হার্ডওয়ার্কের চেয়ে স্মার্ট ওয়ার্ক বেশি জরুরি
জিহাদ উদ্দিন আহমেদ। বেঙ্গল গ্রুপ অব ইন্ড্রাস্টিজের প্রধান মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক। ১৪ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ নানা দেশের এইচআর বিভাগে। সম্প্রতি মানবসম্পদের বিভিন্ন দিক নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বেনজির আবরার—
আপনার দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময়ের ক্যারিয়ার সম্পর্কে জানতে চাই—
জিহাদ উদ্দিন আহমেদ: আমার ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসে। এরপর ক্যারিয়ারের বড় সময় কেটেছে দেশের অন্যতম বড় শিল্পগোষ্ঠী প্রাণ-আরএফএল গ্রুপে। প্রাণ-আরএফএলে থাকাকালীন সময়ের কাজগুলো আমাকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছে। বর্তমানে বেঙ্গল গ্রুপের ২৪টি কনসার্নের প্রধান মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি।
আপনার শিক্ষাজীবনের কথা যদি বলতেন—
জিহাদ উদ্দিন আহমেদ: আমার জন্ম চট্টগ্রামে, শৈশব ও কৈশোর কেটেছে সেখানেই। পড়াশোনা শুরু চট্টগ্রাম মুসলিম হাই স্কুল থেকে এবং শেষ হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবসম্পদ বিভাগে মাস্টার্স করার মাধ্যমে।
সুদীর্ঘ পথচলার অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে তরুণ চাকরিপ্রার্থীর মধ্যে কোন গুণগুলো দেখতে চান?
জিহাদ উদ্দিন আহমেদ: আমি বিশ্বাস করি, তরুণরা অনেক নতুন কার্যপ্রণালি ডেভেলপ করতে পারে। সেজন্য ফ্রেশার্স নিলে আমার আগ্রহের জায়গা থাকে ছেলেটি বা মেয়েটির মধ্যে বিশেষ কী গুণগুলো আছে। যা অন্যদের মধ্যে পাওয়া যায়নি। পরিশ্রম এবং সততা একজন মানুষের জব লাইফে খুব দরকার। যেহেতু নতুনরা শুরুতে কাজ শিখবে। তাই প্রথম থেকেই তাদের কাছ থেকে সরাসরি কাজের অভিজ্ঞতা বা দক্ষতা চাওয়ার কিছু নেই। একজন ফ্রেশ গ্রাজুয়েটের ক্ষেত্রে কাজ শেখার ইচ্ছা ও মানসিকতা সবচেয়ে জরুরি।
কর্মক্ষেত্রে আদব, আচরণ ও মানসিকতার গুরুত্ব কতটুকু? এর সাথে কর্মপরিবেশ ও প্রোডাক্টিভিটির সম্পর্ক কতটুকু?
জিহাদ উদ্দিন আহমেদ: একটা সময় ছিল, যখন অনেকেই মনে করতো চাকরির ক্ষেত্রে শুধু গৎবাধা কাজ করতে পারা আর কাজের সাথে সম্পর্কিত জ্ঞান ও দক্ষতাই সব; কিন্তু এখন এই ধারণা বদলাচ্ছে। একটি প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র লেভেল থেকে শুরু করে একদম এন্ট্রি লেভেল, প্রত্যেকের ক্ষেত্রে ম্যানার, এটিটিউড, মানসিকতা—এই জিনিসগুলো খুব বেশি প্রয়োজন। আর কিছু কিছু পেশার ক্ষেত্রে তো এটা আরও বেশি দরকার, যেসব জায়গায় অনেক ক্লায়েন্ট হ্যান্ডেল করতে হয়। কারণ অনেক প্রতিযোগিতার এ যুগে টিকে থাকতে হলে অনেক কিছু মাথায় রাখতে হবে।
বাংলাদেশের কর্পোরেট সেক্টরে এইচআর প্র্যাকটিস সম্পর্কে বলুন—
জিহাদ উদ্দিন আহমেদ: আমাদের দেশে এইচআরের শুরুটা বেশি দিনের নয়। এর মধ্যেই চাকরির বাজারে এটি বেশ আলোচনায় এসেছে। কারণ এইচআর একটি স্মার্ট পেশা। আগের চেয়ে অনেক কমপ্লায়েন্স এখন, দেশের প্রায় সব প্রতিষ্ঠানের এইচআর। অনেক বড় পরিবর্তন এসেছে বড় কোম্পানিগুলোর মালিকপক্ষেও। তাই কাজ করা খুব সহজ হয়ে যাচ্ছে। তবে যেহেতু নতুন নতুন প্রযুক্তি আসছে, অনেক পরিবর্তন আসছে, তাই কিছু কিছু চ্যালেঞ্জের জায়গাও আছে।
চ্যালেঞ্জের জায়গাগুলো নিয়ে যদি একটু বলতেন—
জিহাদ উদ্দিন আহমেদ: দেখুন এখন কিন্তু প্রতিটি জিনিস দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব আমাদের একদম দ্বারপ্রান্তে। বলা যায়, এ বিপ্লবের জোয়ার ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে। আমাদের দেশের এবং বাইরের এক সময়ের দুনিয়া কাঁপানো অনেক ব্র্যান্ড এবং প্রতিষ্ঠানের কোন অস্তিত্বও এখন পাবেন না। অপরদিকে অনেক নতুন প্রতিষ্ঠান যুগের সাথে তাল মিলিয়ে অভিনবত্ব অবলম্বন করে এখন নিজেদের শক্ত অবস্থান করে নিয়েছে। প্রযুক্তির উন্নয়ন ও উৎকর্ষতার প্রভাব কিন্তু মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং—এসব ক্ষেত্রে