় গরম রান্না খাওয়াতে। কোনদিন ঠান্ডা ভাত তরকারি খেতে দিতেন না। বড় ভাইয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসলেন, আপার বিয়ে হয়ে যায়। এরপর প্রতিদিন মা খেয়াল নিতেন। আমি পড়তাম। পাশের বেডে মা নামাজ পড়ে ঘুমাতেন। বাবা অফিস থেকে আসতেন। রাত ১০টার দিকে খাওয়া। সেই যে ছোটবেলা থেকে অভ্যাস, এটা আজও চলমান। রাত ১০টায় ভয়েস অব আমেরিকা এবং সাড়ে ১০টায় বিবিসি বাংলা বাবা নিয়মিত শুনতেন। দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ছোটবেলা থেকেই বাবার সাথে শুনতে শুনতে অভ্যস্ত। চলমান ঘটনা অনেকটা মাথায় থাকতো এমনিতেই।
পড়াশোনায় কোন প্রতিবন্ধকতা ছিল কি?
মো. জাকির হোসেন: পড়াশোনায় প্রতিবন্ধকতা সেরকম ছিল না। বাবা তার সাধ্যের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করতেন সব সময়। বাবা নিজে অনেক কষ্ট করেছেন। নিজে খরচ খুব একটা করতেন না। সবই আমাদের ভাই-বোনদের পড়াশোনার পেছনে ব্যয় করেছেন। ভাইয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন চিঠি দিতেন আমাকে। সব সময় অনুপ্রেরণা দিতেন। বাড়িতে গেলে পড়ালেখার খোঁজ-খবর নিতেন। ঢাকা থেকে ভাইয়া গ্রামার বই, সাধারণ জ্ঞানের বই, ডিকশনারি পাঠাতেন। বই কেনার ব্যাপারে বাবা উদার ছিলেন। যে বইয়ের তালিকা দিতাম, বাবা নিয়ে আসতেন। ক্লাস টেনে শুধু গ্রামারেরই ১৪টির মতো বই ছিল। এরপর তো ভাইয়া নিজের কাছেই নিয়ে আসলেন। ঢাকা কলেজে পড়ার সময় টিউশনি করে আমাকে চালাতেন। আব্বাও সহযোগিতা করতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর বাসায় থাকতাম। অনেকটা জোর করে কিছুদিন হলে উঠি। এরপর আবার বাসায় চলে আসি। মাস্টার্সে আবার হলে উঠি। আব্বা ২০১০ সালে হঠাৎ পরলোক গমন করেন। ভাইয়া সবসময় খেয়াল রাখতেন।
বিসিএসের স্বপ্ন দেখেছিলেন কখন থেকে?
মো. জাকির হোসেন: ২০০৯ সালের আগে কোনদিনই ভাবিনি বিসিএস দেবো। ভাইয়া লন্ডনে যান এসিসিএ করার জন্য। ভাবিও যাওয়ার কথা ছিল। আমাকে সেখানে সেটেলড করে ভাইয়া দেশে আসবেন। ২০০৮ সালের সেই সময় ওয়ার্ল্ড রেসেশন। ভাইয়া একদিন লন্ডন থেকে ফোন করে জানালেন দেশে চলে আসবেন। আমাকে পরামর্শ দিলেন বিসিএস প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য। কারণ নিজ চোখে তিনি লন্ডন জীবন দেখেছেন। সেই জীবন আমার দ্বারা সম্ভব নয়, এটা পরিষ্কার জানালেন। সেদিন থেকে বিসিএস সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেওয়া শুরু করলাম। দেশে এসে ভাইয়া কিছু টাকা দিয়ে বললেন, নীলক্ষেতে গিয়ে বিসিএসের কিছু বই কিনে এগুলো দেখতে থাক। খুব একটা দেখার দরকার নেই। মাস্টার্স শেষ করে সিরিয়াসলি শুরু করার পরামর্শ দেন।
বিসিএস যাত্রার গল্প শুনতে চাই—
মো. জাকির হোসেন: ৩১তম বিসিএসে দারুণ সিরিয়াস। সেই মাস্টার্স পরীক্ষার মাঝেই প্রিলি। ডিপার্টমেন্টের স্যারদের সাথে কথা বলে পরীক্ষা কিছুদিন বন্ধ রেখে প্রিলি দেওয়া। এরপর মাস্টার্স শেষ করি। প্রিলিতে কোয়ালিফাইড। মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস। রিটেনের জন্য অমর একুশে হল, সাইন্স লাইব্রেরি, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি, পাবলিক লাইব্রেরিতে দলবেঁধে পড়াশোনা। সাথে আমার সহধর্মিনী, সাবেক ফ্রেন্ড, সুপ্তি, রিয়াদ। হলের কিছু কাছের বড় ভাই ও ক্লাসমেট। লিখিত পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগের দিন ফাহিম, বর্তমানে আমার সহধর্মিনী মনে করে হলে এসে হাতঘড়ি, কলম, পেন্সিল দিয়ে যায়। খুব উৎসাহ দেয়, মাথা ঠান্ডা রেখে যাতে লিখি। সাথে খাবার-দাবারও দিয়ে যায়। ভাইয়া এক্সট্রা টাকা পাঠায় যাতায়াত এবং ভালো খাবার-দাবারের জন্য। লিখিত ফলাফল শেষে ভাইবা। সে কী প্রস্তুতি। ভাইয়া নতুন জামা-কাপড় বানিয়ে দিলেন, জুতো কিনে দিলেন। ভাইবার জন্য যাবতীয় বই কিনে দিলেন। ভাইবার দিন বন্ধু আলামিন সকালে ঘুম থেকে উঠে জামা-কাপড় পরতে সহযোগিতা করে, সিএনজি ভাড়া করে উঠিয়ে দেয়। ভাইবা দিলাম, প্রায় মিনিট ২০। বেশ হলো। ভাবলাম ক্যাডার চলে আসবে। যেদিন ফলাফল, রেজাল্ট নন-ক্যাডার। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো। সিদ্ধান্ত নেই আর না, ইউএসএ অথবা জার্মানি পাড়ি জমাবো। জার্মানির বিষয়ে অনেকটা এগিয়েও যাই। ভাইয়া খুব রিকোয়েস্ট করলো আবারো ট্রাই করতে। আমার সহধর্মিনী, বন্ধু রাকিব, আলামিন, সুপ্তি, হলের কয়েকজন শুভাকাঙ্ক্ষী বেশ অনুপ্রেরণা দিলো আরও একবার ট্রাই করার জন্য। পণ করে নামি ‘ডু অর ডাই’।
কারো কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন কি?
