ডিপসিক কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ এআই অ্যাপ হয়ে উঠলো?

চীনা কোম্পানি ডিপসিকের তৈরি আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআইচালিত চ্যাটবট যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে মুক্তি পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই অ্যাপল স্টোরের সবচেয়ে বেশিবার ডাউনলোড করা ফ্রি অ্যাপের তালিকায় শীর্ষে উঠে এসেছে। এই অ্যাপের হঠাৎই জনপ্রিয় হয়ে ওঠা এবং মার্কিন এআই কোম্পানিগুলোর সঙ্গে ডিপসিকের খরচের পার্থক্য প্রযুক্তির বাজারে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে।
সিলিকন ভ্যালির উদ্যোক্তা মার্ক আন্দ্রিসেন ডিপসিককে এআই দুনিয়ার ‘অন্যতম যুগান্তকারী আবিষ্কার’ হিসেবে চিহ্নিত করছেন।
ডিপসিকের মূল প্রতিষ্ঠান বলছে, তাদের নতুন এআই মডেল বাজারের শীর্ষ এআই মডেল যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক চ্যাটজিপিটির সমকক্ষ। তবে চ্যাটজিপিটির তুলনায় তাদের এআই মডেল তৈরিতে খরচ হয়েছে বহুগুণ কম।
আরও পড়ুন>>
- চীনের ডিপসিকের বাজিমাত, মার্কিন প্রযুক্তিখাতের শেয়ারে ধস
- বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রিতে টেসলাকে প্রায় ধরে ফেলেছে চীনা কোম্পানি
- টিকটক কিনতে আলোচনা, ৩০ দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত জানাবেন ট্রাম্প
অ্যাপ তৈরির গবেষণা দল বলছে, এই অ্যাপটি তৈরি করতে তাদের ৬০ লাখ ডলার লেগেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এআই কোম্পানিগুলোর খরচ করা শত কোটি ডলারের তুলনায় রীতিমতো নগণ্য।
ডিপসিক কী?
ডিপসিক একটি চীনা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স কোম্পানি, যার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল দক্ষিণ-পূর্ব চীনের শহর হাংঝুতে।
কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠা হয় ২০২৩ সালের জুলাইয়ে। তবে তাদের জনপ্রিয় এআই অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাপ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ছাড়া হয় এ বছরের ১০ জানুয়ারি।
ডিপসিকের প্রতিষ্ঠাতা কে?
লিয়াং ওয়েনফেং ডিপসিকের সহ-প্রতিষ্ঠাতা। তিনি নিজের প্রতিষ্ঠিত একটি হেজ ফান্ডের অর্থ ব্যবহার করে ডিপসিক তৈরি করেন।
৪০ বছর বয়সী তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ের গ্র্যাজুয়েট লিয়াং ওয়েনফেং মার্কিন প্রতিষ্ঠান এনভিডিয়ায় বিপুল সংখ্যক এ-১০০ চিপ জমা করছিলেন বলে বলা হয়। এ ধরনের চিপ বর্তমানে চীনে রপ্তানি করা বন্ধ রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, তার সংগ্রহে থাকা আনুমানিক ৫০ হাজার চিপই তাকে ডিপসিক প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করেছে। এ ধরনের চিপের সঙ্গে অপেক্ষাকৃত কম দামি চিপ সংযুক্ত করে, যেগুলো এখনও চীনে রপ্তানি করা হয়, তিনি ডিপসিক তৈরি করেছেন বলে ধারণা করা হয়।
ডিপসিক কারা ব্যবহার করছে?
অ্যাপলের অ্যাপ স্টোর ও ডিপসিকের ওয়েবসাইট থেকে এআই অ্যাপটি বিনামূল্যে ডাউনলোড করা যাচ্ছে। ফ্রি এই অ্যাপ খুব অল্প সময়ের মধ্যেই অ্যাপ স্টোরে ডাউনলোড হওয়া শীর্ষ অ্যাপে পরিণত হয়েছে। তবে কিছু মানুষ এমনও রিপোর্ট করেছেন, তাদের এই অ্যাপে সাইন আপ করতে ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রে অ্যাপলের অ্যাপ স্টোরে সর্বোচ্চ রেটিংয়ের ফ্রি অ্যাপ হিসেবেও এটি নথিবদ্ধ হয়েছে।
কী করে এই অ্যাপ?
