মুখস্থনির্ভর চাকরির পরীক্ষা: মেধা বিনাশের অদৃশ্য শেকল
হারুন অর রশিদ
তরুণ প্রজন্ম দেশের সবচেয়ে বড় শক্তি। তারা সংখ্যায় বিশাল, উদ্যমী, প্রযুক্তি-সচেতন এবং নতুন সম্ভাবনার বাহক। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এই সম্ভাবনাকে আমরা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারছি না। কারণ চাকরির বাজারে প্রবেশের প্রধান দরজা যেভাবে তৈরি করা হয়েছে; সেটি আজ তরুণদের সৃজনশীলতা ও বাস্তব দক্ষতাকে অবজ্ঞা করে শুধু মুখস্থবিদ্যায় পারদর্শীদের প্রাধান্য দিচ্ছে।
চাকরির বাজারে প্রবেশ করার প্রক্রিয়াতেই আমরা তাদের সম্ভাবনাকে দমিয়ে রাখছি। দেশের সবচেয়ে প্রেস্টিজিয়াস চাকরিগুলো, যা নির্ভর করছে কে কতটা ভালোভাবে বইয়ের তথ্য মুখস্থ করতে পারছেন তার ওপর। একবিংশ শতাব্দীতেও নিয়োগপ্রক্রিয়া দাঁড়িয়ে আছে মূলত মুখস্থনির্ভর পরীক্ষার ওপর। যেখানে জ্ঞান প্রয়োগ, বিশ্লেষণ, সৃজনশীলতা কিংবা সমস্যা সমাধানের দক্ষতা যাচাইয়ের পর্যাপ্ত সুযোগ নেই।
মুখস্থ সংস্কৃতির ক্ষতিকর প্রভাব
একটি প্রজন্মকে যদি আমরা শুধুই তথ্য মুখস্থ করে পরীক্ষা দেওয়ার দিকে ঠেলে দিই, তবে তাদের প্রকৃত চিন্তাশক্তি ও সৃজনশীলতা বিকাশের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ে। বিশ্বব্যাপী চাকরির বাজার দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অটোমেশন, ডেটা অ্যানালিটিক্স বা উদ্ভাবনী গবেষণা নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি করছে। অথচ আমরা এখনো এমন প্রক্রিয়ায় আটকে আছি; যেখানে মুখস্থবিদ্যায় দক্ষরাই এগিয়ে যায়। ফলে বাস্তব দক্ষতায় সক্ষম কিন্তু মুখস্থে দুর্বল তরুণরা চাকরির দৌড়ে পিছিয়ে পড়েন।
এটি কেবল ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, জাতীয় পর্যায়েও ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। নীতিনির্ধারণে বা প্রশাসনে যখন স্মৃতিনির্ভর কিন্তু বিশ্লেষণশক্তিহীন কর্মকর্তারা স্থান পান; তখন নীতি হয় গৎবাঁধা, বাস্তবতা-বিচ্ছিন্ন। ফলে উন্নয়নের পথে উদ্ভাবনী চিন্তার পরিবর্তে দেখা দেয় আমলাতান্ত্রিক জড়তা।
বৈপরীত্যের ফাঁদে প্রজন্ম
বাংলাদেশ ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করেছে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নও দেখি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য যে তরুণ প্রজন্মকে প্রস্তুত করা দরকার, তারা কি সঠিকভাবে প্রস্তুত হচ্ছেন? আমরা একদিকে তাদের বলছি সৃজনশীল হতে, নতুন কিছু উদ্ভাবন করতে। অন্যদিকে চাকরির বাজারে প্রবেশের মূল দ্বারগুলো এমনভাবে গড়ে তুলেছি; যেখানে সৃজনশীলতা বা সমস্যা সমাধানের দক্ষতার কোনো মূল্যই নেই। ফলে তরুণরা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। পড়াশোনার সময় তারা দক্ষতা অর্জনের চেয়ে কেবল তথ্য মুখস্থ করাকে অগ্রাধিকার দেন। দীর্ঘমেয়াদে এটি দেশের মানবসম্পদকে প্রতিযোগিতায় অক্ষম করে তুলছে।
