ফ্যাক্ট-চেক
পাকিস্তান ভারতীয় চিনি কিনে বাংলাদেশের কাছে বিক্রির দাবিটি মিথ্যা
পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনাল গত ৩ ডিসেম্বর এক প্রতিবেদনে জানায়, বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে ২৫ হাজার টন চিনি কিনেছে। পাকিস্তান থেকে এই চিনি কেনাকে কেন্দ্র করে সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ কিছু দাবি করা হচ্ছে- (১) গত অর্থবছরে ভারত থেকে ৫ লাখ টন চিনি কিনেছে পাকিস্তান, সেই চিনি থেকেই ২৫ হাজার টন বাংলাদেশ কিনছে, (২) ২০২৪ সালের আগস্ট মাসেই কেবল ভারত থেকে ৩.৫৬ মিলিয়ন ডলারের চিনি আমদানি করেছে পাকিস্তান। সেই পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ এখন বেশি দামে চিনি আমদানি করছে।
বাংলাদেশি ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠান ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যায়, পাকিস্তান তার উৎপাদিত চিনি শুধু বাংলাদেশে নয়, থাইল্যান্ড, মধ্যপ্রাচ্য এবং আরব-আফ্রিকান নানা দেশেই রপ্তানি করে আসছে। ফলে পাকিস্তান থেকে ভারতীয় চিনি কিনেছে বাংলাদেশ - এই দাবিগুলো মিথ্যা।
গত ৫ ডিসেম্বর হযরত এম হাসান নামের একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট করে প্রথম দাবিটি করা হয়। দাবিটির পক্ষে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা ও ভারতীয় ম্যাগাজিন দ্য উইকে প্রকাশিত দুটি প্রতিবেদনকে সূত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু প্রতিবেদন দুটি যাচাই করে দেখা যায়, এসব প্রতিবেদন প্রকাশের সময়কাল ২০২১ সালের ৩১ মার্চ।
আরও পড়ুন>>
- রমেন রায়ের ওপর হামলার ঘটনা পুরোনো, তিনি চিন্ময়ের আইনজীবী নন
- চিন্ময়ের গ্রেফতার বেআইনি- এমন কোনো মন্তব্য করেননি তুলসী গ্যাবার্ড
- সত্য তুলে ধরায় ভারতে ফ্যাক্ট-চেকারের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা
প্রতিবেদনগুলো থেকে জানা যায়, ওই সময় পাকিস্তান সরকার ভারত থেকে চিনি আমদানির ওপর প্রায় দুই বছরের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। দেশটির তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মুহাম্মাদ আজহার জানিয়েছিলেন, দেশটির অভ্যন্তরীণ মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে পাকিস্তান ভারত থেকে ৫ লাখ টন সাদা চিনি আমদানির অনুমতি দেবে। ভারতীয় ম্যাগাজিন দ্য উইকও তাদের প্রতিবেদনে একই তথ্য জানিয়েছে।
তবে পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম দ্য ডনে এই বছরের ২৪ মার্চ প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ভারত থেকে পাকিস্তানের চিনি আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়ার কয়েকদিনের মাথায় দেশটির তৎকালীন বিরোধীদের তীব্র সমালোচনার মুখে এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হয়। সংবাদমাধ্যমটির ২০২১ ও ২০২২ সালের প্রতিবেদন থেকেও এই তথ্য জানা যায়।
অর্থাৎ, গত অর্থবছরে পাকিস্তান ভারত থেকে ৫ লাখ টন চিনি কিনেছে এবং পরে এই চিনি থেকে বাংলাদেশ ২৫ হাজার টন চিনি কিনছে দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি সঠিক নয়। বরং ২০২১ সালে পাকিস্তান সরকারের ভারত থেকে চিনি কেনার সিদ্ধান্তকে উক্ত দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে। যদিও এই সিদ্ধান্ত পরে প্রত্যাহার করে নেয় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার।