মো. জাকির হোসেন: প্রথমত আমার ভাইয়া মি. মনির হোসেন। একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকার। বর্তমানে ইউসিবিএল ব্যাংকে ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কর্মরত। ভাইয়ার স্বপ্নই ছিল ভাইয়া ব্যাংকার হবে, আমি বিসিএস ক্যাডার হবো। আব্বাও চাইতেন আমি দেশে থাকি এবং সরকারি চাকরি করি। মনে আছে, যেদিন ভাইয়া লন্ডনে গেলেন, আব্বার কী যে মন খারাপ। চোখের পানিই ফেলে দিলেন। বললেন, তোদের দুইটা ছেলেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালাম। দেশের টাকায়। এখন তোরা বিদেশ চলে যাচ্ছিস। আমি বললাম, আমি তো আছি। মানতে নারাজ, তোর ভাই তোকেও নিয়ে যাবে। আব্বার ইচ্ছে ছিল, দেশেই যাতে আমরা থাকি। দেশের মানুষকে সেবা দেই। এরপর আমার সহধর্মিনী, বন্ধু-বান্ধুব। রাকিব তো সব সময় বলতো বিসিএস তোর হবেই। শুধু সময়ের ব্যাপার। হলে বিসিএসের পড়াশোনা করতে গিয়ে আমি তো ওর পিসি দখলই করে ফেলি। আলামিনের ছিল অনুপ্রেরণা। ব্যাংকের এমটিও চাকরি ছেড়ে চলে আসে আমাকে সাথে নিয়ে বিসিএস পড়বে বলে। ৩৪তম অনেকটা ডেম কেয়ার স্টাইলে দেই। প্রিলি থেকে ভাইবা প্রতি স্টেজে ছিলাম ডেম কেয়ার। হলে হবে, না হলে নাই। ভাইবাতে তো বলেই ফেলেছি, চাকরি লাগবে তাই বিসিএসে অ্যাপ্লাই করেছি। ক্যাডার ক্রম জানতে চাইলে, উত্তর দিয়েছিলাম কোনটার সম্পর্কে খুব একটা জানি না। তবে একটা সিরিয়াল দেওয়া লাগে তাই দিয়েছি। রেজাল্টের দিন আলামিন ফোন করে জানায়, আমার প্রশাসন ক্যাডারে চাকরি হয়েছে।
আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
মো. জাকির হোসেন: যে অবস্থানেই থাকি মানুষের সেবা দেওয়া। ইকনমি, পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন বা রিনিউয়েবল এনার্জির উপরে কোন একটা ভালো ইউনিভার্সিটিতে একটা ডিগ্রি নেবো। আমি একজন প্রেসিডেন্ট স্কাউট’স। স্কাউটিং চালিয়ে যাবো। ইতোমধ্যে উডব্যাজ অর্জন করেছি। এলটি হবো ইনশাআল্লাহ। কারণ স্কাউটিংয়ের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন এবং আত্মবিশ্বাসী হিসেবে গড়ে তোলা যায়। পলিসি নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা আছে। নিয়ম-কানুনের মধ্যে থেকে কপালে যতটুকু আছে, সে পর্যন্ত যাওয়া। লেখালেখির ইচ্ছা আছে। আরেকটু সিনিয়র হই। আর মানুষের সাথে কাজ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করি। তারপর শুরু করবো।
সাম্প্রতিক করোনা দুর্যোগে আপনার ভূমিকা কী?
মো. জাকির হোসেন: করোনা মহামারীতে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়ে গেছে। উপজেলা প্রশাসনে আমার কাজ ভূমি নিয়ে। ভূমি ব্যবস্থাপনার সাথে ছিলাম এতদিন। কিন্তু করোনাকালে এটা বন্ধ আপাতত। এখন কাজ শুধু করোনা নিয়ে। হোম আইসোলেশন, হোম কোয়ারেন্টাইন, খাদ্য সহায়তা বিতরণ, গুজব প্রতিরোধ, সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতকরণ, বাজারদর নিয়ন্ত্রণ, মোবাইল কোর্ট, মাস্ক পরিধান নিশ্চিতকরণে অভিযান, করোনা রোগীকে আইসোলেশন, করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃত ব্যক্তির দাফন, করোনায় আক্রান্ত মৃত ব্যক্তির দাফন কাজ সমাপ্তকরণ- এসব নিয়েই কেটে যাচ্ছে দিন। ইউএনও স্যার মিলে আমরা চেষ্টা করছি, শিবালয়ের মানুষকে সুরক্ষিত রাখতে। আমাদের চেষ্টার কোন কমতি নেই। বাকিটা শিবালয়বাসী বলতে পারবে আমাদের ভূমিকা কেমন।
এসইউ/পিআর