ডিপসিক জনপ্রিয় হয়েছে এর শক্তিশালী এআই অ্যাসিস্ট্যান্ট টুলের জন্য। এর কার্যক্রম চ্যাটজিপিটির মতোই।
অ্যাপ স্টোরে দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী, এটি তৈরি হয়েছে ‘আপনার কর্মদক্ষতা বাড়াতে এবং আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে।’
অ্যাপের রেটিং দেওয়ার সময় ব্যবহারকারীরা মন্তব্য করেছেন, অ্যাপটি ‘আপনার লেখাকে আরও ভাবগম্ভীর করে তোলে।’
তবে কিছু প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ক্ষেত্রে এই চ্যাটবটটি অপারগতা প্রকাশ করতে পারে। যেমন- অ্যাপটিকে যখন বিবিসি জিজ্ঞেস করেছিল, ১৯৮৯ সালের ৪ জুন তিয়ানানমেন স্কয়ারে কী হয়েছিল? তখন ডিপসিক উত্তর দেয়, আমি দুঃখিত, এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবো না। আমি একজন এআই অ্যাসিস্ট্যান্ট এবং আমাকে এমন উত্তর দেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছে, যা সহায়ক ও ক্ষতিকর নয়।
অর্থাৎ চীনা প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন অ্যাপ হওয়ায় চীন যেসব বিষয়কে রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল মনে করে, সেসব বিষয়ে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ক্ষেত্রে এই এআই চ্যাটবট শতভাগ সঠিক নাও হতে পারে।
মার্কিন কোম্পানিগুলো কেন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে?
বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক এআই অ্যাপগুলো তৈরিতে যে খরচ হয়েছে, তার চেয়ে অনেক কম খরচ হয়েছে ডিপসিক তৈরিতে। মার্কিন অ্যাপগুলোর তুলনায় কয়েকশ কোটি ডলার কম খরচ হয়েছে ডিপসিক তৈরি করতে। আর খরচের এই তারতম্যের কারণে এআইয়ের বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যের টিকে থাকা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
ডিপসিকের অ্যাপ তৈরিতে কম খরচ হওয়ার বিষয়টি গত ২৭ জানুয়ারি পুঁজিবাজারের হিসাব বদলে দিয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে চিপ তৈরিকারক প্রতিষ্ঠান ও ডেটা সেন্টারের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারে বড় অংকের পরিবর্তন এসেছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এনভিডিয়া, যারা এআই পরিচালনার জন্য শক্তিশালী চিপ তৈরি করে থাকে।
সোমবার তাদের বাজার মূল্য কমেছে ৬০ হাজার কোটি ডলার, যা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে একদিনের হিসাবে কোনো একটি কোম্পানির জন্য সর্বোচ্চ।
বাজারে মূলধনের বিবেচনায় এনভিডিয়া এতদিন বিশ্বের সবচেয়ে দামি প্রতিষ্ঠান থাকলেও গত সোমবার তাদের বাজারমূল্য ৩ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার থেকে একলাফে ২ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। ফলে বাজারমূল্যে মাইক্রোসফট ও অ্যাপলের নিচে তৃতীয় স্থানে নেমে আসে এনভিডিয়া।
ডিপসিক তাদের এআই’র জন্য এনভিডিয়ার তুলনায় অনেক কম দামি ও কম জটিল প্রযুক্তি ব্যবহার করে। ডিপসিকের সাম্প্রতিক সাফল্য বিশ্বের শীর্ষ এআই চিপ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে নতুন এক বাস্তবতার সামনে ফেলেছে।
এতদিন একটা সাধারণ ধারণা ছিল যে, এআই’কে উন্নত করার জন্য বড় বাজেট এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে তৈরি চিপ অবশ্য প্রয়োজনীয়। তবে ডিপসিকের সাম্প্রতিক সাফল্য এই ধারণাকে এবং ভবিষ্যতে এআইয়ের বাজারকে বদলে দেবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
কেএএ/