বাংলাদেশের পাকিস্তান থেকে চিনি কেনা নিয়ে দ্বিতীয় দাবিটি হচ্ছে পাকিস্তান চিনি আমদানিকারক দেশ। ২০২২ সালে পাকিস্তান, ভারত থেকে প্রায় ২১৯ মিলিয়ন মেট্রিক টন চিনি আমদানি করেছিল, ২০২৪ এর আগস্ট মাসেই কেবল ভারত থেকে ৩.৫৬ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের চিনি আমদানি করেছে। সেই পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ বেশি দামে চিনি আমদানি করছে এখন।
দাবিটির সত্যতা যাচাইয়ে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চে অনলাইন ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজেশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন প্ল্যাটফর্ম দ্য অবজারভেটরি অব ইকোনমিক কমপ্লেক্সিটির (ওইসি) ওয়েবসাইটে পাকিস্তানের ২০২২ সালে চিনি আমদানি-রপ্তানির তথ্য পাওয়া যায়।
দেশটি ২০২২ সালে ৫ দশমিক ৬৯ মিলিয়ন ডলার মূল্যের চিনি রপ্তানি করেছে। চিনি রপ্তানির তালিকায় ওই বছর পাকিস্তানের অবস্থান ছিল ৮৯তম। পাকিস্তান এই চিনি উজবেকিস্তান, চিন, কাজাখাস্তান, যুক্তরাজ্য ও জার্মানিতে রপ্তানি করেছে।
বিপরীতে, ওই বছর পাকিস্তান ২৪৭ মিলিয়ন ডলার মূল্যের চিনি আমদানি করেছে বলেও জানায় ওইসি। এর মধ্যে ভারত থেকেই আমদানি করেছে ২১৯ মিলিয়ন ডলার মূল্যের চিনি। এই তথ্যটিকে ধরেই দাবি করা হচ্ছে, ২০২২ সালে পাকিস্তান ভারত থেকে প্রায় ২১৯ মিলিয়ন মেট্রিক টন চিনি আমদানি করেছে।
আবার ফেসবুকের ভাইরাল পোস্টগুলোতে দাবি করা হচ্ছে, ২০২৪ সালের আগস্ট মাসেই কেবল ভারত থেকে ৩.৫৬ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের চিনি আমদানি করেছে পাকিস্তান। তবে দাবিটির পক্ষে কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।
বরং খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, ভারত ২০২২ সালের ১ জুন থেকে চিনি রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই নিষেধাজ্ঞার বাইরে। এছাড়া, কোনো দেশের সরকারের অনুরোধের ভিত্তিতে ভারত সরকার সে দেশে চিনি রপ্তানির অনুমতি দেবে।
ভারতীয় সরকারি সংবাদমাধ্যম ডিডি নিউজে গত বছরের ২৬ অক্টোবরে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ভারত ২০২৩ সালের ৩১ অক্টোবরের পর থেকে চিনি রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ বাড়ানোর ঘোষণা দেয়, যা পরবর্তী নির্দেশ না আসা পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। মূলত, এই নিষেধাজ্ঞা প্রথম দেওয়া হয় ২০২২ সালের ১ জুন থেকে ২০২২ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এই বছরের ৬ সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২৩ সালে জারি করা এই নিষেধাজ্ঞা এই বছরও বহাল রয়েছে এবং ভারত এই নিষেধাজ্ঞা আগামী বছরের জন্যেও বহাল রাখার পরিকল্পনা নিয়েছে।
পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনাল জানাচ্ছে, পাকিস্তান চিনি শিল্প এই বছর প্রায় ৬ লাখ টন চিনি বিক্রির চুক্তি করেছে। এর মধ্যে ৭০ হাজার টন চিনি মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে পাঠানো হবে। এর মধ্যেই পাকিস্তান থাইল্যান্ড থেকে ৫০ হাজার টন চিনি কিনেছে।
পাকিস্তান চিনি ব্যবসায়ীদের এক কর্মকর্তা মজিদ মালিকের মতে, উপসাগরীয়, আরব ও আফ্রিকান দেশগুলো পাকিস্তান থেকে চিনি কিনতে চুক্তি করেছে। পাকিস্তান চিনি রপ্তানি থেকে ৪০০-৫০০ মিলিয়ন ডলার আয় করবে বলে জানিয়েছে সংবাদমাধ্যমটি।
সার্বিক বিবেচনায় পাকিস্তান ভারত থেকে চিনি আমদানি করে বাংলাদেশে বিক্রি করছে দাবিতে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া তথ্যগুলোকে মিথ্যা হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে।
কেএএ/