এ মুখস্থনির্ভর সংস্কৃতি তরুণদের মানসিকতার ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তারা জ্ঞানের গভীরে যেতে আগ্রহী হচ্ছেন না। বই পড়ছেন পরীক্ষার নোট হিসেবে। তথ্যকে ব্যবহার করছেন শুধু পরীক্ষার খাতায় ঢেলে দেওয়ার জন্য। সৃষ্টিশীলতা, গবেষণার মনোভাব ও নতুন কিছু উদ্ভাবনের আগ্রহ ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে এমন এক প্রক্রিয়ায়; যেখানে চিন্তার স্বাধীনতা নেই, সমালোচনামূলক দৃষ্টি নেই, কেবল মুখস্থবিদ্যার জোরেই যোগ্যতা নির্ধারিত হচ্ছে।
আরও পড়ুন
বসের মন জয় করার সহজ কৌশল
বিদেশে উচ্চশিক্ষা ও ক্যারিয়ারে যেসব দক্ষতা জরুরি
আরও উদ্বেগজনক হলো, জাতীয় পর্যায়ের আলোচনায় বিষয়টি খুব কমই আসে। আমরা বেকারত্ব নিয়ে কথা বলি, চাকরির চাহিদা ও সরবরাহ নিয়ে কথা বলি কিন্তু চাকরিতে প্রবেশের প্রাথমিক দরজা পরীক্ষাপদ্ধতি নিয়ে গভীর কোনো আলোচনা হয় না। অথচ দিকটি পরিবর্তন করাই হতে পারে সমাধানের মূল।
করণীয় কী?
প্রথমত, চাকরি পরীক্ষায় বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্নের সংখ্যা বাড়াতে হবে। মুখস্থের চেয়ে প্রার্থীর যুক্তি প্রয়োগ, বাস্তব উদাহরণ টানার ক্ষমতা এবং সমাধান প্রস্তাবের দক্ষতা যাচাই করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, বহুনির্বাচনী বা তথ্যভিত্তিক প্রশ্ন কমিয়ে কেস-স্টাডি, সমসাময়িক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ, সমস্যা সমাধানভিত্তিক প্রশ্ন অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যেমন একটি সামাজিক বা অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান কীভাবে করা যায়, তা নিয়ে যুক্তিসঙ্গত পরিকল্পনা জানতে চাওয়া যেতে পারে।
তৃতীয়ত, প্রার্থীদের যোগাযোগ দক্ষতা, দলগত কাজের মানসিকতা এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করার ক্ষমতা যাচাইয়ের জন্য লিখিত পরীক্ষার পাশাপাশি ইন্টারঅ্যাকটিভ মূল্যায়ন প্রক্রিয়া চালু করা জরুরি।
চতুর্থত, নিয়োগকর্তাদের মানসিকতায়ও পরিবর্তন আনতে হবে। শুধু একাডেমিক ফলাফল বা মুখস্থ জ্ঞান নয় বরং দক্ষতা, নেতৃত্ব এবং সৃজনশীলতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ পরিবর্তন ধীরে হলেও ধারাবাহিকভাবে আনা প্রয়োজন। একদিনে মুখস্থনির্ভরতার সংস্কৃতি ভাঙা যাবে না কিন্তু একটি রূপরেখা তৈরি করে ধাপে ধাপে এগোনো জরুরি।
বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ। কিন্তু মুখস্থনির্ভর পরীক্ষার বেড়াজালে আমরা তাদের সম্ভাবনাকে আটকে রাখছি। আমাদের উচিত এ সংকটকে অনুধাবন করা এবং জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা। প্রার্থীদের মেধা ও সৃজনশীলতা যাতে নিঃশর্তে মূল্যায়িত হয়, সে জন্য মুখস্থনির্ভর পরীক্ষাপদ্ধতির পরিবর্তন করা অপরিহার্য। তাতেই চাকরির বাজারে যোগ্য, দক্ষ ও উদ্ভাবনী প্রজন্ম তৈরি হবে, যা দেশের উন্নয়নের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।
এসইউ/এমএস