পড়েছে তা নয়, কর্পোরেটেও এর হাওয়া খুব জোরালোভাবেই বইছে। রোবট দিয়ে কাজ করানো, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ব্যবহার—এগুলো তো এখন একদম সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাই সামনের দিনগুলোতে নিজেদের অবস্থান ভালো রাখতে চাইলে মানবসম্পদ বিভাগকেও আধুনিকভাবেই পরিচালিত করতে হবে। এক্ষেত্রে শুধু প্রতিষ্ঠান থেকে উদ্যোগ নিয়ে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ালেই হবে না। মানবসম্পদ পেশাজীবীদেরও আধুনিক মনস্ক হতে হবে, নিজেদের সেভাবে গড়ে তুলতে হবে।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ওপরে ভারতের একটি সেমিনারে বক্তব্য দিয়েছিলেন। সে সম্পর্কে যদি একটু বলতেন—
জিহাদ উদ্দিন আহমেদ: ভারতের পুনে শহরের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজন ছিল। মূল আলোচ্য বিষয় ছিল ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও মানবসম্পদ পেশায় এর প্রভাব, ভবিষ্যৎ এবং আমাদের করণীয়’। সেখানে বাংলাদেশ থেকে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্য ও আরও কয়েকটি দেশের মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞরা ছিলেন। সেখান থেকে এটাই ফুটে উঠেছিল যে, আমাদের আর বসে থাকার সময় নেই। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে এড়িয়ে না গিয়ে দৃঢ়ভাবে এর সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। আমি অন্য দেশের সবার সাথে কথা বলে দেখলাম, অন্যান্য দেশ অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে ইতোমধ্যে। সেই জায়গা থেকে আমাদেরও আরও সক্রিয় হওয়া জরুরি বিশ্বের সাথে তাল মেলানোর জন্যই।
কর্মক্ষেত্রে তরুণ কর্মজীবীকে কিভাবে দেখেন হেড অব এইচআর হিসেবে?
জিহাদ উদ্দিন আহমেদ: তরুণদের আমি ভাবি শক্তির জায়গা। কর্মক্ষেত্রে একদম নতুন হলে আমি চাই অফিস ম্যানারিজম আর কাজের আগ্রহ থাকুক। ধীরে ধীরে নিজেকে ডেভেলপ করার সামর্থ থাকতেই হবে। সেই সাথে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও তরুণদের স্পৃহা, নতুনত্ব ও উদ্যমকে সাধুবাদ জানাতে হবে। তাদের কাজের সুযোগ দিতে হবে এবং যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। তাহলেই নলেজ বেইজড এবং ডিজিটালি ড্রাইভেন প্রতিষ্ঠান করা সম্ভব।
দেশে বেকার গ্রাজুয়েট তরুণদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আপনি বিষয়টিকে কিভাবে দেখেন?
জিহাদ উদ্দিন আহমেদ: সবাই বলে দেশে চাকরির অভাব। কিন্তু আমরা দেখি যোগ্য লোকেরও অভাব। এর পেছনে বড় কারণ সবাই শুরুতেই নিজের লক্ষটাই ঠিক করতে পারে না। এলোমেলোভাবে দৌড়ে কোথাও স্থির হওয়া যায় না। তাই শুরু থেকেই ফোকাসড থাকাটা খুব জরুরি। সেই সাথে যত দ্রুত সম্ভব কাজ শুরু করা উচিত। ক্যারিয়ারের শুরুতেই বসে না থেকে কিছু একটা করা জরুরি। আমাদের দেশের বড় একটি অংশ কোম্পানি ছোট-বড়, বেতন কম-বেশি এগুলো নিয়ে ভাবতে ভাবতেই অনেক দিন পার করে ফেলে। অথচ এটি না করে অন্তত কাজটি শুরু করলে একটি সময় গিয়ে অনেক সুযোগ তৈরি হয়েই যায়। ততদিনে অভিজ্ঞতাও অর্জন হয়ে যায়।
যারা নতুন পেশাগত জীবনে প্রবেশ করবে বা যারা ইতোমধ্যে চাকরিতে আছেন, সবার উদ্দেশ্যে যদি পরামর্শ দিতেন।
জিহাদ উদ্দিন আহমেদ: নতুনদের জন্য তো বললামই। কাজ শুরু করতে হবে এবং নিজেকে দক্ষতায় পরিপূর্ণ করতে হবে। আর যারা ইতোমধ্যেই চাকরিতে আছেন তাদের জন্য আবারও একই কথা বলব, এখন আর পিছিয়ে থাকার যুগ নেই। নিজেকে আপডেটেড রাখতে হবে সবসময়। সারাদিন কাজ করলেই যে অনেক প্রোডাক্টিভ কিছু হয় তা-ও না। তাই হার্ডওয়ার্ক করার চেয়ে স্মার্ট ওয়ার্ক করাটা বেশি জরুরি বলে আমি বিশ্বাস করি। আপনার মাপকাঠি আপনার প্রতিষ্ঠান, আপনার কলিগ বা শুধু আপনার দেশ নয়, নিজেকে গ্লোবালি তুলনা করে সেই লেভেলে নিয়ে যেতে হবে। যে যেখানেই কাজ করেন না কেন, নিজেকে দক্ষ ও যোগ্য করে গড়ে তুলতে পারলে যে কোন জায়গায় মূল্যায়ন পাওয়া যাবে এবং দ্রুত উন্নতিও করা যাবে।
এসইউ/জেআইএম